নাছোড় অতিথি

বেশ কিছুদিন থেকে প্রত্যহ দেখছি পষ্ট তাকে।
আমার শোবার ঘরে শায়িত সে, স্পন্দনরহিত,
পতিত জমির মতো, যেখানে কখনো ফসলের
স্বর্ণশীষ গীতিকবিতার মতো করবে না গুঞ্জন।
কী করে এলো সে এই বেডরুমে, বলা মুশকিল।
আমার অস্বস্তি হয়ে সর্বক্ষণ আছে সে এখানে-
বড় বেশি নীল তার ঠোঁট, নাক, নখাগ্র বেবাক;
শরীরে কুঠার হানলেও নড়বে না এতটুকু।

সমস্ত শরীরে তার রাশি রাশি মাছির মতন
হিজিবিজি অক্ষরের ব্যান্ডেজ এবং হলদে কিছু
পাণ্ডুলিপি চুমু খাচ্ছে তাকে বারংবার, বুঝি তার
এমন চরম ঘুম ভাঙাতে ব্যাকুল। ঘরময়

মৃত্যুগন্ধ কর্পূরের মতো তীব্র। টেবিলে ডালিয়া,
ভাস-এ গোলাপের তোড়া; আমি ব্যাঞ্জো বাজিয়ে বাজিয়ে
নিদ্রিত মানুষটিকে বিস্মৃতির কন্দরে পাঠাতে
চাই প্রতিদিন, হায়, ব্যাঞ্জোধ্বনি, গোলাপ, ডালিয়া

থেকে মৃত্যুগন্ধ উঠে আসে। চেয়ে থাকি তার দিকে,
এই চেয়ে-থাকা যেন নিয়তি আমার। এতকাল
বলিনি কাউকে তার কথা। অতিশয় কৌতূহলী
প্রতিবেশীরাও আজও কিছুই পায়নি টের, শুধু
প্রত্যহ আমাকে দ্যাখে দূর থেকে আর কেউ কেউ
কখনো তাকায় আড়চোখে, পরস্পর কত কিছু
বলাবলি করে, চলে হাসাহাসি। আমার বিশ্বাস
সন্দেহ করে না ওরা কিছু। হয়তো ভাবে, ইদানীং

লোকটা বেজায় খাপছাড়া বটে, তা’ছাড়া মাথায়
কিছু ছিট ছিলই তো বরাবর। এটাই বাঁচোয়া।
এদিকে আমার বেডরুমে নিদ্রিত মানুষটির
পায়ে লতাগুল্ম জন্মে, শামুক বুকের শুষ্ক তটে।

কতদিন গেল কেটে, পুলিশকে দিইনি খবর-
যেন সে গোপন ব্যাধি, ভয়াবহ, কস্মিনকালেও
কাউকে যায় না বলা তার কথা। অথচ পাচ্ছি না
ভেবে কিছুতেই আজও কী করে লুকোব তাকে, কোন
পাতালে আসব রেখে। কখনো মাথার ঘাম পায়ে
ফেলে কংক্রিটের পুরু দেয়ালের অভ্যন্তরে তাকে
দুরু দুরু পুরে রাখি; যেমন এ্যালেন পো-র গল্পে
আছে, কখনোবা ব্লিচ করে হাওয়ায় মিলিয়ে দিই।

তবু সে আমার ঘরে শুয়ে থাকে সমস্ত শরীরে
ঘোর কালো নক্ষত্রের মতো অক্ষরের ভিড় নিয়ে।
তার পাশে ঠায় ব’সে থাকতে থাকতে ক্লান্ত হয়ে
কোনো কোনো স্তব্ধ মধ্যরাতে শাবল গাঁইতি হাতে

মেঝেতে সুড়ঙ্গ কেটে তাকে কাঁধে বয়ে নিয়ে যাই
সবার অলক্ষে বহুদূর একা-একা, পুঁতে আসি
মাটির অনেক নিচে। শিস্‌ দিতে দিতে ঘরে ফিরে
দেখি ঠাণ্ডা বিছানায় শায়িত সে নাছোড় অতিথি।