যে-পথে ঝলসে উঠবে

এই যে আমি দাঁড়িয়ে আছি মাটির উপর,
এই মাটি কি আমার?
যে শ্যামল ভূখণ্ডকে মাতৃভূমি বলে জেনেছি,
একি আমারই দেশ?
তাহলে কেন এমন বেগানা মনে হচ্ছে একে?
কেন এরকম বিকৃত এর মুখ কেন? কেন?
কারা যেন এ্যাসিড ছুঁড়ে দিয়েছে রূপসী বাংলার মুখে,
আমার নিকট থেকে দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে স্বদেশ।

অনেকগুলো নোংরা, লোমশ হাত চেপে ধরেছে
গায়ক পাখির কণ্ঠ, যাতে সে চরাচরে
ছড়াতে না পারে প্রাণজাগানো, কাল মাতানো সুর।
অনেকগুলো সাড়াশির মতো হাত
ফুল না ফুটতেই চটকে দিচ্ছে মুকুল সমুদয়।
যাকে আমি জননী জন্মভূমি বলে ডাকি
আমার মর্মমূল থেকে,
সে নিশ্চুপ দেখছে সুন্দরের খুন-হওয়া,
যেন এতে সায় আছে তার।

না, বিলাপের ধ্বনিতে আমি ভারি করব না
তোমার বাতাস, বিষাদের কুয়াশা
ছড়িয়ে দেব না তোমার নিশ্বাসে। আজ এই তাণ্ডবে
তোমাকে প্রশ্ন করতে চাই, হে স্বদেশ আমার,
রক্ত-সমুদ্র থেকে তোমাকে পদ্মের মতো তুলে এনেছিল
যারা গভীর ভালোবাসায়,
কেন তাদের তুমি ঠেলে দিচ্ছ কারাকুঠুরিতে?
কেন তাদের মুখ ঘষটে দিচ্ছ পথের ধুলায়, কাঁকরে?
কেন কণ্ঠ রোধ করতে মরীয়া হয়ে উঠেছ তাদের,
যারা নান্দীপাঠ করেছিল তোমার মুক্তির?

হে স্বদেশ, তোমাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে
জেরা করব, তেমন স্পর্ধা আমার নেই, আমার মনের ভেতর
শুধু কিছু সওয়াল ঝিকিয়ে উঠছে বিষাক্ত
চাবুকের মতো। যারা তোমাকে ভ্রূণাবস্থায়
হত্যা করতে চেয়েছিল, তোমার শ্যামল শরীরকে
অগ্নিকুণ্ডে পরিণত করেছিল, সেই দানবদের কোন্ মোহে
এগিয়ে দিচ্ছ সিংহাসনের দিকে?
কেন ক্লান্ত বাঈজির মতো ক্ষতবিক্ষত পায়ে অবিরত
ঘুঙুর বাজিয়ে নেচে চলেছ
মানবতা-বিরোধী বকধার্মিকদের উদ্ভট ইঙ্গিতে?

পাখির গান, ফুলের উন্মীলন আর
প্রেমের পদাবলি যাদের আতঙ্ক,
যাদের কপালে মুদ্রিত হিংস্রতার, পৈশাচিকতার উক্তি,
তাদের তুমি সত্যি কি চাও
তোমার ত্রিসীমানায়? যারা তোমার স্বপ্ন দেখেছে দীর্ঘকাল,
তোমার উদ্দেশে অর্পণ করেছে রক্তাঞ্জলি,
তোমার গলায় দুলিয়ে দিয়েছে জয়মাল্য শিশিরভেজা চোখে,
তারা কি পাবে তোমার উপেক্ষা আর আক্রোশ?
এই প্রশ্নের সুদত্তর তোমাকে আজ দিতেই হবে স্বদেশ।
তুমি দোদুল্যমান চিত্তে মুখ বুজে
আড়চোখে তাকাবে শুধু, তোমার এই ভঙ্গি
আমরা কস্মিনকালেও মেনে নেব না।

স্বদেশ আমার, তোমার শারদ আকাশে যখন
কাশফুলের মতো মেঘ ভেসে বেড়ায়,
তোমার আষাঢ়ে যখন ফোটে প্রথম কদম ফুল,
তোমার ফাল্গুনে যখন পলাশ ছড়ায় আবীর,
তোমার হেমন্ত গোধূলিতে যখন বাজে, গরুর গলার ঘন্টি,
যখন গাছের সবুজ পাতা থেকে ঝরে শিশির,
তখন আনন্দে আমার দু’চোখ হয় বাষ্পাকুল,
হৃদয়ে বাজতে থাকে বাউলের দোতারা।

প্রাণের স্বদেশ, আমার এই আনন্দকে তুমি
কী করে সোপর্দ করবে কসাইখানায়? পারবে কি?
আমরা যারা বিরূপ ঋতুতেও তোমার স্তব করি,
আমরা প্রতীক্ষা করছি সেই ভবিষ্যতের জন্যে,
যে বর্বরতা-বিরোধী, করুণাপ্লুত ফেরেশতার মতো অপেক্ষমান।
সঙ্কটের চূড়ায় দাঁড়িয়ে অষ্টপ্রহর
আমরা দৃষ্টি বিছিয়ে রেখেছি সে-পথে,
যেখানে দানবদের বিরুদ্ধে ঝলসে উঠবে তোমার সংহার-মূর্তি।

১৪.৬.৯৪