চেতনায় ধ্বনি প্রতিধ্বনি

এখন আমার চারপাশে মেঘ আর হাড়-কাঁপানো হাওয়ার
ধেয়ে আসা, মাথায় তুষারকণা জমেছে আগেই,
কিন্তু প্রাণে নিত্যদিন বসন্তবাহার
জেগে থাকে কী সহজে। এখনও কত যে
পথঘাট পাড়ি দিতে হয়,
কত খানাখন্দ
পেরিয়ে এগোতে হয়, গায়ে লাগে কাদা, ধুলোবালি
যথারীতি। আমার ভেতরকার সরোবরে ডুব-
সাঁতার কেটেই ধুয়ে ফেলি সব ক্লেদ।
অবজ্ঞা, ধিক্কার তুচ্ছ করার সাহস নক্ষত্রের উদ্ভাসন,
বৃক্ষের স্থৈর্যের কাছ থেকে পেয়ে যাই
বারবার ঘোর অন্ধকার পথে, যেখানে করোটি
আর হাড় রয়েছে ছড়ানো আর নানা
বিভ্রম-জাগানো ধ্বনি-প্রতিধ্বনি চেতনায় বিপন্নতা আনে।

চকিতে দুঃস্বপ্নঘেরা পথে একটি সোনালি হাত
কোমল মুদ্রায় ছোঁয় আমার কম্পিত হাত,
জ্যোৎস্নাভেজা স্বরে
কে যেন অভয় দিয়ে দিয়ে বলে,
‘তোমার মাথার সব কুয়াশা এখনই
ঝেড়ে ফেল, পোক্ত পায়ে পাড়ি দাও পথ,
এই তো এসেছি আমি তোমার আপন ভালোবাসা।

০২
কখন থেকে বসেছিলাম টেবিল ছেড়ে কিছু দূরে,
মনে পড়ছে না। তন্ময়তা আমাকে
ওর মুঠোয় পুরে একেবারে ভুলে গিয়েছিল আমার
তরতাজা অস্তিত্ব। ভেবেছিল আমি বুঝি মাটির ঢেলা,
পাথর কিংবা নিদেনপক্ষে মূর্গির ডিম। হঠাৎ
স্মরণ হতেই মুঠো আলগা করে দিল এবং আমি
নড়েচড়ে বসি, নিঃশ্বাস
নিতে নিতে মনে হলো, আমার ভেতরে কিসের বীজ যেন
চোখ মেলছে, অন্তর্গত মরুভূমিতে ঝরনাধারা
বইতে শুধু করে যেন। সুনসান খেয়াঘাটের মাটিতে
পড়ে-থাকা শুক্‌না পাতাগুলো মাছ হয়ে
পানিতে ঝাঁপ দেয়, পুরনো কয়েকটি বেঁটে বাঁশ

নিমেষে হরিণে রূপান্তরিত। পথের ধারে পরিশ্রান্ত, ঘুমন্ত
একজন কারিগরের হাতুড়ি নেচে-নেচে নুড়ি
আর পুরনো ইটকে পিটিয়ে গুঁড়ো করে
মুক্তো বানিয়ে ফেলে। তন্ময়তা
নিজেই আর কোনো বীজ নয়, হিল্লোলিত শস্য। আবেগে
থরথর আমি নৃত্যপর শস্যকে বুকে জড়িয়ে ধরি।

বুকের ভেতর মরুভূমির দাহ নিয়ে থাকি এখন,
আমার শরীর থেকে তোমরা পোড়া পোড়া গন্ধ কি পাও?
আমাকে রোজ পোড়ায় কিছু হিংস্র মানুষ পালা করে
কখনও ফের বুকের মাংস ছিঁড়ে খাচ্ছে বন্য কুকুর।

সন্ধ্যারাতে মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে আসে বাঁকানো হাত,
হাতের মুঠোয় রক্তে ভেজা কেমন দু’টো চোখের মণি।
ধেড়ে ইঁদুর তেড়ে আসে প্রাচীন কালের গর্ত থেকে,
অন্ধ বাউল হু হু পথে গান গেয়ে যায় অচিন পাখির।
হরহামেশা এক রূপসী আমায় কঠিন জেরা করে,
যেন আমি কাঠগড়াতে নজরবন্দি ঘোর আসামী।
আমার হাতে আমি নিজেই বেলাবেলি খুন হয়েছি,
অন্য কোনও কসুর ছাড়াই পাচ্ছি সাজা ঘন ঘন।

ইচ্ছে হলেই শিকারি সব কুকুর থেকে অনেক দূরে
থাকতে পারি; কিন্তু ওদের ক্রূর থাবার ধারে কাছে
ঘুরে বেড়াই সুধার জন্যে। আমার যিনি মনোনীতা
পারেন তিনি সুধার পাত্র বাড়িয়ে দিতে ওঠে আমার।

জেরায় আমি কুঁকুড়ে থাকি, ঝরনাধারার মতো সহজ
কথা মনে কুসুম ফোটায়, হৃদয়ে রঙধনু জাগে-
এমন বোধে আস্থা রেখে পথ চলেছি সারাবেলা;
অথচ হায়, খাচ্ছি হোঁচট, পদে পদে রক্ত ঝরে।

প্রেমময়ীর হৃদয় থেকে নির্বাসিত থাকব আমি
কেমন করে? কেমন করে কাটবে প্রহর তার বিহনে?
পদ্য লিখে, মদ্য পানে, আড্ডা দানে সুখ পাব না,
হৃদয়জোড়া হাহাকারে থাকব নিয়ে শূন্যতাকে।