সেই ঘোড়াটা

আস্তাবলে ফিকে অন্ধকার, ঝুলছে নিষ্কম্প স্তব্ধতা,
আর সেই বেতো ঘোড়াটা অনেকক্ষণ থেকে ঝিমোচ্ছে
নিঃশব্দে কোনো আফিমখোরের মতো, মাঝে-মাঝে শুধু
ফোলা-পা নাড়ছে ঘাড় ঝাঁকিয়ে।

আস্তাবলে ধারে নোংরা নর্দমা, তার পিছল জলে
একটা থ্যাঁতলানো ইঁদুর ক্রমাগত ধুয়ে-ধুয়ে
রূপান্তরিত বিলীয়মান সমাতন স্বপ্ন-স্মৃতি যেন
মঞ্জরিত ওর বিকল্প অস্তিত্বে।

বিশাল আকাশে ফুটেছে পারিজাতের মতো চাঁদ,
হলদে খড়ের শয্যায় বুড়ো সহিস ঘুমিয়ে আছে সেখানে
ক্লান্ত দেহে, নিঃসন্তান, বিপত্নীক-নিদ্রিত
কাঠের নকশা যেন অবিকল।

ঘোড়াটাও ঝিমোচ্ছে, কিন্তু তার ক্ষত-নিঃসৃত মদিরা
মাতালের মতো অধীর আগ্রহে বুঁদ হয়ে পান করছে তিনজন মাছি;
এক কোণে নিস্তেজ কুপিটা কোনো প্রেমিকের বিলুপ্ত প্রেমের মতো
জ্বলছে এক বিষণ্ণ আচ্ছন্নতায়।

এই তো এখানে নর্দমার ধারে কিছুক্ষণ আগে কয়েকজন প্রৌঢ়
মাটির ভাঁড়ে ঢক্‌ ঢক্‌ শব্দ করে গিলেছে তাড়ি,
সব অনুতাপ হাওয়ায় উড়িয়ে, জ্যোৎস্নায় ভেজা ঠোঁটে
পান করেছে পূর্বপুরুষের স্মৃতি-বিষ!

আর রাত্রির তারাময় আঁধারে তারা হাতের মুঠোয়
কামনা করেছে অপ্সরীর স্তন, তারপর বিষাক্ত কোনো বাষ্পে
স্ফীত হয়ে ট’লে-ট’লে চলে গেছে যে যার গণিকার ঘরে।
এখন এখানে শূন্যতার ভার।

আস্তাবলে সেই বেতো ঘোড়াটা নিমেষে
তন্দ্রার ঘোর কাটিয়ে উঠল, আশ্চর্য এক ফুল হয়ে
জন্ম নিল তার ইচ্ছা, শিরায় শিরায়
সঞ্চারিত হল সে ফুলের সৌরভ।

চকিতে নোংরা নর্দমা হয়ে ওঠে অপরূপ সরোবর,
খড়কুটো, ছেঁড়া ন্যাকড়া থ্যাঁতলানো ইঁদুর, ফুলের তোড়া মণিরত্ন হয়ে
ঝলসে ওঠে ওর চোখে, আর সে নিজে উড়ে গেল
মেঘপুঞ্জে, নক্ষত্রগুচ্ছে, শূন্যের নীলিমায়।

মুহূর্তে মুছে গেল সময়ের সব ব্যবধান,
মেঘের বৈভবে সে ফিরে পেল তার অবলুপ্ত কান্তি,
আর ভেসে চলল আকাশ থেকে আকাশে অকান্ত গতিতে
কবির মতো নিঃশঙ্ক, সহজ একা।।