এখনো খুঁজছি

সেই কবে তুলে নিয়েছিলাম হাতে,
এখনো আছে;
আমি আমার কলমের কথা বলছি।

তার চাঞ্চল্যের মাধুর্য এখনো অস্ত যায়নি,
তাই, এখনো গাধার খাটুনি খেটে দিনের পর দিন
বিস্তর আগাছা উপড়ে ফেলে
অলৌকিক ফুলের কেয়ারি বানাই।

এই আমার কলম প্রত্যহ শোনে
সপ্তকাণ্ড কাহিনী
যার মুখে যা আসে শুনিয়ে যায়,
অনেকে পায়ে পড়ে করে নসিহত
কেউ কেউ চৌরাস্তায় চোখ রাঙায়,
আবার কেউবা বলে স্নেহার্দ্র চোখে-
আহা, তোর মুখে ফুলচন্দন পড়ুক।

যা বলতে চাই, আমার কলম, কম-বেশি,
তারই প্রতিধ্বনি, কখনো স্পষ্ট,
কখনোবা অস্পষ্ট,
স্বপ্নে-শোনা কোনো গুঞ্জনের মতো।

আমার সৌভাগ্য, এই যে কলম আমার,
যাকে আমি প্রাণপণ আঁকড়ে রয়েছি দিনরাত্তির,
তার ভাষা উদ্ভাসিত দেবদূতের হাসি,
যা আমি দেখেছিলাম এক বর্ষাগাঢ় রাত্রে।

সে ভাষায় ছায়া ফেলে সমুদ্র থেকে উঠে-আসা
জলকন্যার চোখের রহস্যময়তা;
যে-জন সর্বস্ব আমার,
তার অস্তিত্বের কলতান সে ভাষায়।

বজ্রপাতে দগ্ধ হয়েছে যে পাখির নীড়
তার আর্তনাদ আমার কলমাশ্রিত।
গহন অরণ্যে হরিণের খুশির লাফ
সোনালি সাপের সুন্দর প্রস্থান,
কিংবা শববাহকদের উদাস বসে থাকা
কবরে পুষ্পার্পণ,
স্নিগ্ধ ঝরণার ধারে বনজ প্রাণীর সংসর্গে
অর্ফিয়ুসের বংশীধ্বনি,
চাঁদ সদাগর আর মনসার অপোসহীন বিবাদ,
নহর নির্মাণকালে পাথর আর লতাগুল্মের সঙ্গে
ফরহাদের আলাপ,-
সবকিছুই সাবলীল ফোটে আমার কলমের আঁচড়ে।
আজ আমি কলমের চোখে চোখ রেখে অকুণ্ঠ
বলতে পারি ধন্যবাদ, বন্ধু, ধন্যবাদ।
ব্যাপারটা, মানে কবি হিসেবে, মোটামুটি তৃপ্তিকর।

অথচ আবার প্রায়শঃই একটা ব্যর্থতাবোধ
খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে ভয়ানক ক্লান্ত করে আমাকে,
বিপন্ন করে। কেননা, বলিভিয়ার জঙ্গলে
গুলীবিদ্ধ চেগুয়েভারার স্বর্গীয় নিদ্রার ভাষা
আমার অনায়ত্ত
এবং
মাতৃভাষার জন্যে, স্বদেশের জন্যে যে তরুণ বুকের খুন
ঝরিয়েছে রাস্তায়, সে রক্তের ভাষার কাছে
কী অসহায় আর আনাড়ী রয়ে গেলাম এখনো,
কেমন ভাষাহীন। সে ভাষার মতন
একটা কিছু আমি খুঁজছি, এখনো খুঁজছি।