উল্টো পথে আওয়ামী লীগ

একটি রাজনৈতিক দলের মূল শক্তি নেতা-কর্মী বা সমর্থক নয়, মূল শক্তি হলো তার নীতি ও আদর্শ। ৬৪ বছর বয়সী আওয়ামী লীগ নানা ঝড়ঝঞ্ঝার মধ্যে টিকে আছে এ কারণে যে, নানা বিচ্যুতি সত্ত্বেও দলটি মোটামুটি একটি অবস্থান নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পেরেছে; অনেক বাম দলই যেখানে আত্মা ও আত্মপরিচয়কে বিসর্জন দিয়েছে। কিন্তু ইদানীং আওয়ামী লীগের নেতা-নেত্রীদের মুখে সকালে এক কথা, বিকেলে আরেক কথা শুনে মনে হচ্ছে, সেই অবস্থানটি আর নেই। নেতৃত্ব বুঝতে পারছেন না যে কী করবেন। নেতারা একবার বলেন, বিরোধী দলের সঙ্গে আলোচনা করে আগামী নির্বাচনসহ সব সমস্যার সমাধান করবেন। আরেকবার বলেন, আলোচনার কী আছে; বিশ্বের অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশে যে পদ্ধতিতে নির্বাচন হয়, বাংলাদেশেও সেই পদ্ধতিতে নির্বাচন হবে।

এবার মে মাসটির শুরুই হয়েছিল আশা-নিরাশার দোলাচলে; যদিও কয়েক দিন আগেই সাভারে ঘটেছিল ভয়াবহ মানবসৃষ্ট মহাদুর্যোগ। এই দুর্যোগের খলনায়কেরা ধরা পড়লেও তাঁরা যে শেষ পর্যন্ত শাস্তি পাবেন, সে কথা অনেকেই বিশ্বাস করেন না। আগামী নির্বাচনের মতো এটিও শেখ হাসিনার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করি। সাভারে ভবনধসের প্রেক্ষাপটে তিনি বিরোধী দলের প্রতি ২ মে আহূত হরতাল প্রত্যাহারের অনুরোধ জানালে খালেদা জিয়া তাতে সাড়া দেন এবং তাঁকে বিরোধী দলের দাবির প্রতি সাড়া দেওয়ার অনুরোধ জানান। একই দিন ঝালকাঠি জেলা আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে প্রধানমন্ত্রী বিরোধী দলের নেতার আহ্বানের প্রত্যুত্তরে বলেন, ‘আসেন, বসি, আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করি। সেটা যেখানেই হোক। তবে সংসদে এসে আলোচনা করলে ভালো হয়। সংসদ আলোচনার উপযুক্ত স্থান এবং নিরাপদ জায়গা।’ (প্রথম আলো, ৩ মে, ২০১৩) হরতাল প্রত্যাহার করায় খালেদা জিয়াকে দুই-দুবার ধন্যবাদও জানান শেখ হাসিনা। বাংলাদেশের দীর্ঘদিনের বৈরী ও বিদ্বিষ্ট রাজনীতির পটভূমিতে পারস্পরিক এই উদারতা ও সহিষ্ণু বক্তব্য জনমনে কিছুটা হলেও আশা জাগিয়েছিল, তাহলে নেতা-নেত্রীদের সুমতি হয়েছে।

ওই দিনই বিকেলে অফিসার্স ক্লাবে এক অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম আরেক ধাপ এগিয়ে বললেন, ‘দু-এক দিনের মধ্যেই সংলাপের জন্য বিরোধী দলকে আনুষ্ঠানিক চিঠি দেওয়া হবে।’ এরপর ৩ মে শেখ হাসিনা হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফা নিয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে আবার আলোচনার ওপর গুরুত্ব দিয়ে বললেন, ‘বিরোধী দলকে যথাসময়ে সংলাপের আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব দেওয়া হবে।’

