একজন শহীদের মা বলছেন

যাকে দশ মাস দশ দিন পেটে ধরেছি, এখন
সে কোথায়? পুড়িয়ে আমার বুক এই
পোড়া দেশটিকে ভালোবেসে,
ভালোবেসে শাপলা শালুক, খালবিল, মাছরাঙা,
সোমত্ত নদীর বাঁক, দোয়েলের শিস,
দিগন্ত সবুজ-করা টিয়েদের ঝাঁক,
যৌবনের প্রফুল্ল সকালে
ঝরে গ্যাছে। এখন কোথায় ওর হাড়গোড় সার
হচ্ছে ক্ষেতে স্বপ্নময় শস্য হবে বলে
আমি তা’ জানি না।

সময় কাটতো ওর রাশি রাশি বই পড়ে, খুব
রাত করে ঘুমোতে সে, কখনো কখনো
কণ্ঠে ওর নক্ষত্রের মতো
ফুটতো কী সব কথা, যা ছিল আমার
বোধের ওপারে। বলতো সে
মাঝে-মাঝে, রাতে স্বপ্নে দেখি
ফুটেছে গোলাপ এক বুকের ভেতরে
মা, তোমার মমতার মতো। তোমার মুখেই দেখি
প্রতিদিন স্বদেশের মুখ এবং যখন তুমি
ঘর ঝাঁট দাও, ভাবি সরাচ্ছো জঞ্জাল এ দেশের
মৃত্যু তার, বলে ওরা, করেছে আমাকে মহীয়সী,
আরো কত কথা বলা হয়
যা’ শুনে আমার মাথা গর্বে দূরের আকাশ ছুঁতে
পারে লহমায়।

নিজস্ব দুঃখের চেয়ে গৌরব অনেক বড়, এই
অলংকৃত ভান নিয়ে দ্রুত ক্ষয়ে যাওয়া
কী দুঃসহ, আমি ছাড়া বুঝবে কে আর পৃথিবীতে?
আমার এ শূন্য বুক পোড়ো বাড়ি, যাতে
লক্ষ্মীপ্যাঁচা ডেকে ওঠে ঘোর মধ্যরাতে, ক্লান্ত লাগে,
দেয় না ঘুমোতে কিছুতেই ফণিমনসার খোঁচা।
যে তম্বীকে ভাবতো সে স্বপ্নের একান্ত সহচরী,
তার দু’টি হাতে মেহেদির ছোপ লাগার আগেই
একটি শিকারি বাজ ওকে
করেছেন হনন,
কেননা সে চেয়েছিল গণতন্ত্র মুক্তি পাক লিখে
বুকে, স্বৈরাচারী শাসকের পতন ঘোষণা করে
হেঁটে যাবে রাজপথে, মাথা তার ছোঁবে
আকাশের মেঘলা খিলান। এখন সে জীবনের সাজ-পরা
কিংবদন্তী; কিন্তু আমি কী করবো এই
কিংবদন্তী নিয়ে? স্বপ্নে-দেখা কী নির্দয়
গোলাপ ফুটেছে দ্যাখো, দ্যাখো দেশবাসী
তরতাজা যৌবনের বুকে!

হয়তো ভবিষ্যতে অনেকেই
তার কথা বলে দিব্যি মাতাবে শ্রোতার ভিড় আর
করবে এমন কেউ কেউ উচ্চারণ
ওর নাম, হোমরা চোমরা তারা, যারা
তার কথা বলছে শুনলে সে আবার অকস্মাৎ
জিন্দা হয়ে পতাকার মতো হাত তুলে
জনসভা পণ্ড করে জানাবে তুমুল প্রতিবাদ,
ওদের মুখোশ-আঁটা ভণ্ড মুখে দেবে ছুঁড়ে থুতু শুধু থুতু।