আশা-নিরাশার দোলায় বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক

সম্প্রতি সরকারের একজন নীতিনির্ধারক আলাপকালে বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্ক অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে ভালো দাবি করলেও বর্তমান সরকারের মেয়াদে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি হওয়ার ব্যাপারে সংশয় প্রকাশ করেছেন। তবে তিনি সীমান্ত বিরোধ নিষ্পত্তির বিষয়ে দিল্লির ইউপিএ সরকার সিদ্ধান্ত নিতে পারবে বলে আশাবাদী। তাঁর দাবি, জুলাইয়ে আহূত লোকসভার বাদল অধিবেশনে চুক্তিটি অনুমোদন পেতে পারে। প্রশ্ন করেছিলাম, নয়াদিল্লিতে মনমোহন সিং সরকারের যে টালমাটাল অবস্থা, তাতে কি চুক্তি পাস হওয়ার আদৌ সম্ভাবনা আছে বলে তিনি মনে করেন? জবাবে এই নীতিনির্ধারক বললেন, ইউপিএ সরকার যেমন বিরোধী দলের সহায়তা চেয়েছে, তেমনি আমরাও কূটনৈতিক চ্যানেলে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি এবং তারা কথা দিয়েছে, এটিকে অভ্যন্তরীণ রাজনীতির বিষয় করবেন না।

এর কয়েক দিন আগে বাংলাদেশে দায়িত্বরত ভারতের একজন জ্যেষ্ঠ কূটনীতিকের সঙ্গে কথা বলছিলাম তিস্তার পানি বণ্টন ও সীমান্ত চুক্তির ভবিষ্যৎ নিয়ে। তিনি বললেন, ইউপিএ সরকারের বর্তমান মেয়াদে তিস্তার ব্যাপারে একটি সমাধান হয়তো হয়ে যাবে। কিন্তু সীমান্ত চুক্তিটি অনুমোদনের নিশ্চয়তা দেওয়া যাচ্ছে না এ কারণে যে পার্লামেন্টে তাদের যথেষ্ট সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেই। যেখানে বিরোধী দল বিভিন্ন অভ্যন্তরীণ বিষয়ে সরকারের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে, সেখানে এ ধরনের চুক্তি অনুমোদনের সম্ভাবনা কম। তবে আগামী বাদল অধিবেশনে সরকার চুক্তিটি উত্থাপনের চেষ্টা করবে বলে তিনি জানান। লোকসভার গত অধিবেশনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী সালমান খুরশিদ চুক্তিটি পেশ করার চেষ্টা করেছিলেন। বিরোধী দলের অসহযোগিতার কারণে সেটি সম্ভব হয়নি। দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত দুই মন্ত্রীর পদত্যাগের দাবিতে তারা অধিবেশন বর্জন করে। মনমোহন সিং শেষ পর্যন্ত সেই দুই মন্ত্রীকে বাদ দিয়ে মন্ত্রিসভা পুনর্গঠন করতে বাধ্য হন।

এর পরই পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রতিনিধি পাঠাতে অস্বীকৃতি জানানোয় ঢাকায় আহূত যৌথ নদী কমিশনের বৈঠকটি স্থগিত করা হলো। ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে মনমোহন সিংয়ের বাংলাদেশ সফরের সময়ও মমতা একই নীতি অনুসরণ করেছিলেন। তখন তিনি কেন্দ্রে ইউপিএ সরকারের শরিক, এখন দলছুট। কংগ্রেস ও বিজেপির বাইরে তৃতীয় ফ্রন্ট খুলতে চাইছেন।

এই দুই ঘটনা থেকে আমরা কি উপসংহারে আসতে পারি?

ইউপিএ সরকারের বর্তমান মেয়াদে বাংলাদেশ ও ভারতের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কোন্নয়নের বড় বাধা তিস্তার পানি বণ্টন ও সীমান্ত বিরোধ নিষ্পত্তি সম্ভবত হচ্ছে না। নির্বাচনের পর দুই দেশেই বা বাংলাদেশ ও ভারতের যেকোনো একটিতে ক্ষমতার পালাবদল ঘটলে সম্পর্কের হিসাব-নিকাশ পাল্টে যেতে পারে। তখন কি তিস্তা ও সীমান্ত বিরোধ নিষ্পত্তি আবার শুরু করতে হবে?