৪ মে শাপলা চত্বরে বিরোধী দলের নেতা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি মানতে ৪৮ ঘণ্টার আলটিমেটাম দেওয়ার পরও সরকারি দলের নেতারা বলেছিলেন, ‘আলোচনার দরজা খোলা থাকবে।’ কিন্তু এখন দেখছি, সেই দরজা খোলার কোনো উদ্যোগ নেই। চিঠি লেখা কিংবা বিরোধী দলকে আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব দেওয়ার চিন্তাও আপাতত বাদ দিয়েছে সরকারি দল।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক সমস্যা নিয়ে আলোচনার জন্য জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুনের আগ্রহে সংস্থাটির সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকোর নেতৃতে আরেকটি প্রতিনিধিদল ঢাকায় আসে ১০ মে। তাঁরা দুই দলের শীর্ষ নেত্রী ছাড়াও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি ও সাংবাদিকদের সঙ্গে বৈঠক করেন। তাঁরা অব্যাহত সংঘাত থেকে বেরিয়ে আসতে সংলাপের ওপর জোর দেন। জাতিসংঘের প্রতিনিধিরা দ্বিতীয় দিন যখন ক্ষমতাসীন দলের দুই নীতিনির্ধারকের সঙ্গে আলোচনা করে দ্বিতীয়বারের মতো বিরোধী দলের নেতার সঙ্গে বৈঠক করেন, তখন অনেকেই মনে করেছিলেন, সুড়ঙ্গের শেষে বোধ হয় মৃদু আলো আছে। এমনকি বিরোধী দল শর্ত ছাড়াই আলোচনায় সম্মত বলে গণমাধ্যমে খবর এসেছে। এর আগে বিএনপির নেতারা আলোচ্যসূচি ঠিক করার ওপর জোর দিয়ে আসছিলেন। ঢাকা ত্যাগের আগে সংবাদ সম্মেলনে অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো বলেন, ‘সময় দ্রুত চলে যাচ্ছে। এখনই সংলাপে বসুন।’

বিদেশি বন্ধুরা আমাদের রাজনৈতিক সমস্যা নিয়ে যতই উদ্বিগ্ন হোন না কেন, দেশের নীতিনির্ধারকদের সেসব নিয়ে আদৌ মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয় না। ১৯৯৪ সালে স্যার স্টিফেন নিনিয়ানের আলোচনার উদ্যোগও ভেস্তে গিয়েছিল দুই পক্ষের অনড় মনোভাবের কারণে। কেহ কারে নাহি ছাড়ে সমানে সমান।

প্রধানমন্ত্রীসহ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও ১৪ দলের নেতাদের কথাবার্তায় মনে হচ্ছে, ‘হয় তাঁরা সমস্যাটি উপলব্ধিই করতে পারছেন না অথবা উপলব্ধি করলেও গায়ের জোরেই তার একটি সমাধান বের করতে চাইছেন। গায়ের জোরে কিংবা নিছক সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরেও গণতন্ত্র চলে না। গণতন্ত্র চলে পারস্পরিক আস্থা ও বোঝাপড়ার ভিত্তিতে। একটি সরকার গণতান্ত্রিক কি না, তার বড় পরীক্ষা সেই সরকারের প্রতি বিরোধী দলের আস্থা-অনাস্থার ওপর। আর বিরোধী দল মানে কয়েকজন নেতা বা তাঁদের সমর্থক-কর্মীরা নন, বিরোধী দল হলো সরকারের সঙ্গে দ্বিমত পোষণকারী বিশাল জনগোষ্ঠী। সরকার সমস্যার যে সমাধানই করুক না কেন, সেই জনগোষ্ঠীকে আস্থায় এনেই তা করতে হবে। মনে রাখতে হবে, প্রধানমন্ত্রী কিংবা সরকারি দলের নেতারা এখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিরুদ্ধে যেসব যুক্তি দাঁড় করাচ্ছেন, বিএনপি ক্ষমতায় থাকতে খালেদা জিয়া ও তাঁর সহকর্মীরাও একই যুক্তি দিতেন।

আমরা বুঝতে অক্ষম, গত ১০ দিনে এমন কী ঘটল যে সংলাপ নিয়ে সরকারি দল প্রায় বিপরীতমুখী অবস্থান নিল? তারা কি মনে করছে, বিরোধী দলের সঙ্গে আলোচনা করলেই সরকার নৈতিকভাবে পরাজিত হবে? সরকারি দল অনির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে দেশ শাসনের ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়া যায় না বলে যে যুক্তি দেখাচ্ছে, সেই যুক্তি আলোচনার টেবিলে তুলতে অসুবিধা কোথায়? তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার দুর্বলতা ও ত্রুটিগুলোও তারা উপস্থাপন করতে পারে। তত্ত্বাবধায়ক ছাড়া কীভাবে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করা যাবে, সেই প্রতিবিধান ক্ষমতাসীনেরা এখনো দিতে পারেনি। তবে অন্তর্বর্তী সরকারের ধারণা দিয়ে তারা কিন্তু প্রকারান্তরে স্বীকার করে নিয়েছে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় দলীয় সরকারের অধীনে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়।

