নিজস্ব সংবাদদাতা

আমরা ক’জন তীব্র অগ্নিকান্ত এলাম পৃথিবী ঘুরে প্রভু।
আপনি সর্বজ্ঞ জানি, তবু
দেখলাম, শিখলাম যা কিছু সেখানে খুঁটিনাটি,
প্রত্যহ শুনেছি যত অপ্রিয় বচন, কান্নাকাটি,
কলহ, বিদ্বেষ, ক্রোধ, ক্ষোভ
সবকিছু আপনাকে বলবার লোভ
সামলানো দায়।
এ সংবাদ পড়বে না জনগণ ন্যু-ইয়র্ক টাইমস্‌ কিংবা প্রাভদায়।

দীর্ঘকাল পৃথিবীতে বেড়ানোর তীব্র সাধ নিয়ে
চালিয়েছিলাম রথ দেশ-দেশান্তরে কিন্তু ইনিয়ে-বিনিয়ে
বলবো না একটানা ভ্রমণ কাহিনী, শুধু যেটুকু বলার
বলবো নির্ভয়ে প্রভু, না-ই থাক কথকী কলার
পরিচয় বিবরণে। যত দেশ আছে সব দেখেই বলছি, লোকমুখে
শুনিনি কিছুই আর গুজবেও দিইনিকো কান, যা মিথ্যুকে
সর্বত্র রটায় তার কানাকড়ি মূল্য নেই জেনে
দেখেছিতো বাস্তবের ভাঁড়ারের প্রভূত মশলা ছুঁয়ে ছেনে।
আপনার নিজস্ব সংবাদদাতা, হে বিশ্বপালক, এই আমরা ক’জন
পৃথিবীতে বহুদিন করেছি ভ্রমণ,
কখনো ভাদ্রের রৌদ্রে, কখনো বা পৌষের ধোঁয়ায় পথ হেঁটে
অনাবিল দেবদূতী পাখাগুলো ছেঁটে।
দেখেছি পেছনে ফিরে গণ্ডগ্রাম হয়েছে উজাড়
চোখের পলকে আর শহরেও মড়কের নৃত্যনাট্য দেখেছি, পূজায়
মণ্ডপ এবং শান্ত মসজিদে জ্যোৎস্না ডেকে যায় হা-হা স্বরে
শূন্যতায়, অথচ কোথাও কোনো লোক নেই ঘরে।
মধ্যরাতে আলোকিত লিফট্‌-এ বিদেশী প্রতিনিধি উঠে যান
এগারো তলায় হোটেলের। স্যুটকেশ হাতে কেউ কান্তিমান
দ্রুত হেঁটে যায়, যেন আশেপাশে ভালো করে দেখার সময়টুকু নেই,
কখনো ফেরে না আর। এ গল্পের খেই
যদি পাওয়া যেত তবে বলতাম আরো।
কখনো গলির পাশে বিশ্রামের মুহূর্তে শুনেছি কিছু গাঢ়
উচ্চারণ মানবিক উন্মাদের বাজে
বকবকানিতে মাঝে-মাঝে
অনেক গভীর সত্য হয় উচ্চারিত, পথচারী ভড়কায়।
বোঝে না আলাপ তার কেউ, তেল নেই আপাতত কল্পনার চরকায়।