শেখ হাসিনার সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর ভারতের সঙ্গে অমীমাংসিত সমস্যাগুলো সমাধানের ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব দিলেও সাড়ে চার বছর পরও তা যৌক্তিক পরিণতি পায়নি। এসব ক্ষেত্রে বাংলাদেশ কোনো পর্যায়ে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। জাতীয় সংসদে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ তথা মহাজোটের আসনসংখ্যা তিন-চতুর্থাংশের বেশি। বিরোধী দলকে তোয়াক্কা না করেই তারা দেশি-বিদেশি সব ব্যাপারে এককভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এটিই হয়তো বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি। কিন্তু ইউপিএ সরকারের অবস্থা ক্রমেই নাজুক হয়ে পড়ায় ভারত তিস্তার পানি বণ্টন ও সীমান্ত চুক্তির ব্যাপারে বারবার আশ্বাস দিয়েও তা কার্যকর করতে পারছে না।

ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী গত ফেব্রুয়ারিতে ঢাকায় এসে তিস্তার পানি বণ্টন ও সীমান্ত বিরোধ সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে বলে বাংলাদেশকে আশ্বস্ত করেছিলেন। লোকসভার বিগত বাজেট অধিবেশনে সীমান্ত বিরোধ নিষ্পত্তি চুক্তি অনুমোদনের কথা থাকলেও বিরোধী দলের প্রবল আপত্তির মুখে পররাষ্ট্রমন্ত্রী সংসদে উপস্থাপনই করতে পারেননি। ইউপিএ সরকারের নীতিনির্ধারকেরা এখনো আশা করছেন, আগামী অধিবেশনে চুক্তিটি পেশ করা যাবে। কিন্তু পেশ করলেই যে অনুমোদন পাওয়া যাবে, সেই নিশ্চয়তা নেই। এটি পাস হতে লোকসভা ও রাজ্যসভার দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের সমর্থন প্রয়োজন হবে। প্রধান বিরোধী দল বিজেপি সমর্থন জানালেও বাদ সাধবেন মমতা। তিনি ইউপিএ সরকারের পতন ঘটাতে চান।

২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের বাংলাদেশ সফরের সময়ই তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি সই হওয়ার কথা ছিল। নয়াদিল্লির প্রস্তুতিও ছিল। এমনকি ঢাকায় আসার আগে প্রধানমন্ত্রী বিরোধীদলীয় নেত্রী সুষমা স্বরাজের সঙ্গে সলাপরামর্শও করেছিলেন; বৃহত্তর স্বার্থে বিজেপি তিস্তার পানি বণ্টনের ব্যাপারে সম্মতি দিলেও বেঁকে বসেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এমনকি তিনি প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গীদের থেকে নিজের নামও প্রত্যাহার করে নেন। ফলে মনমোহন সিংয়ের বহুল আলোচিত সফর দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে নতুন দিক রচনা করতে ব্যর্থ হয়।

