শুচি হয়

কখনো দূর থেকে কখনো খুব কাছে থেকে
আমাকে আমার কবিতা সঙ্গ দ্যায়। অপরূপ গোসলের
পানি শীতল ধারায় ধুঁইয়ে দ্যায়
দেহমনের ক্লেদ নীল পদ্ম হয়ে ফুটি। আমার এই
জন্মান্তরকে কেমন করে নিরাপদে
রোদ বৃষ্টি অথবা আগুনের ভেতর দিয়ে নিয়ে যাব?

আজ মধ্যরাতে, চাঁদ যখন নির্বাসনে
তারামণ্ডলী গা ঢাকা দিয়েছে বামপন্থী রাজনৈতিক
কর্মীদের মতো, যখন স্বৈরাচারীরা
ষড়যন্ত্রের নীলনকশা তৈরি করে কিংবা নাক ডেকে ঘুমায়,
তখন আমি মনস্থির করে ফেলেছি
আমার কবিতা বিষয়ে। এতকাল
যে ধারণার সঙ্গে লদকা লদকি করেছি অষ্টপ্রহর,
তাকে অন্ধকার স্রোতে বন্যা উপদ্রুত এলাকার,
লাশের মতো ভাসিয়ে দিতে
এতটুকু দ্বিধা করিনি।

আমার কবিতায় থাকবে না সেই ভঙ্গি, যা
ভড়কে দেখে পাঠককে, যার ধাক্কায় পা হড়কে পড়বে
কবিযশঃ প্রার্থীরা কিংবা যার মর্মোদ্ধার
করার প্রাণান্তকর, চেষ্টা হোঁৎকা সমালোচকগণ
শেষটায় মাথা চুলকোতে চুলকোতে
ঘা করে ফেলবেন এবং এমন এক জগাখিচুড়ি, ফিসফিসে
থিসিস দাঁড় করাবেন,
যারা মাথামুণ্ড তারা নিজেরাও বুঝতে পারবেন না।
আমার কবিতার ভাষা কস্মিনকালেও
বিজ্ঞাপনের ন্যাকা বুলির মতো হবে না, এমন শব্দাবলী
তাতে থাকবে না যাতে বারবার তাক থেকে
নামাতে হয় স্ফীতোদর অভিধান। আমার কবিতার ভাষায়
বেজে উঠবে দিনানুদৈনিক
জীবনযাপনের ছন্দ। আমার কবিতা অশালীন।
চলচ্চিত্রের নায়িকার কোমর আর নিতম্বের দুলুনি
অথবা লম্বা ঘোমটার নিচে খ্যামটা নাচ
কিংবা কালো বোরখা ঢাকা জবুথবু ঢঙের বিরোধী,
আমার কবিতা সবে কামরুল হাসানের সেই
তন্বীর মতো যে ঢেঁকিতে ধান কোটে,
গভীর ইঁদারা থেকে শক্ত হাতে রশি টেনে
বালতি ভরা পানি তোলে গ্রীষ্মের দুপুরে
হাড়-কাঁপানো শীতের সকালে।

আমার কবিতা, আমি ঘোষণা করছি,
কখনো স্বৈরাচারী শাসক, নষ্ট মন্ত্রী, ভ্রষ্ট রাজনীতিবিদ,
কালোবাজারি আর চোরাচালানিদের
সঙ্গে ফুলের তোড়া সাজানো এক টেবিলে ডিনার খেতে
প্রবল অনাগ্রহী, বরং গরিব গেরস্তের ঘরে
ভাগ করে খাবে চিড়ে গুড়। জেনে রাখুন
আমার কবিতা পুলিশের লাঠি আর
বন্দুকের উদ্যত নল দেখে দেবে না চম্পট।
আমার কবিতা নয় গালে ঘাড়ে পাউডার-বুলানো
বিদূষক কিংবা বিশুদ্ধ গোলাপি আমেজে মশগুল
বুলবুলের সুরমুগ্ধ ফুলবাবু,
আমার কবিতা জয়নুল আবেদিনের গুণ টানা মাঝি।
যার বেঁকে যাওয়া পিঠে ছড়িয়ে পড়ে
ঘামমুক্তো আর সূর্যাস্তের রঙ।

আমার কবিতা গণঅভ্যুত্থানের চূড়ায় নূহের
দীপ্তিমান জলযান, আমার কবিতা বলিভিয়ার জঙ্গলে
চেগুয়েভেরার বয়ে যাওয়া
রক্তের চিহ্ন গায়ে নিয়ে হেঁটে যায় মাথা উঁচিয়ে
যারা ডুগডুগি বাজিয়ে
যখন ইচ্ছে গণতন্ত্রকে বাঁদর-নাচ নাচায়
তাদের পাকা ধানে মই দ্যায় আবার কবিতা ফুঃ বলে
উড়িয়ে দ্যায় দুর্দশার মুষলপর্ব।
আমার কবিতা নাজিম হিকমতের মতো জেলের নীরন্ধ্র
কুঠরীতে বসে মুক্তির অক্ষরে লেখে আত্মজীবনী।

আমার কবিতা বেঈমান অন্ধকারের বুকে ঈগলের মতো
নখর আর চঞ্চু বসিয়ে ঠুকরে ঠুকরে
বের করে আনে ফিনকি-দেয়া আলো এবং
সেই আলোর ঝরনাধারায় শুচি, হয় শুচি হয়, শুচি হয়।