শব্দের মৃগতৃষা

‘মেয়েরা উঠলে ছাদে অতি দ্রুত সূর্য ডুবে যায়,
চাঁদ ওঠে
ওদের স্তনের মতো সাবলীলভাবে’-
এটুকু লিখেই থামলেই তিনি। বাক্যটি লেখা হয়ে
যাবার পর শব্দ সমুদয় থেকে অনেকদিন
তোরঙ্গে রাখা কাপড় চোপড়ের
ভাঁজ খোলাকালীন যে গন্ধ বিস্ফারিত হয়,
সেরকম গন্ধ নাকে লাগল তাঁর।
প্রতিটি শব্দ শুঁকলেন তিনি
অপরাধী অনুসন্ধানকারী
কুকুরের মতো, শুঁকলেন বারংবার; বিরক্তি
বোলতা হয়ে ঘুরতে থাকে
নাকের ডগায়, ঘন ভুরুতে। তিন-পংক্তি-সম্বলিত
কাগজটা দলা পাকিয়ে,
কাঁচাপাকা চুলঅলা মাথাটা ঝাঁকিয়ে, প্রৌঢ় কবি
ফেলে দিলেন বাজে কাগজের ঝুড়িতে, যেমন
ভোরবেলা নাশতা খাবার সময়
মাঝে মধ্যে পাউরুটির শক্ত অংশগুলি
ছুঁড়ে দেন চড়ুই কিংবা কবুতরের প্রতি।
কবুতরের চোখের রঙের মতো দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে
কবি খুঁজতে শুরু করলেন
সে সব শব্দের পাছা আর দ্রোহী স্তন,
যারা দপ্‌ দপ করবে তাঁর কপালের রগে,
ঠোঁটে। শব্দের মৃগতৃষা তাঁকে
ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ক্লান্ত করলো; কলমের খাপ
একহাতে আর অন্যহাতে কলম নিয়ে
বসে থাকতে হলো তাঁকে
ঘন্টার পর ঘন্টা। তাঁর অধিকারে এলো না
সেই কাঙ্ক্ষিত জমি,
যার ওপর দিয়ে রাজেন্দ্রানীর মতো হেঁটে যাবে সৌন্দর্য।
গায়ে পাঞ্জাবি চাপিয়ে
তিনি বেরিয়ে পড়লেন রাস্তায়, বিন্দুমাত্র
আমলে আনলেন না গ্রীষ্মের চড়া রোদ,
ঘুরলেন অলিতে গলিতে,
ঘামে ভিজে উঠলো পাঞ্জাবি, গেঞ্জি আর
আন্ডারওয়ার; অথচ ভ্রুক্ষেপ নেই তাঁর।

দুপুরে চাইনীজ রেস্তোরাঁয় কাটল কিছুক্ষণ,
নিকেলে বন্ধুর ডেরায় আর
প্রচুর মদ খেয়ে যখন বাসায় ফিরে কড়া নাড়লেন
তখন মধ্যরাত নিজেই টঙ হয়ে আছে
গাঁজা-খাওয়া সন্ন্যাসীর মতো।
বিছানায় গা এলিয়ে দিলেন কবি,
চপ্‌পল খসে পড়ল পা থেকে এবং তিনি
দেখতে পেলেন
টেবিলে-রাখা গোলাপটিকে, যার রঙ এখন
খাসির কলজের মতো।
ঢুলু ঢুলু চোখে তিনি দেখলেন একটা বুনো ঘোড়া ওর তরঙ্গিত
কেশর দিয়ে আদর করছে পূর্ণিমা চাঁদকে,
সে যেন চাঁদ আর আকাশের
ভারসাম্য রক্ষার জন্যে বড় যত্নপরায়ণ। পবর্তপ্রমাণ
তুষারস্তূপে রবীন্দ্রনাথের মুখ
আবিষ্কার ক’রে গুনগুনিয়ে
ওঠেন তিনি, তারপর ঘুম ওকে মুকুট পরিয়ে
নিয়ে যায় নক্ষত্র সভায়।

ভোর জাগিয়ে তোলে কবিকে, যেন
এক্ষুনি ঘটবে কবিতার উন্মোচন; ধড়ফড়িয়ে উঠে
তিনি বসলেন লেখার টেবিলে,
কিন্তু চতুর্দিকে ব্যেপে এলো এমন এক স্তব্ধতা
যার পবিত্রতা হরণ করার জন্যে সেই মুহূর্তে
কোনো আগ্রহের দীপ আর জ্বলে উঠল না তার হৃদয়ে।