কার সুসময় আর কার দুঃসময়

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, দেশ দুঃসময় পার করছে না, বিএনপির রাজনীতিতে চরম দুঃসময় চলছে। এর আগে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছিলেন, দেশ ও বিশ্ব মহা দুঃসময় পার করছে।

করোনাকালের রাজনীতি মির্জা-কাদেরের বাহাসের মধ্যেই সীমিত। এতে জনগণের দুঃখ-কষ্টের কথা নেই। করোনা নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা নেই। কীভাবে একে অপরের মুখ ম্লান করবেন, সেই বয়ানই দেশবাসীকে তাঁরা শোনাচ্ছেন।

ওবায়দুল কাদের বিএনপির চরম দুঃসময়ের কথা বলেছেন। বিএনপির দুঃসময় নিশ্চয়ই আওয়ামী লীগের জন্য সুসময় বয়ে এনেছে। কিন্তু তাতে দেশের মানুষের সুসময় এসেছে, এর প্রমাণ নেই। বাংলাদেশের রাজনীতি হলো এক দলের সুসময় মানে অন্য দলের দুঃসময়। এটি আমরা বিএনপির আমলে যেমন দেখেছি, এখন আওয়ামী লীগের আমলেও প্রত্যক্ষ করছি। কিন্তু দেশের গরিষ্ঠসংখ্যক মানুষের সুসময় কখনো আসেনি।

তবে বিএনপির জন্য মহা দুর্দিন বা দুঃসময় এর আগেও একাধিকবার এসেছে। লেখক-গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ বিএনপির রাজনীতি নিয়ে একটি তথ্যসমৃদ্ধ বই লিখেছেন, যার শিরোনাম, বিএনপি: সময় অসময় (প্রথমা প্রকাশন)। এই বইয়ে তিনি জন্ম থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত বিএনপির রাজনৈতিক উত্থান-পতনের কথা লিখেছেন। এরপরও ছয় বছর পার হয়েছে। কাদেরের ভাষায় বিএনপির দুঃসময় কাটেনি। একইভাবে ৭১ বছর বয়সী আওয়ামী লীগকেও নানা চড়াই-উতরাইয়ের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। এখন আওয়ামী লীগের সুসময় বটে। একনাগাড়ে ১১ বছর ক্ষমতায় আছে, যা ভারতের জাতীয় কংগ্রেস ছাড়া দ্বিতীয় কোনো উদাহরণ নেই।

বিএনপি বর্তমানে প্রায় একটি নিষ্ক্রিয় দল। সংসদের ভেতরে-বাইরে তাদের উপস্থিতি মানুষকে কোনোভাবে আন্দোলিত করতে পারছে না। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বিএনপিকে গণবিচ্ছিন্ন দল হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। কিন্তু তাতে প্রমাণ করে না আওয়ামী লীগের গণসম্পৃক্ততা বেড়েছে। গণসম্পৃক্ততা থাকলে দলের নেতা-কর্মীরা মানুষের বিপদে-আপদে পাশে থাকতেন। সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিতেন। কিন্তু এই করোনাকালে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের আমরা সেই ভূমিকায় দেখছি না। ব্যতিক্রম নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু ব্যতিক্রম আর সাধারণ প্রবণতা এক নয়।

যেখানে সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, দখলবাজির ঘটনা ঘটছে, সেখানেই আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ বা যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতা-কর্মীদের নাম আসছে। এটাই কি গণসম্পৃক্ততার লক্ষণ? কিছুদিন আগে দেশবাসী প্রথম আলোর মাধ্যমে ফরিদপুর আওয়ামী লীগের দুই ভাই, তাঁদের গডফাদার ও সহযোগীদের নানা অপকর্মের কথা জানতে পেরেছেন। অন্যান্য জেলায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অভিযান চালালে এ রকম ‘গণসম্পৃক্ততার’ তথ্য বের করতে পারবে। কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে আসবে। গত বছরের শুদ্ধি অভিযানে যারা ধরা পড়লেন, তাঁদের প্রায় সবাই আওয়ামী লীগ, যুবলীগ বা অন্য কোনো লীগের নেতা-কর্মী।

আওয়ামী লীগের গণসম্পৃক্ততার আরেকটি উদাহরণ দিই। করোনাকালে গরিবের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে যে চাল-গম দেওয়া হয়েছিল, তারও একাংশ স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা (যাঁদের ৯০ শতাংশ আওয়ামী লীগার) আত্মসাৎ করেছেন। শতাধিক জনপ্রতিনিধি সাময়িক বরখাস্ত হয়েছেন। আগে স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধিরা ছিলেন নির্দলীয়। আওয়ামী লীগ সরকার দলীয় প্রতীকে নির্বাচন করে স্থানীয় সরকারব্যবস্থাটিকে পুরোপুরি দলীয়করণ করে ফেলেছে। সংবিধানে প্রশাসন বিকেন্দ্রীকরণের কথা আছে। স্থানীয় শাসন শক্তিশালী করার কথা আছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার দলীয়করণকেই বিকেন্দ্রীকরণ করল। আগে জাতীয় পর্যায়ে যেই দলের সরকারই থাকুক না কেন, স্থানীয় পর্যায়ে একটা ভারসাম্য থাকত। এখন দলীয়করণ এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে সামাজিক সম্পর্কও ভেঙে পড়ছে। কেউ কারও মুখ দেখছেন না।

