মুক্তিযোদ্ধা সনদ ও মেধাবী তরুণদের কথা

গত পাঁচ বছরে শেখ হাসিনার সরকার জনপ্রশাসনে স্বাধীনতাবিরোধী কিংবা জামায়াত-বিএনপির সমর্থক কাউকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়েছে এমন দাবি দুর্মুখেরাও করবেন না। বিরোধী দল বিএনপির সঙ্গে দূরতম যোগসূত্র আছে, এ রকম আভাস-ইঙ্গিত যাঁর সম্পর্কে পাওয়া গেছে, তাঁকেই হয় ওএসডি করে রাখা হয়েছে বা ২৫ বছরের চাকরির বয়স হয়েছে- এই অজুহাত দেখিয়ে পত্রপাঠ বিদায় দেওয়া হয়েছে। আবার অনেকে মনের দুঃখে চাকরি ছেড়েও দিয়েছেন। স্বাধীনতার চেতনাধারী এ রকম জনপ্রশাসনে যদি মুক্তিযোদ্ধা সনদ জালিয়াতির ঘটনা ঘটে, সেই দায় সরকার এড়াতে পারে না।

কেবল অভিযোগ নয়, সরকারের কাছে এটাই প্রতীয়মান হয়েছে যে মিথ্যা তথ্য দিয়ে অনেক সরকারি কর্মকর্তা মুক্তিযোদ্ধা সনদ ভাগিয়ে নিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক স্বীকার করেছেন, ‘ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে আমাদের কাছে প্রতিদিন সরকারি ও বেসরকারিভাবে বিভিন্ন অভিযোগ আসছে। এ ছাড়া পত্রপত্রিকায়ও বিষয়টি এসেছে। আমরা নিজেরাও খবর নিয়ে জানতে পেরেছি, অনেক ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদ নিয়েছেন। গত তিন বছরে যাঁরা সনদ নিয়েছেন এবং যাঁদের বিষয়ে অভিযোগ রয়েছে, তাঁদের সনদের বিষয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর প্রথমে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের সনদ বাতিল করা হবে। মুক্তিযোদ্ধা সনদ দেখিয়ে কেউ অনৈতিক সুবিধা নিয়ে থাকলে তা ফেরত নেওয়া হবে।’

বাস্তব চিত্রটি কী? আওয়ামী লীগের আমলে গত পাঁচ বছরে সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন পেশার মোট ১১ হাজার ১৫০ জন মুক্তিযোদ্ধা সনদ নিয়েছেন। আবেদন করেছিলেন ১৭ হাজারেরও বেশি। এর মধ্যে বাকিদের আবেদন গৃহীত হয়নি। ভালো কথা। কিন্তু এই যে ১১ হাজার ১৫০ জন মুক্তিযোদ্ধা সনদ নিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে কতজন খাঁটি আর কতজন ভেজাল, সেটি কি খতিয়ে দেখেছে সরকার। দেখলে পাঁচ বছর পর এসে এ সিদ্ধান্ত নিতে হয় না। মুক্তিযোদ্ধার ভুয়া সনদ যাঁরা নিয়েছেন, তাঁরা নিশ্চয়ই বিএনপি-জামায়াতের সমর্থক নন; কেউ পাকিস্তান থেকেও সনদ নিতে আসেননি। তাঁরা এই সরকারের সমর্থক সরকারি কর্মকর্তা এবং যেকোনো মাননীয়ের সুপারিশে সনদটি ভাগিয়ে নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা বনে গেছেন। এরপর সরকারি চাকরি থেকে অবসর নিলেও মুক্তিযোদ্ধা নাম নিয়ে ব্যবসা করতে অসুবিধা হবে না।

