বই কেনার নামে দুর্নীতির তেলেসমাতি

আমাদের স্কুলের পাঠ্যবইয়ে ‘বই কেনা’ নামে প্রখ্যাত লেখক সৈয়দ মুজতবা আলীর একটি প্রবন্ধ ছিল। এই প্রবন্ধে তিনি বই কেনায় বাঙালি মধ্যবিত্তের অনীহার বিষয়টি তুলে ধরেছিলেন রস ও শ্লেষ মিশিয়ে। তিনি লিখেছিলেন, বই কিনে কেউ কখনো দেউলিয়া হয় না। বই কিনে কেউ দেউলিয়া না হলেও বই বিক্রি করে কিংবা প্রকল্পের নামে যে রাতারাতি কোটিপতি হওয়া যায়, সে নজির আমরা সম্প্রতি হাতেনাতেই পেলাম।

মুক্তিযুদ্ধকে নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে সরকার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বঙ্গবন্ধু কর্নার স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে। সিদ্ধান্ত ছিল ৬৫ হাজার ৭০০ সরকারি বিদ্যালয়ের জন্য ১৩০ কোটি টাকার শিশুদের পাঠ উপযোগী বই কেনা হবে। খুবই ভালো উদ্যোগ। কিন্তু উদ্যোক্তাদের হয়তো জানা নেই, বাংলাদেশ অনেক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এতটাই ভঙ্গুর যে সেখানে বঙ্গবন্ধু কর্নার করার মতো কোনো জায়গা নেই। আমরা বন্যায় অনেক স্কুলঘর ভেসে যেতে দেখলাম। অনেক স্কুলঘর নদীতে ভেঙে যেতে দেখলাম।

কিন্তু যাঁরা বঙ্গবন্ধু কর্নারের জন্য বই সরবরাহ করবেন, তাঁদের তো কোনো সমস্যা নেই। তালিকাটি একবার হাতে পেলে প্রতিটি বই ৬৫ হাজার ৭০০ কপি সরবরাহ করে কোটি কোটি টাকা কামানো যাবে। বই মানে সৃজনশীল রচনা হতে হবে, এমন কথা নেই। দুই মলাটের মধ্যে নানাজনের লেখা সংগ্রহ করতে পারলেই হলো।

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক বইয়ে যদি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রীর কোনো লেখা বা বাণী থাকে, তাহলে আর সেটিকে উপেক্ষা করার সাহস কারও থাকবে না।

১৩০ কোটি টাকার বই কেনার কাজটি হয়তো লোকচক্ষুর আড়ালেই সম্পন্ন হতো, যেমন সরকারের আরও অনেক প্রকল্পের কাজ হয়ে থাকে। কিন্তু প্রকাশক ও লেখকেরা আপত্তি জানানোয় ভেতরের গুমর ফাঁস হয়ে যায়। প্রথমে প্রকাশকেরা আপত্তি করলেন। ২৪ জুন ১৫ জন লেখক এক বিবৃতিতে বলেন, ‘এই ধরনের অস্বচ্ছ কাজ সমর্থনযোগ্য নয়। বাংলাদেশের অনেক লেখক বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বই লিখেছেন। বই কেনার পূর্বেই এসব বই নির্বাচন প্রক্রিয়ায় আনা আবশ্যক।’

কবি নির্মলেন্দু গুণ ফেসবুকে লিখছেন যে, যদি লেখক-কবিদের মতামত উপেক্ষা করে বই কেনা অব্যাহত রাখা হয়, তাহলে পাঠ্যবই থেকে যেন তাঁর কবিতা প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়।

উদ্যোগটি ছিল প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের। কিন্তু প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেন বলেছেন, ‘বই বাছাইয়ের বিষয়ে আমি কিছু জানি না। আমার কমিটি ৩০ থেকে ৩৫টি বইয়ের তালিকা দিয়েছে। এখান থেকে আমাকে বাইপাস করে ৮টি বই কেনা হয়েছে। এমনকি আমাকে না জানিয়ে টেন্ডারও করা হয়। তাই কেলেঙ্কারির কথা জানার পরপরই তদন্তের নির্দেশ দিয়েছি।’

