মাঝখানে

ভ্রাতৃত্ববোধের সল্‌তেটাকে আরো একটু
উস্‌কি দিতে মাঝে-মধ্যে
গ্রীনরোডে অনুজের বাড়ি যাই। তাছাড়া সময় তো আর
ব’সে নেই। এই যে আমি আজ আছি কি কাল নেই।

বহুদিন পর সন্ধেবেলা আমার অনুজের দোতলা বাড়ির
সিংদরজায় থমকে দাঁড়ালাম, খুব কাছেই
শেকল-বাঁধা এক অ্যালশেসিয়ান ব’সে আছে চারপাশে
আভিজাত্যের শান্ত আভা ছড়িয়ে, বনেদী
হিংস্রতাকে উদাসীন ক্যামোফ্লেজ ক’রে। গেট পেরিয়ে ভেতরে
ঢুকবো কি ঢুকবো না এই দ্বিধার
চঞ্চুতে বিদ্ধ আমার দুরু দুরু বুক। আমার ভেতরকার
দোটানা ওর নজরে পড়তেই
গা ঝাড়া দিয়ে সে উঠে দাঁড়ায় বহুজাতিক
ফার্মের ডাকসাইটে মেজো কর্তার ধরনে।
ওর চোখ দুটো দামি রত্নের মতো
ধ্বকধ্বক করছিলো জিভ উঠলো লকলকিয়ে। ওর
গর্জমান গলা বাড়ির ভেতর থেকে
টেনে আনলো
দুজন পরিচারককে। ভাগ্যিস ওরা এলো, নইলে অনুজের
অন্দর মহলে প্রবেশ করবার সাহসই হতো না।

আমার অনুজ বাড়িতে ছিলো না,
আজ দুপুরেই নাকি সে উড়োজাহাজে পাড়ি জমিয়েছে
য়ুরোপে তেজারতির কাজে। থাকলে নিশ্চয়
সেই ডাকাবুকো কুকুরটার মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে
বলতো, ‘খামোকাই ভয় পাও,
ও কেছুই করবে না, তাছাড়া বরাবরই তুমি
ভারি ভীভু, ভাইয়া। যদ্দুর জানি,
এরকম উক্তি হয় হামেশা উচ্চারিত হয় সে-সব গৃহকর্তার মুখে,
যারা কুকুর পোষেন শখ ক’রে
অথবা চোর-ডাকাতের উপদ্রব থেকে শত হন্ত দূরে থাকার জন্যে
বাড়িতে অনুজ ছিলো না, কিন্তু আমার
আস্মা ছিলেন, সবে মগরেবের নামাজ আদায়
ক’রে উঠেছেন; জায়নামাজ গোটাতে গোটাতে আমাকে
সস্নেহ আপ্যায়ন করার জন্য
ব্যস্ত হয়ে পড়লেন, ডাকলেন পরিচারিকাকে। আমি
চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিতে দিতে
আস্মাকে বল্লাম, কিছুকাল আগেও অ্যালশেসিয়ানটা
ছিলো খুবই ছোট,
অথচ এখন কেমন তাগড়া আর জবরদস্ত হয়ে উঠেছে’।
‘দু সের গোস্ত রোজ বরাদ্দ
ওর জন্যে, আরো রকমারি খাদ্য, যা-যা
উপযোগী কুকুরটার স্বাস্থ্যের পক্ষে’ আম্মা জানালেন
ঠোঁটে হাসি ছড়িয়ে। আমি একটু
অস্বস্তি বোধ করলাম, অজান্তেই উসখুস ক’রে উঠলাম।

সেই মুছুর্তে আম্মার হাসিতে তেরশো পঞ্চাশের
মন্বন্তর আর সেই অতিদূর দুপুরকে
দেখলাম, যে-দুপুরে তিনি আমাদের বাজরার রুটি
ভাগ করে দিচ্ছিলেন
এবং আমাদের বৈঠকখানার জানালায় ভেসে উঠেছিলো
এক কঙ্কালসার মানুষের
ক্ষুধার্ত দুটি চোখ। সেই হাসিতে জয়নুল আবেদীনের
ঝাঁক ঝাঁক, কাক, উজাড় ডাস্টাবিনের পাশে
শূন্য অ্যালমুনিয়মের থালা, মাটির সান্‌ কি আর
সভ্যতার দিকে পা মেলে চোখ উল্টিয়ে ফুটপাতে প’ড়ে-থাকা
অসংখ্য আদম সন্তান। আম্মার হাসিতে
পোষা পশুর প্রতি প্রশ্রয়মিশ্রিত কৌতুক, কিছুটা গর্ববোধ
নাকি চকচকে ব্লেডের মতো
শ্লেষ ছিলো, ঠিক বুঝতে পারি নি।

পাশ কাটিয়ে পেরিয়ে এলাম
আমার অনুজের বাড়ির সিংদরজা।

যখনই অনুজের বাড়িতে যাবার কথা ভাবি,
তখনই মনে প’ড়ে যায়
আমাদের স্নেহপ্রীতি, কুশল-সংলাপ আর সম্পর্কের সেতুর
মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে
শৃঙ্খলিত এক অ্যালশেসিয়ান এবং সবসময়
আমি খুব ভয়ে থাকি,
যদি কোনোদিন সে হঠাৎ তার
গলয় শেকলটা ছিঁড়ে ফ্যালে এক ঝটকায়!