সরকারের কর্তাব্যক্তিরা এত দিন বিএনপি ও জাতীয় পার্টির সরকারের বিরুদ্ধে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদ দেওয়ার এবং তালিকা প্রণয়নের অভিযোগ করে আসছেন। এখন তাঁরা কী বলবেন? পাঁচ বছর ধরে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় যেসব কাজ করেছে, তার স্বচ্ছতা, জবাবদিহি কতটুকু ছিল? মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সাবেক প্রতিমন্ত্রী তাজুল ইসলাম ‘আমি দায়িত্ব পালনকালে আগের অনেক ত্রুটি-বিচ্যুতি দূর করেছি’ বলে সাফাই গাইছেন। কিন্তু তাঁর আমলেই কীভাবে এত বিপুলসংখ্যক ব্যক্তি মুক্তিযোদ্ধা সনদ নিয়ে গেলেন, তার জবাব নেই। অনেক ত্রুটি-বিচ্যুতি দূর করার মধ্যেও তাঁরা পড়েননি। স্বাধীনতার পর থেকেই মুক্তিযোদ্ধা সনদ নিয়ে বহু বিতর্ক হয়েছে, প্রতিটি সরকারের আমলে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্ষমতাসীনদের কাছ থেকে সুযোগ-সুবিধা ভাগিয়ে নেওয়ার অভিযোগও আছে।

সরকারকে বলতে হবে, এই ১১ হাজার সনদপ্রাপ্তের মধ্যে কতজন আসল, কতজন ভুয়া। একাত্তরে এ দেশের যে বীর সন্তানেরা পাকিস্তানি বাহিনী এবং তাদের এদেশীয় দোসরদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন, অনেকে শহীদ হয়েছেন, অনেকে পঙ্গু হয়ে পড়ে আছেন, তাঁদের নাম করে এহেন জালিয়াতি শুধু আইনের চোখেই অন্যায় নয়, রাষ্ট্রদ্রোহেরও শামিল। এঁরা মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধ উভয়কে অপমান করেছেন। এঁদের চাকরি থাকা তো দূরের কথা, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া উচিত।

দেশ স্বাধীন হয়েছে ৪৩ বছর। মুক্তিযোদ্ধা সনদ নিয়ে এখনো যাঁরা চাকরি করছেন, ১৯৭১ সালে তাঁদের বয়স হওয়ার কথা ১৫-১৬ বছর। এরপর তাঁরা কলেজে-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন, বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে চাকরিতে ঢুকেছেন, বছর বছর পদোন্নতি পেয়েছেন, কিন্তু এত দিনেও তাঁদের সনদ নেওয়ার প্রয়োজন পড়ল না। প্রয়োজন পড়ল সরকার যখন মুক্তিযোদ্ধাদের চাকরির বয়স দুই বছর বাড়াল। সে সময় সাধারণ কর্মকর্তারা ৫৭ বছর পর্যন্ত চাকরি করতে পারতেন। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে দুই বছরের বাড়তি সুবিধা পেলেন, পরবর্তী সময়ে সরকার চাকরির বয়সসীমা ৫৭ থেকে ৫৯ বছর করে। ফলে মুক্তিযোদ্ধারা সমান হয়ে গেলেন। সাম্য ও ন্যায়ের জন্য যুদ্ধ করা মানুষেরা এই সমতা মানতে পারেননি। অতএব তাঁদের আরও দুই বছর বাড়তি সময় দেওয়া হলো এবং সেই বাড়তি সময় নিয়েই সনদ জালিয়াতি চলতে থাকল।

১৯৭১ সালে মুক্তিযোদ্ধারা নিশ্চয়ই এসব দেখার জন্য যুদ্ধ করেননি, তাঁরা যুদ্ধ করেছিলেন দেশমাতৃকাকে মুক্ত করার উদ্দেশ্যে। দরিদ্র মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করা, অসহায় এবং দুস্থ মুক্তিযোদ্ধাদের পাশে দাঁড়ানো আর মুক্তিযোদ্ধা সনদ নিয়ে বাড়তি সুযোগ-সুবিধা নিশ্চয়ই এক কথা নয়।

১৯৭২ সালের সরকারি প্রজ্ঞাপনে তাঁদেরই মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল, যাঁরা অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছেন। নিরস্ত্রদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকার করে নিলে কতিপয় গাদ্দার ও দেশদ্রোহী ছাড়া সবাই মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। তাহলে কেন এই সনদ ব্যবসা?

আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কতটা ভঙ্গুর ও নিষ্প্রভ, তার প্রমাণ পাওয়া গেল সম্প্রতি হাইকোর্টের রায়ে। কেন বীরাঙ্গনাদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হবে না, সেটি আদালত জানতে চেয়েছেন নির্বাহী বিভাগের কাছে। গত ৪৩ বছরে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারী কিংবা প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার দল একাধিকবার ক্ষমতায় এসেছে। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান ও মর্যাদা দেয়নি কেউ।

গত পাঁচ বছরের অনিয়ম-দুর্নীতির তদন্তে সরকার কত বছর লাগাবে, বলা যায় না। কেননা আমাদের দেশে প্রশাসনিক কোনো তদন্তের রিপোর্ট জনসমক্ষে প্রকাশিত হয় না। প্রকাশিত হলেও দায়ী ব্যক্তিরা শাস্তি পাবেন এমন নিশ্চয়তা নেই। কেননা যাঁরা অভিযোগ তদন্ত করবেন আর যাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে, তাঁরা একই গোত্রের লোক। পুলিশ বিভাগের চুরি-দুর্নীতি তদন্তের একই পরিণতি।

মুক্তিযোদ্ধা সনদ নিয়ে চাকরির মেয়াদ বাড়ানো যেমন অনৈতিক, তেমনি এর সঙ্গে হাজার হাজার মেধাবী তরুণের ভাগ্য-বিপর্যয়ও জড়িত। সরকার সরকারি চাকুরেদের মেয়াদ বাড়িয়েছে, তার পক্ষে যুক্তি আছে। বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু বেড়েছে, তাঁদের কর্মক্ষমতা বেড়েছে। এ ক্ষেত্রে তরুণদের অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই। কিন্তু ভুয়া সনদধারী একজন সরকারি কর্মকর্তা এক বছর চাকরির মেয়াদ বাড়িয়ে নিলে এক বছর সেই পদটিতে কেউ আসার সুযোগ পাবেন না। ফলে চাকরিপ্রার্থী মেধাবী তরুণকে আরও এক বছর অপেক্ষা করতে হবে।

এমনিতেই সরকারি চাকরিতে মেধাবীদের প্রবেশের সুযোগ কমে গেছে। বর্তমানে পিএসসির কোটা প্রথায় ৫৫ শতাংশ নেওয়া হয় কোটার ভিত্তিতে, যার মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা এবং তাঁদের পোষ্যদের কোটা ৩০ শতাংশ, নারী কোটা ১০ শতাংশ এবং আদিবাসী কোটা ৫ শতাংশ, জেলা কোটা ১০ শতাংশ। এদের মধ্যে নারী ও আদিবাসী কোটার বাইরে অন্যান্য কোটা রাখার যুক্তি আছে বলে মনে করি না। ঘরোয়া আলাপে সরকারের নীতিনির্ধারকেরাও এই সত্য স্বীকার করেন, কিন্তু সিদ্ধান্ত নেন না। বর্তমানে জনপ্রশাসনে যে মেধাবী ও চৌকস কর্মকর্তাদের আকাল পড়েছে, তার অন্যতম কারণ এই কোটাপদ্ধতি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে কোটাপদ্ধতি সংস্কারের জন্য একটি কমিটি হয়েছিল, তারা সুপারিশও করেছিল। কিন্তু রহস্যজনক কারণে সেই সুপারিশ আজও আলোর মুখ দেখেনি। অদূর ভবিষ্যতে দেখা যাবে, সেই সম্ভাবনাও নেই।

