অন্ধ দেয়ালের সাথে

তবে কি যাইনি ভুলে? এতদিনে সব কিছু ফিকে
হয়ে গেলে, খুব শূন্য পাখির বাসার মতো মন
হয়ে গেলে খড়কুটোহীন কার কী বলার ছিল?
সুদূর সকাল ডাকে, দুপুর হাঁপায় ঘন ঘন,
বিকেল হরিণ হয়ে আসে, খুরে তার বনস্থলী,
ঝিল, দিকচিহ্ন প্রকাশিত। রাত্রি, যেন ক্লিওপেট্রা,
অঙ্গবাস খুলে ফেলে অমর আকাঙ্ক্ষাগুলি করে
উন্মোচন, বুকে ক্ষুদ্র সাপের দংশন জেগে থাকে।
করতল থেকে কত বিশ্ব নিচে ভীষণ গড়ায়,
চোখের পাতায় ব্যেপে আসে সুনসান কত যুগ।

চায়ের সময় হল, সিগারেট কই? দেশলাই
প্রতিবার অতিশয় ব্যস্ত হয়ে খুঁজতেই হয়
পকেটে টেবিলে কিংবা একান্ত দেরাজে। সিগারেটে
আগুন ধরাতে গিয়ে অকস্মাৎ কী অন্যমস্ক
হয়ে পড়ি, পুনরায় তড়িঘড়ি ফস করে কাঠি
জ্বালাই এবং দূরে তাকাই ট্যুরিস্টবৎ আর
সহসা নিজের ট্রাউজারে, দেখি লেগে আছে কিছু
চোরকাঁটা কবেকার। মায়া লাগে, সস্নেহে বুলোই
হাত সেই শুকনো নৈসর্গিক কণাগুলির ওপর।
চায়ের পেয়ালা ঠাণ্ডা, আগুনের ফুলকি শিরাপুঞ্জে।

অতীত বাড়ায় গলা হৃদয়ের ভেতরে, যেন সে
রাজহাঁস, চঞ্চু ঘষে ঊরুতে আমার, ডানা তার
কেবলি আমাকে ডাকে মোহিনী স্বপ্নের ছায়াচ্ছন্ন
সুদূর নিবাসে, রাজহাঁসের নয়ন সারাক্ষণ
নিবদ্ধ আমার দিকে, বুঝি স্পষ্ট দেখে নিতে চায়
বেলাবেলি কতটুকু আমি আছি আমার ভেতরে?
তার গীতপ্রায় গ্রীবা ছুঁয়ে বলি-পথ যত দূরে
চলে যাক, হোক দীর্ঘ দুঃস্বপ্নের রাত্রির মতন,
হোক যত ভাঙাচোরা, পথ, তবু পথ চিরদিন
আমাকে শোনাও তুমি পান্থনিবাসের কলস্বর।

এখনও বিকেলে হেঁটে যেতে যেতে কেন বারংবার
পিছনে তাকাই ফিরে? কেন মন মরুর মতন
হয়ে যায় অকস্মাৎ? আছে কি এমন কেউ যার
শরীর স্পন্দিত হচ্ছে একা ঘরে এখন আমারই
পথ চেয়ে সারাক্ষণ? নাকি অন্তর্গত দুর্বলতা
ডেকে নিয়ে যেতে চায় যাত্রার বিন্দুতে পুনরায়?
উদ্দীপনা যত টেনে নিয়ে যাক দূরে মাঝে-মাঝে
পিছনে তাকাতে হয় আর কিছু দীর্ঘশ্বাস ফেলে
প্রতিবাদহীন চলে যেতে হয়-কোথায় যে যাওয়া-
অতিক্রম করে বৃক্ষশ্রেণী, ফুটপাত, লেক, সাঁকো।

কতিপয় উপরাজ ল্যাম্পপোস্ট পেরিয়ে এই যাওয়া
স্বপ্নের ভেতরে হেঁটে যাওয়ার মতন মনে হয়-
যেন আমি বড়ো বুনো লতাগুল্মময় পৌরাণিক
সমাধি ফলক থেকে সমাধি ফলকে যাচ্ছি একা!
যে-হাত এগিয়ে আসে করমর্দনের অভিলাষে,
সে-হাত বালির তৈরি, ঝরে যায় নিঃসীম সৈকতে।
ব্যাকুল আবৃত্তি করি প্রেমকথা কর্কশ আঁধারে
আর ভাবি আছে কেউ সুনিশ্চিত সেখানে আড়ালে,
অথচ পাই না সাড়া কিছুতেই। তবে কি এভাবে
অন্ধ দেয়ালের সাথে কথা বলে যাব একা একা?