হরিণী-কবিতা

সুন্দরবনের রোদ-চকচকে হিরণ পয়েন্টে যে হরিণী
জলপানে মগ্ন সেই কবে, পুনরায়
যেন সে বিদ্যচ্চমক কবিতার রাজধানীতে সকালবেলা;
এ-ও এক খেলা তার শহরকে জড়িয়ে শরীরে।

অনির্বচনীয় রূপ নিয়ে একগা হরিণী যায়
কবি সম্মেলনে হেঁটে যায় সাবলীল, মহিমার
ছটা তার সত্তা থেকে বিচ্ছুরিত; হঠাৎ উধাও।
এদিক ওদিক খুঁজি, বুক চিরে ট্রেন দূরগামী, চতুর্দিকে
সুচতুর শিকারীর ফাঁদ পাতে বন্দুকের ট্রিগারে আঙুল
রেখে ঘোরে ইতস্ততঃ। হরিণীর কোথায় তেমন বর্ম যাতে
সহজে পিছলে যাবে ঝাঁক গুলী?
ওদের সকল তাক যাক ফস্কে যাক।
অকস্মাৎ হরিণীকে দেখি উত্তাপ উপেক্ষা ক’রে
চলেছে ব্যানার ছুঁয়ে কবির মিছিলে, গায়ে তার
বাংলার মখমলী গাঢ় সবুজিমা, এমন সুন্দর টিপ
কোথায় সে পেলো? কাঁচপোকা
ব’সে আছে মসৃণ কপালে?
গলায় নিবিড় লগ্ন নক্ষত্রের মালা,
দু’চোখে বিলীয়মান স্বপ্নের অস্পষ্ট দীর্ঘশ্বাস,
যেন সে লাফিয়ে ওঠা শিখা, প্রতিবাদে
স্পন্দিত সৌন্দর্য ক্ষণে ক্ষণে,
চম্কে তাকায় রৌদ্রে স্নাতা। অদূরে দাঁড়িয়ে দেখি
তাকে, দেখে সে-ও, পরস্পর চোখাচোখি, বুঝি এক
মধুর মালিন্যহীন গোপন দাঁতাত।

জানি আজ প্রকৃতির অভিষেক হবে তার হাতে
আবার নতুন ক’রে। চলায় ছিলো না দ্বিধা, পথে
পুলিশের ভ্যান,
তবু দৃক্পাতহীন চলেছি সম্মুখে, তার গায়ে
আঁচড় লাগলে কোনো আমার হৃদয়
বিষম আহত হবে, অশ্রু হ’য়ে ঝরবে শোণিত
সারাক্ষণ, চাই না কখনো তার সৌন্দর্য ভুলেও
অন্ধকার মর্গে যাক। সে থাকুক বেঁচে রোদবৃষ্টি বুকে নিয়ে
দীর্ঘজীবী কবিতার মতো সজীব, নিটোল। নিত্যদিন
আমার জীবদ্দশায় হোক সে অধিক বন্দনীয়।

হরিণী অক্ষরবৃত্তে এগোয় মঞ্চের দিকে, মাইক্রোফোনের
মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কবিতা পড়ে। শব্দাবলী থেকে
যন্ত্রনা গিয়েছে ঝ’রে, পথকষ্ট মুছে গেছে, লুপ্ত স্বেদমুক্তো;
কবিতা পাঠের কালে নিজেই কবিতা হ’য়ে জ্বলে
সুবিশাল সমাবেশে পিন-পড়া স্তব্ধতায়। হ্রদের পানির
মতো স্বচ্ছ বাক্য রাত্তিরে লতিয়ে ওঠে, আখেরে চকিতে
কখন যে নেমে আসে, চ’লে যায়, ‘হরিণী-কবিতা’
ব’লে আর্তনাদ করি, তাকায় না ফিরে। আমি কুকুরের মতো
কী ব্যাকুল চুমো খাই চিহ্নহীন পদাচিহ্নে তার। একা-একা
যতি, ছেদ, পর্বসহ তাকেই মুখস্থ করা নিয়তি আমার।
কে ডাকে আমাকে মধ্যরাতে? কে এক অকালমৃত কবি
লেখার টেবিল থেকে ওঠে এস যেন
শয্যা ত্যাগ করার নির্দেশ দিয়ে ডেকে নেন কাছে।

মুখ তাঁর, মনে পড়ে, ‘ক্লেদজ কুসুম’ গ্রন্থটির
অন্তর্গত; ব্যথিত ফ্যাকাশে। স্থির হও, বসো তুমি
এখানে চেয়ারে, লেখো একটি সনেট
নিষাদে, নির্বেদে ভরপুর। যাকে চাও
সে হরিণী নাকি অমল কবিতা, সে তোমার
কোনোদিন হবে কিনা ভেবে কষ্টে বিবর্ণ হয়ো না।
আমার মতোই, হাতে তুলে নাও এখুনি কলম;
থাকবো না বেশিক্ষণ, ঢুকবো কফিনে পুনরায়,
‘বিদায়, বিদায়’ ব’লে তিনি ঘন কুয়াশায় ট’লে ট’লে
মিশে যান। নির্ঘুম, স্তম্ভিত ব’সে থাকি
কিছুক্ষণ বড় একা। কবিতা-হরিণী ধরা দিয়ে চ’লে যায়।

১৭।২।৯০