লেখক-প্রকাশকদের আপত্তির মুখে বই বাছাইয়ের প্রক্রিয়া স্থগিত হয়েছে। কিন্তু এর আগেই ৩০ কোটি টাকা ব্যয় করে ৮টি বই কেনার সিদ্ধান্ত নেন সংশ্লিষ্টরা। খালি হাতে তো ফেরা যায় না। এর মধ্যে ৩টি বই কেনার খরচ ২০ কোটি ৭০ লাখ ৮৬ হাজার ৪০০ টাকা। এ তিনটি বইয়ের প্রকাশক জনৈক নাজমুল হোসেন। তাঁর প্রকাশনা সংস্থা জার্নি মাল্টিমিডিয়া লিমিটেড ও স্বাধিকা পাবলিকেশনস।

ইতিমধ্যে দুটি বইয়ের স্বত্ব চুরি ও ১৭ কোটি ৫৭ লাখ ৫৬ হাজার ৫০০ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে ওই জার্নি মাল্টিমিডিয়া ও স্বাধিকার বিরুদ্ধে। বই দুটির নাম ‘বঙ্গবন্ধু মানেই স্বাধীনতা’ এবং বঙ্গবন্ধুর জেলজীবন নিয়ে লেখা ‘৩০৫৩ দিন’।

বই ক্রয় কেলেঙ্কারির ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর দুটি তদন্ত কমিটি হয়েছে। একটি করেছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, আরেকটি সংসদীয় কমিটি।

উল্লিখিত বই দুটি মৌলিক নয়। নানাজনের লেখার সংকলন। ‘বঙ্গবন্ধু মানেই স্বাধীনতা’ বইয়ের সম্পাদক অমিতাভ দেউরী অভিযোগ করেছেন, ‘গোপনে প্রকাশকের নাম পরিবর্তন করে নিজের নামে কপিরাইট করে নিয়ে প্রায় ২০ কোটি টাকার বেশি হাতিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে জার্নি মাল্টিমিডিয়া ও স্বাধিকা। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অনুরোধে বইটি আমি সম্পাদনা করলেও পরবর্তী সময়ে আমাকে না জানিয়ে নাজমুল হোসেন নিজের নাম প্রধান গবেষক ও সমন্বয়ক-প্রকাশক হিসেবে তাঁর স্ত্রীর নাম দিয়েছেন। এমনকি গোপনে বইয়ের কপিরাইটও তাঁর নামে করিয়ে নিয়েছেন।’ দেউরী ঢাকায় কপিরাইট অফিসে বইটির কপিরাইট বাতিলের আবেদন করেছেন।

অন্যদিকে নাজমুল হোসেনের দাবি, ‘বইটি সম্পাদনা করতে তাঁর প্রতিষ্ঠান থেকে মি. দেউরীকে নিয়োগ করা হয়েছিল এবং চুক্তি অনুযায়ী তাঁকে অর্থও দেওয়া হয়েছে। বইটির কপিরাইট আমাদের। পরে চুক্তি হয় মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে এবং সে অনুযায়ী তারা ২৩ শতাংশ লভ্যাংশ পাবে।’

আর বঙ্গবন্ধুর কারাগারে থাকার সময় নিয়ে লেখা ‘৩০৫৩ দিন’ বইটি বাংলাদেশ কারা কর্তৃপক্ষ প্রকাশ করেছে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু কর্নারের জন্য যে বই সরবরাহ করা হয়েছে, সেখানে সম্পাদক হিসেবে নাজমুল হোসেন ও প্রকাশক হিসেবে তাঁর প্রতিষ্ঠানের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। নাজমুল বলেছেন, বইটিরও তিনি উদ্যোক্তা, পাণ্ডুলিপি তাঁর করা। কারা কর্তৃপক্ষকে প্রস্তাব দিয়েছেন, ছাপা, মুদ্রণ ও বিপণনের দায়িত্ব দিলে তাদের ২০ শতাংশ সম্মানী দেওয়া হবে।

