ওরা চলে যাবার পরে

এবারও আমি ওদের নিরাশ করলাম।
যখন আমার ভাই-বোনেরা বলল, ক’দিনের জন্যে
আমরা সবাই পাড়াতলী
যাচ্ছি, চলো তুমিও যাবে,
তখন আমার নীরবতায় অনিচ্ছার এক কাদাখোঁচাকে ওরা
প্রত্যক্ষ করল ওদের মুখোমুখি, এমনকি শীতবিকেলে
আম্মার কথাও সেই হতকুচ্ছিত
পাখিটাকে তাড়াতে পারল না কিছুতেই।

বছরে দু’তিনবার ওরা যায় পাড়াতলীতে, আমাদের
দেশ-বাড়িতে। সেই যে একাত্তরে তাড়া-খাওয়া পাখির মতো সেখানে
গা ঢাকা দিয়েছিলাম, তারপর থেকে
একবারও আর আমার আমাদের গ্রামে
যাওয়া হয়ে ওঠেনি। এক ধরনের অকৃতজ্ঞতাবোধ আমাকে
মাঝে-মধ্যে কামড়ে ধরে
কচ্ছপের মতো, তবু পারিবারিক আড্ডায়
পাড়াতলীর প্রসঙ্গ আমি
এড়িয়ে চলি, অথচ একটা টলটলে পুকুর, পুরোনো দালান,
আম-কাঁঠালের গাছ
সর্ষে ক্ষেতে প্রজাপতির ওড়াউড়ি, দিঘিতে
মাছের বুড়বুড়ি আর
গভীর রাতে দীর্ঘদেহী বড় চাচার জজবার আওয়াজ
আমার স্মৃতিতে হাঁসের মতো সাঁতার কাটে প্রায়শই।

সবাই গেল, শুধু আমি রয়ে গেলাম এ-শহরে।
অল্প-স্বল্প নিয়ে থাকা এই আমির
সময় কাটে ক’জন সহকর্মীর সঙ্গে গল্প করে,
ঔপন্যাসিক বন্ধুর সহৃদয়
বাসায় রবীন্দ্রনাথের আসা-যাওয়ার পথের ধারে
কিংবা বিলায়েত খানের
সেতারে ইমন শুনে, তরুণ বৃদ্ধিজীবীদের আস্তানায়,
মধ্যরাত অব্দি বই পড়ে।

ওদের যাবার তিনদিন পর
এক রাতে মনের চোখে দেখি-
পাড়াতলীতে আমাদের পুরোনো দালানের টানা বারান্দায়
সবাই গল্প-গুজব করছে, এলেবেলে বাগান থেকে
ভেসে আসছে হাস্নাহেনার ঘ্রাণ। ট্রানজিস্টারে বাজছে
রক্তে দোলা-জাগানো পপ গান।
আমার দাদাজান, যাঁকে আমি কখনো দেখিনি, দাদী, নানা ভাই, আব্বা, বড় চাচা,
মাস্টার চাচা, মোমেনা খালা আর আমার তেরো
বছরের ছেলে কবর ফুঁড়ে
একে-একে উঠে দাঁড়িয়েছে সবাই, যেন ইস্রাফিলের
শিঙ্গা শুনে। আরবি-ফার্সি জানা দাদাজান সটান হেঁটে চলে গেলেন
মসজিদের ভেতরে, বড় চাচা তার জজবার আসরে,
মাস্টার চাচা অন্ধকার ঘরে
হাতড়ে বেড়াচ্ছেন নেস্‌ফিল্ডের গ্রামার,
নানা ভাই কালো আচকানটার বোতাম লাগাতে লাগাতে
ডাকছেন আমার নানিকে,
মোমেনা খালা দীর্ঘ চুলে চালাচ্ছেন চিরুনি
আর আমার ছেলে পুকুর পাড়ে
বসে আছে একলা, ওর মুখে অভিমানের থম-ধরা
একটুকরো মেঘ আর আব্বা ট্রানজিস্টারের
পপ গান থামিয়ে
গমগমে গলায় আম্মাকে বললেন,-
‘কই তোমার ছেলে এখনও বাড়ি ফিরল না,
যেমন বলতেন ছত্রিশ বছর আগে,
যখন আমি এক অচিকিৎস্য উড়নচণ্ডী, ঢাকা শহরের
পথে পথে ঘুরে বেড়াচ্ছি, আওড়াচ্ছি কবিতার পঙ্‌ক্তি
এবং ভাবছি কোনো এক গলির দোতলার ঘর-আলো-করা
তরুণীর কথা অনেক রাত অব্দি।
চেয়ারে বসেছিলাম আমি, আমার হাত থেকে অকস্মাৎ
খসে পড়ল কলিন উইলসনের
দ্য অকাল্ট, আর আমার বুকের ভেতরে
কে যেন আমার কোনো দূর পূর্বপুরুষের
মতো আর্তকণ্ঠে বলে উঠল,
‘সময় হলেই, আপনি না ডাকলেও আমি বাড়ি ফিরব আব্বা’।