এই সংসদ কি আমরা চেয়েছিলাম?

বাংলাদেশে এখন কথার প্রতিযোগিতা চলছে। হাটে-বাজারে সবখানে কথা। বেশি কথা হলে যে বাজে কথা হয়, তা-ও আমাদের অজানা নয়। রাজনীতিকেরা এত দিন সভা-সমাবেশে একে-অন্যের বিরুদ্ধে বিষোদগার করতেন, গাল দিতেন, ব্যক্তিগত কুৎসা রটনা করতেন। এখন সেই কাজটিই তাঁরা করছেন জাতীয় সংসদের ভেতরে।

বাজেট অধিবেশনে বিরোধী দলের যোগ দেওয়ায় সবাই খুশি হয়েছিলেন। ভেবেছিলেন, নবম সংসদের শেষটা ভালো যাবে। সরকারি ও বিরোধী দলের সাংসদদের উপস্থিতিতে অধিবেশন প্রাণবন্ত হবে। বাজেট নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ হবে। দুই দলের বিজ্ঞ সাংসদদের আলোচনার মধ্য দিয়ে জনগণ দেশের প্রকৃত অবস্থাটি জানতে পারবেন। এখন অবস্থা দাঁড়িয়েছে, ‘ভিক্ষা চাই না, দয়া করে গালাগাল বন্ধ করুন’।

বাংলাদেশের মানুষ যা চায়, নেতা-নেত্রীরা ঠিক তার বিপরীতটাই আমাদের উপহার দেন। বাংলাদেশের মানুষ চায় নির্বাচনের ব্যাপারে দুই পক্ষের মধ্যে একটি সমঝোতা হোক। হরতাল, ভাঙচুর বন্ধ হোক। গ্রেপ্তার-রিমান্ড রহিত হোক। দেশটা শান্তিতে থাক।

কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো, দেশকে শান্তিতে রাখার দায়িত্ব আমরা যাঁদের হাতে অর্পণ করেছি, সেই মাননীয় সাংসদেরা নিজেরাই প্রতিনিয়ত অশান্তির মহড়া দিয়ে চলেছেন সংসদের ভেতরে ও বাইরে। গত কয়েক দিনে তাঁরা এমন সব শব্দ ও বাক্য উচ্চারণ করেছেন, যা কেবল অরুচিকর নয়, অশালীন ও নোংরা। কে কার বিরুদ্ধে কত বেশি আক্রমণাত্মক ভাষা ব্যবহার করতে পারেন, সংসদে তার প্রতিযোগিতা চলছে। কেউ মা-বাপ তুলে গালি দিচ্ছেন, জাতীয় নেতা-নেত্রীদের চরিত্র হনন করছেন। কেউ সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিকভাবে কবিতার পঙক্তি আওড়াচ্ছেন। কেউ বা নিজেই ঘোষণা দিচ্ছেন, রবীন্দ্রসংগীত গাইতে আসেননি। রবীন্দ্রসংগীতে যে শান্তি ও সম্প্রীতির কথা আছে, সেসব তাঁদের পছন্দ নয়। তাহলে কি তাঁরা সংসদে মল্লযুদ্ধ করতে এসেছেন?

লক্ষণীয় বিষয় হলো, এসব গালাগালিতে এগিয়ে আছেন দুই দলের সংরক্ষিত নারী আসন থেকে নির্বাচিত কয়েকজন নারী সাংসদ। তাঁরা দলের ও নেত্রীর প্রতি আনুগত্য দেখাতে গিয়ে এমন সব আচরণ করছেন, কথাবার্তা বলছেন, যা আপত্তিকর ও শিষ্টাচারবহির্ভূত। দেশে খাদ্য উত্পাদন বেড়েছে বলে মঙ্গা নেই, খাদ্যাভাব নেই। কিন্তু রাজনীতিতে রুচি, শালীনতা ও সহিষ্ণুতার যে মহাদুর্ভিক্ষ চলছে, তা কিছুতেই বন্ধ করা যাচ্ছে না।

