তোমার জন্যে মশাল

যখন তুমি যাত্রা করেছিলে, তখন কী খেয়ালে
একটি নৌকাও তীরে বেঁধে রাখোনি,
বরং পুড়িয়ে এসেছিলে প্রতিটি নৌকা।

এখন তুমি ফিরে যেতে চাও,
অথচ তোমার সামনে খল খল করছে
বিপুল জলরাশি। কী করে তুমি পার হবে মারমুখী নদী?

তুমি নও কোনো গ্রিকদেবতা, অথবা সিক্স মিলিয়ন ডলার ম্যান,
বিদ্যাসাগরও নও যে ঝড়ের রাতে
উত্তাল তরঙ্গমালা উপেক্ষা করে সাঁতরাতে সাঁতরাতে সকালবেলা
পৌঁছে যাবে নিরাপদ তীরে।

তুমি খুব সাধারণ একজন মানুষ,
ঘড়ি ন’বার বাঁশি বাজাবার আগেই পড়ি কি মরি রাধার মতো
ব্যাকুলতায় তড়িগড়ি তুমি ছোটো, ছোটো, ছোটো
সেই বিরাট দালানের দিকে, যেখানে
তুলি লেখো খাতা। কাজের ফাঁকে খবর কাগজের
পাতা ওল্টাও, ব্যাপক খরার কথা ভাবো, কখনো সখনো
ঝিমোতে ঝিমোতে ছড়া কাটো আবোল তাবোল,
ছেলেবেলার ছড়া,
তকরার করো তোমারই-মতো আরেকজনের সঙ্গে কোনো কোনো
পরাশক্তির পক্ষে অথবা বিপক্ষে আদার ব্যাপারীর ধরনে;
তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে
মাথা গুঁজে খাতা লিখতে থাকো,
যতক্ষণ না ছুটির বাঁশি বাজে তোমার বুকের ভেতর!

কেরানী স্রোতে গা ভাসিয়ে হঠাৎ তোমার হয়তো।
মনে পড়ে যায় সেই নিঝুম মন-কেমন-করা
ঝোপের কথা, যেখানে একদা, হায়রে একদা
তোমার বুকের মধ্যে ফুটেছিল ভালোবাসার
প্রথম বকুল। হঠাৎ তুমি দুত্তোর বলে ছুটে যাও
ঠাঁই নেই বাসের দিকে।
প্রায় শূন্য ট্যাঁকে ভাবো ক্লান্ত মনে
সেই যে আছে না বিপুল সুদুর আন্তর্জাতিক
অর্থভাণ্ড, তার কানা উপচে-পড়া প্রসাদকণা কখন আবার
ঝলমলিয়ে উঠবে তোমার হাতের তালুতে।

তুমি খুবই সাধারণ একজন মানুষ, পালকছাঁটা শীর্ণ
পাখির মতো, পায়ে জীর্ণ জুতো, বয়েসী পাঞ্জাবি
যাই যাই করছে সারাক্ষণ, বস্তুত তুমি
ছা-পোষা; ফলের পুরনো খোসার মতো
অস্তিত্ব নিয়ে বিব্রত প্রায় অষ্টপ্রহর, আপাতত তৃতীয় বিশ্বদরদী
দাতা, বিশ্বত্রাতা ম্যাকনামারা তোমার স্বপ্নের চাতালে
(ভিয়েতনামে তাঁর দয়ার কথা কিংবদন্তী হয়ে আছে আজো)
মুঠো মুঠো মোহরের মতো ডলার ছড়ালেও,
পরাবাস্তবের ঈগল হয়ে তিনি উড়ে যাবেন
দূর নীলিমায়, তোমার দিকে ফিরে তাকিয়ে
সমস্ত নষ্ট করবার মতো সময় তাঁর নেই।
তুমি খুবই সাধারণ একজন মানুষ।

কখনো আশার রৌদ্রে, ঝলসে উঠে, কখনো
নৈরাশ্যে স্নান করে আখেরে কী জানলে তুমি?
সন্ধ্যা নামলে প্রতিদিন গেরস্ত তার নিজের ঘরে
ফিরে যেতে চায়। বারান্দায় শিশুর দৌড় হুটোপুটি,
রান্নাঘরে গৃহিণীর খুচরো ব্যস্ততা, অথবা
পুরনো আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে তার চুল বাঁধা
ইত্যাদি দেখার আশায় বড় সাধ করে
বাসায় ফিরে আসে একাকী মানুষ, ভাড়াটে ক্লান্ত
শরীরটাকে টানতে টানতে। এভাবে, এভাবেই চলতে থাকে
কিছুকাল, তারপর একদিন অনেকের কাঁধে চেপে
রাজার মতো বড় উদাসীন মৃগয়াযাত্রা অনন্তের অরণ্যে।
ইন্নালিল্লাহে ওয়াইন্নাইলায়হে রাজেউন,
ইন্নালিল্লাহে ওয়াইন্নাইলায়হে রাজেউন,
ইন্নালিল্লাহে ওয়াইন্নাইলায়হে রাজেউন

যখন তোমার যাত্রা হলো শুরু তখন তুমি একটি নৌকাও
তীরে বেঁধে রাখোনি,
বরং পুঁড়িয়ে এসেছিলে প্রতিটি নৌকা।

তোমার সামনে এখন দিগন্ত-ডোবানো উত্তাল তরঙ্গমালা।
যত হিংস্রই হোক এই খলখলে জল,
হোক যত অন্তহীন, পার তোমাকে হতেই হবে।
বড় বেশি দেরি হয়ে যাচ্ছে। ঝাঁপিয়ে পড় অভীক,
ঐ তো দূরে কে হাতে ধরে আছে তার লকলকে মশাল।