পৌঁছে দিচ্ছি

গ্রীষ্মের বিকেলে বেশ কিছুক্ষণ ধ’রে
একজন বুড়ো, শীর্ণকায়, ছিলেন নিঃসঙ্গ ব’সে চুপচাপ
পার্কের বেঞ্চিতে। কিছু গুঢ়
কথা তাঁর মনে
বুড়বুড়ি কাটছিলো হয়তো; তাঁর হাতে
খাবারের ঠোঙা, ধুর্ত কাক হঠাৎ ছোঁ মেরে নিয়ে
যায় শুক্‌নো রুটি। বৃদ্ধ যেন কোনোকালে
শেখেননি বাধা দিতে, এরকম অসহায় রইলেনু ব’সে
নিজের জায়গায়। রঙচটা লাঠি পাশে ছিলো থিতু
দরিদ্রের নির্ভরের মতো।

স্মৃতির পায়রাগুলো তাঁর
সত্তার কার্ণিশে গম খুঁটে খায়। কখনো কি তিনি
কারো ভালোবাসা চেয়ে ব্যর্থতার
কাঁটার মুকুট প’রে পথভ্রষ্ট একাকী পথিক
ঘুরেছেন বিরান প্রান্তরে? তখন কি দোয়েলী শিসের চেয়ে
কুকুরের ডাক
অধিক মধুর মনে হয়েছিলো তাঁর? নাকি তিনি
নিজেই কাউকে ছলনার জালে জড়িয়েছিলেন নির্বিকার?
হঠাৎ দুরস্ত একদল বালকের কোলাহল
কানে আসে; দেখি ওরা বুড়ো লোকটার খাবারের
ঠোঙা নিয়ে করে লোফালুফি। একজন
হাতে তুলে নেয় লাঠি, কেউ কেউ খোঁচায় বৃদ্ধকে,
কেউবা ঈষৎ সুড়সুড়ি দিয়ে হো হো হেসে ওঠে,
লাঠির উদ্দেশে বৃদ্ধ আশপাশে হাতড়ে বেড়ান
উদ্বেগতাড়িত; আমি প্রায়
দৌড়ে যাই, শাসাই বালকদের আর
দেখি সে বুড়োর চোখ দুটো অন্ধত্বের গাঢ়তম ছায়াময়।
দৃষ্টিহীন চোখে তাঁর, মনে হলো, সুদূর কালের
বিষণ্ণতা জড়ো হয়ে আছে
কী নিথর! ট্রাউজারে পেশাবের দাগ, বুড়োদের
যে রকম হয়ে থাকে; কয়েকটি ক্ষয়া
ফলের বীচির মতো দাঁত মাড়িতে আটকে আছে,
মুখের দু’কর বেয়ে লালা, বোবা আর্তনাদ ঝরে,
বাতিল সারিন্দা তাঁর আস্তিত্বের ভার।

আমার হাতের স্পর্শ পেয়ে
বেশ বিচলিত আর ঈষৎ বিব্রত উঠে দাঁড়ালেন তিনি,
লাঠিটা কুড়িয়ে ঘাস থেকে
দিলাম বিশীর্ণ কম্পমান হাতে। বালকেরা দূরে
চলে গেলে প্রশ্ন করি, ‘কোথায় যাবেন?
কোন্‌ দিকে?’ বল্লেন, ‘এই তো
সামনের রাস্তাটা যদি পার হতে পারি, তাহলেই
আস্তে সুস্তে পৌঁছে যাবো গন্তব্যে আমার। সম্ভ্রমকে
তাঁর হাতে সহজে সোর্পদ ক’রে কিয়দ্দূর হেঁটে
যেতে যেতে ভাবি, যেন
রোদপোড়া বৃষ্টি ভেজা জীর্ণ জুতো-পরা এই আমি
নিজেকেই সন্তর্পণে পৌঁছে দিচ্ছি কে জানে কোথায়!