রাস্তার বাঁদিকে বাড়ি, থাকে
একজন; ন্যালাক্ষ্যাপা দিব্যি বলা যায় লোকটাকে।
জেব্রার মতোই কোনো উজ্জ্বল বিকেলে কৈশোরের
রঙধনু ডাকবাক্সে রেখেছিল সে-ও ঢের
পাখির পালক আর ব্যাকুল বকুল।
সম্প্রতি সে অস্তিবাদী, গ্রন্থে ভরপুর, উসকো খুসকো চুল
প্রশস্ত কপালে লোটে। মনের বিজন পার্কে তার শীত নামে
কুয়াশার প্যারাস্যুটে ঘন ঘন, কখনো স্বপ্নের গোল থামে
জাঁহাবাজ চিল নখ আঁচড়ায়। হৃদয়ে লুকিয়ে রাখে বেদনার গ্রাম,
রেডিওর পাশে বসে সর্বদা ঘোরায় নব্‌ দিগ্ধিদিক-এটুকু বিশ্রাম
লাগে ভালো হয়তোবা। অত্যস্ত ঘরের চেয়ে বাইরের দিকে বেশি টান,
বুঝি তাই জনহীন রেস্তোরাঁর টেবিল প্রবাহে দুলে অমৃতসন্তান
প্রত্যহ কাটায় কাল। কী এক দারুণ ক্ষুধা সমস্ত শরীরে,
সন্তাপের উপাদানে মাথা রেখে দুঃস্বপ্নের তীরে
সে ঘুমায় বেঘোরে জড়িয়ে বুকে নিঃসঙ্গ আয়না। বন্ধ সব
দরজা জানালা, বিলম্বিত সূর্যোদয়-বোঝা ভার সে জীবিত নাকি শব!
আশ্চর্য শহর এক-পথেঘাটে ঈশপের প্রাণীকুল, কতিপয় লোক
নিয়ত গর্জন করে কমিটির বন্ধ ঘরে বর্জনের খোয়ারিতে, বলে লুপ্ত হোক
শিল্পের প্রদেশ। স্পষ্ট বলি, আমরা ধারিনা ধার
নাচের মুদ্রার আর বেহাগের, কাব্যের ফ্রেস্কোর, নিরঞ্জন সূক্ষ্মতার
কালজয়ী বাগানের ঘনিষ্ঠতা ছিঁড়ে খুঁড়ে ওরা পেতে চায় অধিকার
আজীবন ভাগাড়ে থাকার।
অন্য ছবি আছে আরো। রাত্রিদিন চলে বেচাকেনা
গ্রাম-গ্রামান্তের হাটে, দোকানে-দপ্তরে বাসগৃহে; থাকবে না
একরত্তি পণ্য পড়ে কোনোখানে-শহরতলীতে,
অলিতে-গলিতে।
যেখানে বসতি ঘন সেখানেই দলছুট হরিণেরা পড়ে
দালালের প্রশস্ত খপ্পরে।
কিছুটা পার্থিব ছাপ দেখুন এনেছি বয়ে আমাদের অমর শরীরে,
আর কিছুদিন নরবুদ্ধুদের ভিড়ে
ঘুরলেই সুনিশ্চিত অমরত্ব যেত উবে নারকী প্রহরে,
পচতাম পৃথিবীর কোনো জনশূন্য কোণে, অখ্যাত কবরে।
ওরা বড়ো দুঃখ পায়। চৈত্রের হাওয়ায়
গাছের হলুদ পাতা ঝরে গেলে, বিপন্ন দাওয়ায়
অবিরল জল এলে ভেঙ্গে গেলে সাঁকো কিংবা বিমান পতনে
ওরা বড়ো দুঃখ পায়। কথপোকথনে
নিয়েছি এটুকু জেনে কেউ কেউ তারা তামাশাটা বোঝে ভালো,
বোঝে ওপারের রঙ কতটুকু কালো!
তবু ওরা সব, যেন স্বপ্নচারী, হেঁটে যায় গোলক ধাঁধায়,
ঘুমের ভিতরে হু হু কেঁদে ওঠে জাগরণে পরস্পর হাসায় কাঁদায়।
বরং সহজ ক্রুশকাঠে বিদ্ধ হওয়া,
অনেক সহজ বটে রাজ্যত্যাগ, বোধিদ্রুমে সর্বমানবের দুঃখ বওয়া,
সহজ সহস্রগুণে আপনার পদসেবা, এঞ্জেলের ভূমিকা পালন।
পক্ষান্তরে পৃথিবীতে অনেক কঠিন জানি জীবন যাপন!