ভারতের আগামী নির্বাচনের তারিখ যত ঘনিয়ে আসছে, দিল্লিতে মনমোহন সিং সরকারের অবস্থান নড়বড়ে হয়ে পড়ছে। যদিও নরেন্দ্র মোদি ইস্যুতে বিরোধী শিবিরেও এখন ভাঙনের পালা। জোটবহির্ভূত শক্তির জোরে টিকে থাকা ইউপিএ সরকারের পক্ষে ঝুঁকিপূর্ণ কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব হবে না বলেই কূটনৈতিক মহলের ধারণা। কয়েক মাস আগে বিজেপির প্রধান রাজনাথ সিং প্রধানমন্ত্রীকে এই বলে আশ্বাস দিয়েছিলেন, বাংলা সীমান্ত বিরোধ নিষ্পত্তি চুক্তি সংসদে পেশ করা হলে তাঁরা আপত্তি করবেন না। কিন্তু এখন যেখানে তাঁরা সরকারেরই পতন ঘটাতে চাইছে, সেখানে এ ধরনের চুক্তির অনুমোদনের নিশ্চয়তা নেই। সাধারণ বিল একক সংখ্যাগরিষ্ঠতায় অনুমোদন পেলেও সীমান্ত চুক্তির মতো আইনে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার প্রয়োজন হবে। তিস্তার ব্যাপারে মমতা একমাত্র বাধা হলেও সীমান্ত চুক্তি নিয়ে আপত্তি তুলেছে আসাম গণপরিষদও। তাহলে বাংলাদেশের স্বার্থ কি ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির টানাপোড়েন এবং কেন্দ্র ও রাজ্যের বিরোধের কাছে জিম্মি হয়ে থাকবে?

ঢাকার কূটনৈতিক মহল মনে করে, বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে ভারতের যে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা ছিল, তার প্রায় সবটাই শেখ হাসিনার সরকার নিরসনের চেষ্টা করেছে এবং নয়াদিল্লি তার সুফলও পেয়েছে। বাংলাদেশ কেবল তার ভূখণ্ডের ভেতরে জঙ্গি গোষ্ঠীকে শক্ত হাতে দমন করেনি, এখানে অবস্থিত ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী ঘাঁটিগুলোও নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে। একদা ভারতের কাছে ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’ ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত উলফা নেতা অনুপ চেটিয়া, যিনি বর্তমানে বাংলাদেশের কারাগারে বন্দী- এখন দেশে ফিরে যেতে চাইছেন। কয়েক বছর আগেও তিনি রাজনৈতিক আশ্রয়ের জন্য আবেদন জানিয়েছিলেন। এই পরিবেশ তৈরির কৃতিত্ব শেখ হাসিনার সরকার দাবি করতেই পারে।

উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ভারতীয় পণ্য পরিবহনে ট্রানজিট চুক্তিতে সই না করলেও বিকল্প উপায়ে সেখানে পণ্য সরবরাহ বাড়ানো হয়েছে। এই লক্ষ্যে আশুগঞ্জ বন্দরকে পোর্ট অব কল ঘোষণা করে সেখানে অবকাঠামো নির্মাণ করা হচ্ছে, আগরতলা-আখাউড়া রেলওয়ে চালুর বিষয়টিও বাস্তবায়নাধীন; নৌ ট্রানজিটের সুযোগ-সুবিধা সম্প্রসারিত করা হয়েছে। বর্ষা মৌসুমে পরিবহন সমস্যার কারণে বাংলাদেশ নিজের ভূখণ্ডের ওপর দিয়ে ১০ হাজার টন খাদ্যশস্য উত্তর-পূর্ব ভারতে পাঠানোর অনুমতি দিয়েছে। বিপরীতে ভারত থেকে যে ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেনার কথা ছিল, তা-ও বিলম্ব হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গে অবকাঠামো নির্মাণকাজ শেষ না হওয়ায়।

এসব বাধা সত্ত্বেও গত সাড়ে চার বছরে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কোন্নয়নে যে বড় কাজটি হয়েছে তা হলো পারস্পরিক সন্দেহ ও অবিশ্বাস অনেকটাই দূর হয়েছে। যোগাযোগ ও ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্র সম্প্রসারিত হয়েছে। গত অর্থবছরে বাংলাদেশ ভারতে ৪৯ দশমিক ৮৪ কোটি ডলার এবং আগের বছর ৫১ দশমিক ২৫ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে। একই সময়ে বাংলাদেশ ভারত থেকে আমদানি করেছে যথাক্রমে ৪৭৪ দশমিক ৫৪ কোটি ডলার ও ৪৫৬ কোটি ডলারের পণ্য। কয়েক বছর আগেও ভারতে বাংলাদেশি পণ্য রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৩০-৩৫ কোটি ডলারের মধ্যে। সীমান্তে বসেছে হাট। আঞ্চলিক যোগাযোগের আওতায় বাংলাদেশ নেপাল ও ভুটানে ট্রানজিট-সুবিধা পেয়েছে।