একেই বলে কইয়ের তেলে কই ভাজা। সরকারের এক মন্ত্রণালয় বই কিনবে। আর দুটি মন্ত্রণালয় বই প্রকাশ করবে (কারা কর্তৃপক্ষ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে)। মাঝখান থেকে প্রকাশক লেখা সংগ্রহ, সম্পাদনা, বই ছাপা, মুদ্রণ ও বিপণন বাবদ কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেবেন। তবে নাজমুল এখানে লাভের গুড় একা নিয়ে যেতে চাননি। কারা কর্তৃপক্ষ ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়কে যথাক্রমে ২০ ও ২৩ শতাংশ সম্মানী দিতে চেয়েছেন।

প্রশ্ন হলো, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় ৬৫ হাজার ৭০০ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জন্য বই কেনার সিদ্ধান্ত না নিলে রাতারাতি দুটি সম্পাদিত বই প্রকাশিত হতো কি না? প্রকাশিত হলেও প্রকাশক কারা কর্তৃপক্ষ ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়কে ২০ ও ২৩ শতাংশ হারে সম্মানী দিতেন কি না? বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখকও ১৫ শতাংশের বেশি সম্মানী পান না। আর মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় কোনো কিছু না করে ২৩ শতাংশ এবং কারা কর্তৃপক্ষ ২০ শতাংশ সম্মানীর ভাগীদার হয়েছে।

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় বই প্রকাশ করেনি। অথচ মন্ত্রণালয়ের নাম ব্যবহার করতে দিয়েছে। এই মন্ত্রণালয়ের কাজ মুক্তিযোদ্ধাদের স্বার্থ সমুন্নত রাখা। অন্যের বইয়ে নাম ব্যবহার করে সম্মানীর টাকা ভাগাভাগি করা নয়। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী যথার্থই বলেছেন, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের টাকার প্রয়োজন হলে আমাদের বলত। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশু শিক্ষার্থীদের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক বই পড়ানোর নামে এ রকম জালিয়াতি হতে পারে?

অতীতেও সরকারি প্রকল্পে বই কেনা নিয়ে অনিয়ম-দুর্নীতি কম হয়নি। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার্থীদের বই দেওয়ার জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয় একটি প্রকল্প নিয়েছিল আওয়ামী লীগের প্রথম সরকারের আমলে। কিন্তু পরে দেখা গেল রাজনৈতিক নেতা-কর্মী ও তাঁদের পোষ্যদের লেখা বইয়ের ভিড়ে প্রকৃত লেখকদের আর জায়গা হয় না। আওয়ামী লীগ আমলে আওয়ামী লেখক ও বিএনপির আমলে বিএনপির লেখকদের নিম্ন মানের বই কিনে স্কুল-কলেজের পাঠাগারগুলো ভরে ফেলা হয়েছিল। একপর্যায়ে প্রকল্পটিই বাতিল হয়ে যায়।

প্রকাশক-লেখকেরা বলেছেন, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বই কেনা প্রকল্পের পুরো প্রক্রিয়া বাতিল করতে হবে। সরকারি প্রকল্পে বই কেনার নামে জনগণের করের অর্থের অপচয় বন্ধ করতে হবে। নতুন করে দরপত্র আহ্বান করে যাঁরা প্রকৃতই শিশুদের উপযোগী মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে লেখালেখি করেন, যাচাই-বাছাই করে তাঁদের বই নেওয়া হোক।

আমরা দুটি তদন্ত কমিটির সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছি।

প্রকাশকাল: ৩০ আগষ্ট ২০২০