কয়েক দিন আগে সিলেটের এমসি কলেজের ছাত্রাবাসে ছাত্রলীগের কর্মীদের হাতে ধর্ষণের শিকার হন এক গৃহবধূ। ওই ছাত্রাবাস ছাত্রলীগের আস্তানা হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছিল। তাঁদের অপকর্মের কথা কলেজের অধ্যক্ষ জানতেন, ছাত্রাবাসের তত্ত্বাবধায়ক জানতেন। কিন্তু তাঁরা কোনো ব্যবস্থা নেননি বা নিতে পারেননি। পত্রিকার খবর অনুযায়ী, সিলেটের এমসি কলেজ ও আশপাশের এলাকায় অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছিল ধর্ষণ-কাণ্ডে গ্রেপ্তার হওয়া ছাত্রলীগের সঙ্গে জড়িত বখাটে তরুণেরা। কলেজ ঘিরে গড়ে তোলা হয়েছিল অপরাধ সিন্ডিকেট। গত এক দশকে ওই এলাকায় আধিপত্য নিয়ে কোন্দলে খুন হয়েছেন ছাত্রলীগের অন্তত পাঁচ কর্মী। (ইত্তেফাক, ২ অক্টোবর ২০২০) ২০১২ সালে এই এমসি কলেজের ছাত্রাবাস পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল ছাত্রলীগ ও ছাত্রশিবিরের দ্বন্দ্বের জেরে। এরপর থেকে ছাত্রাবাসটিতে ছাত্রলীগের একচ্ছত্র আধিপত্য। ছাত্রশিবির বিতাড়িত। আমরা খুশি হতাম যদি শুনতাম, ছাত্রশিবির বিতাড়িত হওয়ায় সেখানে শান্তি এসেছে। সাধারণ ছাত্ররা নিরাপদে আছেন। কিন্তু বাস্তবে বিপরীতটাই ঘটছে।

সিলেটে গৃহবধূ ধর্ষণের প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সমাবেশ করেছে বাম ছাত্র ঐক্য ও সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ। সমাবেশ করেছে ছাত্রলীগও। কিন্তু বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করলাম, ছাত্রলীগ নেতারা সিলেটের ধর্ষণকারীদের বিরুদ্ধে কথা না বলে ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক ও তাঁর সহযোগীদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেছেন। ছাত্রদল আগে থেকেই ক্যাম্পাসে আসতে পারে না। বাম ঐক্যজোটের শক্তি নেই ছাত্রলীগকে মোকাবিলা করার। সে ক্ষেত্রে নুরুল হকের ছাত্র পরিষদই ক্যাম্পাসে বিভিন্ন অনাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছিল। কোটা সংস্কার আন্দোলন করে সাধারণ ছাত্রদের দাবি প্রতিষ্ঠা করেছিল। নুরুল হককে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করার উদ্দেশ্য হলো, সেই প্রতিবাদী কণ্ঠকেও স্তব্ধ করে দেওয়া। ডাকসু নির্বাচনের আগে ও পরে নুরুল হক ৯ বার ছাত্রলীগের হাতে মার খেয়েছেন। এখন ক্যাম্পাসে অবাঞ্ছিত ঘোষিত হলেন। এটি কার সুসময়?

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক দেশবাসীর জন্য যাকে সুসময় বলে দাবি করেছেন, সেই সুসময়ের কিছু চিত্র বৃহস্পতিবার তুলে ধরেছে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)। তাদের দেওয়া পরিসংখ্যানে দেখা যায়, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৯ মাসে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে ও তথাকথিত ‘ক্রসফায়ারে’ ২১৬ জন মারা গেছেন। এর মধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে এনকাউন্টারে নিহত হন ১৮৫ জন। এ ছাড়া আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে মারা গেছেন ২৭ জন। এই ৯ মাসে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৯৭৫ জন। একক ধর্ষণের শিকার ৭৬২ আর সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার ২০৮ জন নারী। ধর্ষণের পর হত্যার শিকার ৪৩ জন এবং আত্মহত্যা করেছেন ১২ জন নারী। আর ১৬১ জন নারী হয়েছেন যৌন হয়রানির শিকার। এর প্রতিবাদ করতে গিয়ে ৩ জন নারী ও ৯ জন পুরুষ নিহত হয়েছেন।

এই সময়ে পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৪৩২ জন নারী। এর মধ্যে হত্যার শিকার ২৭৯ আর পারিবারিক নির্যাতনের কারণে আত্মহত্যা করেছেন ৭৪ জন নারী। ১ হাজার ৭৮টি শিশু শারীরিক নির্যাতনসহ নানা সহিংসতার শিকার হয়েছে। নিহত হয়েছে ৪৪৫টি শিশু, ধর্ষণের শিকার ৬২৭টি। গণপিটুনিতে মারা গেছেন ৩০ জন। এই ৯ মাসে পেশাগত কাজ করতে গিয়ে ২০৯ জন সাংবাদিক বিভিন্নভাবে নির্যাতন ও হয়রানির শিকার হয়েছেন। অন্যদিকে হিন্দু সম্প্রদায়ের ৪৭টি প্রতিমা ভাঙচুর এবং মন্দির ও পূজামণ্ডপে হামলা-অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। এ ছাড়া আহমদিয়া সম্প্রদায়ের একটি বসতঘরে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে।

মহিলা পরিষদ জানিয়েছে, সেপ্টেম্বরে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৩৪০ জন নারী ও শিশু। এর মধ্যে ২০ জন গণধর্ষণসহ ১২৯ জন ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। অ্যাসিড নিক্ষেপের শিকার হয়েছেন চারজন। এর মধ্যে মারা গেছেন দুই নারী। যৌতুকের কারণে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ১৪ জন।

এসব হত্যা, ধর্ষণ ও সন্ত্রাসের ঘটনা কোনোভাবেই সুসময়ের ইঙ্গিত দেয় না। তাই ওবায়দুল কাদের যে সুসময়ের কথা বলেছেন, সেটি আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের জন্য সত্য হলেও সাধারণ মানুষের জন্য সত্য নয়।

প্রকাশকাল: ৩ আক্টোবর ২০২০