মিছিল থেকে খাঁচায়

তোমাকে দেখিনি আমি কোনোদিন উদ্দাম মিছিলে,
রাজপথে তোমার দু’চোখে কৃষ্ণচূড়ার মতোন
ঝকল দেখিনি,
দেখিনি তোমার উত্তোলিত হাত রৌদ্রস্নাত হাতের বাগানে,
শুনিনি দুপুর-চেরা শ্লোগান তোমার,
অথচ একদা ছিলে মিছিলের পুরোভাগে বহুদিন, হাতে
ছিল জ্বলজ্বল ভবিষ্যতের মতো স্পন্দিত পোস্টার।

সেই তুমি যখন বিকেলে ঘাসে বসে
নিঃশব্দে চা খেতে বান্ধবীর ভিড়ে বিনম্র ছায়ায়
অথবা হাসতে মৃদু সুভাষের কবিতার বইয়ের মলাটে
তোমার কুমারী হাত বুলাতে বুলাতে
কিংবা হেঁটে যেতে (স্বপ্ন-ঝলসিত শাড়ি, শরীর শ্যামের বাঁশি)
রমনার উদাস মাঠ ঘেঁষে,
কারো কথা ভেবে ভেবে (হঠাৎ পাখির গানে থমকে দাঁড়াতে)
তখন কেউ কি, আলো? তোমার দু’চোখ
আগুনের নগ্ন গান? তোমার দু’হাত
যৌবনের সাহসের উজ্জ্বল পতাকা?

তোমার স্লোগানে পথ হয়েছে সুকান্ত কতদিন,
আসমান রাজেন্দ্রানী, পথস্থিত গাছ ব্যালেরিনা,
পথচারীদের প্রাণ বিদ্রোহীন বীণা। ভাবি আজ
চেয়ারে হেলান দিয়ে-ফ্যানের হাওয়ায় ওড়ে শাদা-কালো চুল,
এদিকে নিভৃতে জুড়োয় চা, ওল্টাই বিদেশী পত্রিকার চারু
চকচকে পাতা, ভাবি তুমি ছিলে একদা মিছিলে।
আত্মরতিপরায়ণ গাঢ় গোধূলিতে
বীয়ারের ফেনার মতোন কলোচ্ছ্বাসে নিমজ্জিত মধ্যবিত্ত কবি
মজি মেকি বুর্জোয়া বিলাসে, মাঝে-মাঝে কান পেতে
শুনি আতরাফী পদধ্বনি চতুর্দিকে। ভীষণ গাড্ডায় আমি
পড়ে গেছি ভেবে সান্ধ্য আড্ডায় নিয়ত পরিত্রাণ খুঁজি আর
বিপুল সাফল্য দেখি সেই সান্ত্রীদের যারা
মহাসমারোহে রোখে সূদ্রের বেয়াড়া অভিযান! কখনো বা
অ্যাকুরিয়ামের
রঙিন মাছের মতো আবদ্ধ পানিতে সাঁতরাতে সাঁতরাতে
গাই গান, সর্বহারদের গান মাঝে-মধ্যে ভাবি
একদা তুমিও ছিলে মিছিলের পুরোভাগে এ ক্রুদ্ধ শহরে!

এখন তো রমনায় বিলুপ্ত কৃষ্ণচূড়া, তুমিও মিছিলে নেই আর;
পুষ্পিত খাঁচায় আছো, সুবাসিত তেলের মতোন
সম্প্রতি জীবনযাত্রা। কখনো সখনো
আকাশে মেঘের বঙ্গো, অকস্মাৎ কী এক জোয়ার
খাঁচাকে দুলিয়ে দেয় উথাল পাথাল, মহাকাল শিঙা ফোঁকে
নিরন্তর, খাঁচা-উপচানো হাত সম্মুখে বাড়ানো,
চোখে কাঁপে সদ্য কৃষ্ণচূড়ার ঝলক, মাংসে ফোটে
অসংখ্য নক্ষত্র আর কণ্ঠময় কী যেন ঝংকৃত হতে চায়
বারংবার প্রহরে পহরে,
পুরোনো গানের মতো হাহাকার খাঁচার ভেতরে।
তোমার চুলের গুচ্ছ থেকে ভেসে আসে সুদূরের শস্য
ভানার সঙ্গীত,
তোমার দু’চোখ থেকে ঝরে নিরন্তর
সুদূরের ঝরণাধারা,
তোমার আঙুল থেকে চকিতে বেরিয়ে আসে এক ঝাঁক
মরমিয়া টিয়া,
তোমার গ্রীবায় চরে নিরিবিলি বুটিদার একাকী হরিণ।