আমাদের সমাজে এখনো নারীদের বাড়তি সমীহ ও সম্মান করা হয়। কিন্তু জাতীয় সংসদে কয়েকজন নারী সাংসদের ভাষা অনেকটা ‘কাইট্টা ছিল্লা লবণ লাগাইয়া’ দেওয়ার মতো। তবে এ লবণ শুধু যে তাঁরা প্রতিপক্ষের গায়ে লাগাচ্ছেন তা-ই নয়, নিজেদের গায়েও লাগাচ্ছেন। দলে, গায়ে, নেতা-নেত্রীদের গায়ে কালি লাগাচ্ছেন। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে, তাঁদের বক্তৃতা শুরু হতেই অনেকে রেডিও-টিভি বন্ধ করে দেন, কিংবা কানে আঙুল দিয়ে রাখেন।

সাধারণ মানুষ চেয়েছিল সুন্দর ও প্রাণবন্ত একটি সংসদ। কিন্তু জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা সংসদকে সাবেক স্পিকারের ভাষায় মাছের বাজারে পরিণত করেছেন। তবে মাননীয় সাবেক স্পিকার ও বর্তমান রাষ্ট্রপতি নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন, পৃথিবীর কোনো দেশের মাছের বাজারে এ রকম অশালীন, অশ্রাব্য ও অরুচিকর ভাষা ব্যবহূত হয় না, যা আমাদের সাংসদেরা কয়েক দিন ধরে দিয়ে চলেছেন।

বলা হয়, মুখের ভাষাই নাকি মানুষের রুচি ও মনের পরিচয়। যে সাংসদেরা সংসদে অবলীলায় অশালীন ও অশ্রাব্য ভাষা ব্যবহার করছেন, তাঁরা কি ঘরে সন্তান-স্বামী কিংবা নিকটাত্মীয়দের সঙ্গেও একই ভাষায় কথা বলেন? যদি না বলেন, তাহলে জনগণের অর্থে পরিচালিত এই মহান জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে তাঁরা এ ধরনের নোংরা কথাবার্তা বলার ধৃষ্টতা কেন দেখাচ্ছেন? কেন এভাবে জনগণের অর্থের অপচয় করছেন? এতে কি নেত্রীরা সম্মানিত হচ্ছেন, না তাঁদের আরও অসম্মানিত করছেন?

জাতীয় সংসদের কাচের ঘরে বসে যাঁরা প্রতিপক্ষের প্রতি ইট ছুড়ে মারছেন, তাঁদের পাটকেলটির জন্য প্রস্তুত থাকতে হয়। অতএব, মাননীয় ও মাননীয়াদের প্রতি অনুরোধ, ইটপাটকেলের গণতন্ত্র বন্ধ করুন। গণতন্ত্রের জন্য নিজেদের যোগ্য করে তুলুন।

জাতীয় সংসদ পরিচালনার জন্য স্পিকার আছেন। ডেপুটি স্পিকার আছেন। দুই দলের চিফ হুইপ আছেন। হুইপ আছেন। তার পরও এভাবে সংসদে অসংসদীয় ও অশালীন ভাষার প্রতিযোগিতা কীভাবে চলে? কীভাবে জ্যেষ্ঠ সাংসদেরা এসব মেনে নিচ্ছেন? সংসদ অত্যন্ত পবিত্র জায়গা। একে অপবিত্র করবেন না। দুর্গন্ধ ছড়াবেন না।

আমরা জানি, জাতীয় সংসদের ভেতরে স্পিকারের অনেক ক্ষমতা। তিনি অসদাচরণের দায়ে যেকোনো সাংসদকে বসিয়ে দিতে পারেন। এমনকি তিনি চাইলে পুলিশ ডেকে অধিবেশন থেকে তাঁকে বের করেও দিতে পারেন। মাননীয় স্পিকার, কোন দলের সদস্য, সেটি বিবেচনার বাইরে রেখে যে-ই অশালীন কথা বলবেন, তাঁকে বের করে দিন। দেখবেন পরদিন থেকে সংসদে গালাগাল বন্ধ হয়ে গেছে। সুন্দর ও সুষ্ঠুভাবে সংসদ চলছে।

চারদলীয় জোট সরকারের আমলে দেশে নৈরাজ্য, সন্ত্রাস ও দেশব্যাপী জঙ্গিদের বোমা হামলার ঘটনা দেখে দ্রোহী লেখক হুমায়ুন আজাদ সংক্ষুব্ধ মনে লিখেছিলেন, ‘এই বাংলাদেশ কি আমরা চেয়েছিলাম?’

আজ তাঁর কথারই প্রতিধ্বনি তুলে প্রশ্ন করতে চাই, ‘এই সংসদ কি আমরা চেয়েছিলাম?’

প্রকাশকালঃ জুন ২৪, ২০১৩।