ক্ষমতাসীনেরা নিজেদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সরকার বলে দাবি করে। মুক্তিযুদ্ধের সত্যিকার চেতনা হলো সাম্য ও সমতা। রাষ্ট্র কোনো জনগোষ্ঠীর সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণ করবে না। কোটাপদ্ধতির মাধ্যমে রাষ্ট্র তাদের প্রতিই চরম বৈষম্যমূলক আচরণ করছে, যারা মেধাবী, যারা লেখাপড়ায় ভালো করেছে। রাষ্ট্র তাদের সুযোগ না দিয়ে অপেক্ষাকৃত কম মেধাবীদের সুযোগ দেওয়ার জন্যই হরেক কিসিমের কোটাপদ্ধতি চালিয়ে দিয়েছে।

মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের দেশের গৌরব। তাঁদের যথাযোগ্য সম্মান ও মর্যাদা দেওয়া হোক, সেটা আমরাও চাই। তাই বলে সেই মুক্তিযোদ্ধাদের নাম ভাঙিয়ে অসাধু ব্যক্তিদের রাষ্ট্রীয় সুবিধা হাতিয়ে নেওয়ার পথ অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদ নিয়ে যাঁরা চাকরির মেয়াদ বাড়িয়েছেন এবং রাষ্ট্রীয় সম্পদ হাতিয়ে নিয়েছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে সরকার কী ব্যবস্থা নেয়, সেটাই এখন দেখার বিষয়। মুক্তিযোদ্ধা সনদ নিয়ে যে মহাবাণিজ্য হয়েছে, সে ব্যাপারে সন্দেহ নেই। এই বাণিজ্য বন্ধ হোক। মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের দিয়ে তদন্ত কমিটি করলে আসল সত্য জানা যাবে না। তাই বিচার বিভাগীয় তদন্ত হোক। দোষীদের শাস্তি দেওয়া হোক। তাতে শহীদ ও প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মা শান্তি পাবে।

সেটি করতে পারলে কেউ আর মুক্তিযোদ্ধাদের নাম নিয়ে অসাধু ব্যবসা করতে পারবে না।

সংবিধানের ২৯(১) অনুচ্ছেদে আছে, ‘প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদলাভের ক্ষেত্রে সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা থাকিবে।’

সরকার নানাভাবে এই সমতার ব্যত্যয় ঘটিয়েছে। সরকারি কর্মকমিশনে কোটা প্রথা চালু নিশ্চয়ই এই সমতার ব্যত্যয়। পিএসসি যেই যুক্তিতে ৩৪তম বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় কোটাপদ্ধতি চালু করেছে, সেই যুক্তিতে কোটা বাতিল বা খর্ব হওয়া উচিত। যদি বিশেষ কোটায় যোগ্য প্রার্থীই পাওয়া না যায়, সেখানে কোটা রাখার কী যুক্তি থাকতে পারে? পিএসসিকে বুঝতে হবে, বৈষম্যমূলক সমাজে কোটাব্যবস্থা থাকে বৈষম্য কমাতে, বাড়াতে নয়, কিংবা অমেধাবীদের পুনর্বাসন করতেও নয়। মেধা প্রথা পুরো হয়তো বাতিল করা যাবে না কিন্তু এর ব্যাপক সংস্কারের প্রয়োজন। যেই কোটাপদ্ধতিতে পাস করার মতো প্রার্থী পাওয়া যায় না, সেই পদ্ধতির সংস্কার জরুরি। তারও আগে সংস্কার প্রয়োজন পিএসসি নামের প্রতিষ্ঠানটির। তাহলে মেধাবীশিক্ষার্থীরা ভরসা পাবে, জনপ্রশাসনও মেধার দুর্ভিক্ষ থেকে রেহাই পাবে।

প্রকাশকাল: ৩১ জানুয়ারি, ২০১৪