বড় দুটি সমস্যার সমাধান করতে না পারলেও তাও কয়েক বছরে ভারত দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের বেশ কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ নিয়েছে- ভারত ভিসা পদ্ধতি কিছুটা সহজ করেছে; বাংলাদেশ চায় আরও সহজ হোক। মানুষে মানুষে যোগাযোগ বাড়ুক। দুই দেশের মধ্যে বন্দিবিনিময় চুক্তি সই হয়েছে। বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধানে নেপাল ও ভুটানকে নিয়ে আঞ্চলিক গ্রিড গড়ে তুলতে ভারত রাজি হয়েছে। মেঘালয়ে প্রতিষ্ঠিত বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকেও বাংলাদেশ চাহিদামাফিক বিদ্যুৎ কিনতে পারবে। এর সবই হলো ভবিষ্যতের কথা। এ মুহূর্তে বাংলাদেশ কী পেয়েছে? ১০০ কোটি ডলারের ঋণ, যার ২০ কোটি ডলার অনুদানে রূপান্তরিত হয়েছে। বাংলাদেশের জন্য এ পাওয়া কি খুবই কম নয়? বাংলাদেশে ভারতের সাবেক রাষ্ট্রদূত মুচকুন্দ দুবে বলেছেন, বাংলাদেশের অবকাঠামো নির্মাণে ভারতের আরও বেশি অনুদান দেওয়া উচিত। কেননা এই অবকাঠামোর সুবিধা তো তারাও পাবে।

তবে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে আরও যে দুটি বিষয় গলার না হলেও পথের কাঁটা হয়ে আছে। ১. সীমান্তে বিএসএফের গুলিবর্ষণ ২. বাংলাদেশের টেলিভিশন চ্যানেলগুলো ভারতে না দেখানো।

ভারতের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে সীমান্তে গুলি হবে না বলে আশ্বাস দেওয়া সত্ত্বেও বিএসএফের হাতে নিরীহ বাংলাদেশি মানুষ মারা যাচ্ছেন। অন্যদিকে ভারতের সব টিভি চ্যানেল বাংলাদেশে দেখা গেলেও বাংলাদেশের কোনো চ্যানেলই ভারতে দেখা যায় না। কারণ যা-ই হোক না কেন, কিংবা এর সঙ্গে কারিগরি বা ব্যবসায়িক- যে সমস্যাই থাকুক না কেন, এর সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষের আবেগ জড়িত। বাংলাদেশের চ্যানেল যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে দেখা গেলে পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা ও আসামের বাংলা ভাষাভাষীরা কেন দেখতে পারবে না, এটি মেনে নেওয়া যায় না। ২০১১ সালে ভারতের সাবেক তথ্যমন্ত্রী অম্বিকা সোনি বলেছিলেন, বাংলাদেশের টিভি চ্যানেলগুলো যাতে ভারতে দেখা যায়, সেই চেষ্টা তিনি করবেন। গত দুই বছরেও সেই চেষ্টার প্রতিফলন বাংলাদেশের মানুষ দেখেনি। অম্বিকাও মন্ত্রী নেই।

সীমান্তে কাঁটাতার, বিএসএফের গুলি এবং দ্বিপক্ষীয় সমস্যাগুলো অমীমাংসিত রেখে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে যে খুব বেশি এগিয়ে নেওয়া যাবে না, আশা করি দিল্লির নীতিনির্ধারকেরা এই সরল সত্যটি স্বীকার করবেন।

এ মুহূর্তে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে যে আশা-নিরাশার দোলাচল ও দ্বিধা-দ্বন্দ্ব রয়েছে, তার দায় মূলত ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি এবং সেই দায় মেটাতে দিল্লিকেই উদ্যোগী ও কার্যকর ভূমিকা নিতে হবে। সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে।

প্রকাশকালঃ জুন ২১, ২০১৩।