ক্ষমতাসীনদের এও বুঝতে হবে যে কেবল এক-এগারোর ধুয়া তুলে কিংবা দুই বছরের অসাংবিধানিক তত্ত্বাবধায়কের ভয় দেখিয়ে মানুষের মনোভাব বদলানো যাবে না। সে ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী তাঁর প্রস্তাবিত অন্তর্বর্তী সরকারের একটি রূপরেখা দিতে পারেন। স্পষ্ট করতে পারেন সেই সময়ের জনপ্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অবস্থান কী হবে, তা-ও। আওয়ামী লীগের দাবি, বর্তমান সরকারের আমলে স্থানীয় সংস্থার সাড়ে পাঁচ হাজার নির্বাচন হয়েছে। কিন্তু এই নির্বাচনের মাধ্যমে তো ক্ষমতার পরিবর্তন হয়নি। জাতীয় নির্বাচনে ক্ষমতার পরিবর্তন হবে, এ কারণেই প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সর্বোচ্চ নিরপেক্ষতা জরুরি। তা ছাড়া ৩৬ শতাংশেরও বেশি ভোটারকে (বিএনপি ও জামায়াত-সমর্থক) বাইরে রেখে কি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব? ১৯৮৬ সালে আওয়ামী লীগ-জাতীয় পার্টি-জামায়াত মিলে পারেনি, ১৯৯৬ সালে বিএনপি পারেনি, ২০১৩ সলে আওয়ামী লীগ বা মহাজোট পারবে, তার নিশ্চয়তা কী? সবার অংশগ্রহণে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের বিকল্প হলো ১৫ ফেব্রুয়ারির মতো আরেকটি নির্বাচন করা। বিএনপি যে নির্বাচন করে ১৭ বছর ধরে নিন্দিত ও সমালোচিত হচ্ছে, সে ধরনের নির্বাচন আওয়ামী লীগ করবে কি না, সেটাই তাদের ভেবে দেখতে হবে।

আওয়ামী লীগের কোনো কোনো নেতা ৫ মে হেফাজতের সরকার উৎখাতের চক্রান্তের সঙ্গে বিএনপি-জামায়াতের যোগসাজশের কথাও বলছেন। দেশের বৈধ সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্রের সঙ্গে কেউ জড়িত থাকলে সরকার অবশ্যই তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারে। সেই এখতিয়ার তাদের আছে। কিন্তু তার সঙ্গে আগামী নির্বাচন নিয়ে বিরোধী দলের সঙ্গে আলোচনাকে যুক্ত করা কোনোভাবেই সমীচীন নয়। জাতিসংঘের প্রতিনিধিরা এসেছিলেন ৫ মে হেফাজতের নারকীয় তাণ্ডবেরই পর, আগে নয়।

সম্প্রতি অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহান, যিনি ১৯৯৫ সালে দুই নেত্রীর সঙ্গে আলোচনাকারী জি-৫ গ্রুপের অন্যতম সদস্য ছিলেন, লিখেছেন, ‘এখন শেখ হাসিনা যেমন করে বলছেন, তখন খালেদা জিয়াও তেমন করে বলতেন যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন একই সঙ্গে সংবিধানের লঙ্ঘন এবং নির্বাচিত গণতন্ত্রের নীতির বরখেলাপ।’ (প্রথম আলো, ১৪ মে, ২০১৩)।

সেদিন খালেদা জিয়া উপলব্ধি করতে পারেননি, তাঁর ভাষায় ‘অসাংবিধানিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের’ চেয়েও বিরোধী দলকে নির্বাচনী প্রক্রিয়ার বাইরে রেখে একটি নির্বাচন করা গণতন্ত্রের জন্য বড় হুমকি। মানুষের জন্য গণতন্ত্র এবং তা রক্ষার জন্যই সংবিধান। জনগণের ওপর অগণতান্ত্রিক শাসন চাপিয়ে দিয়ে সংবিধান সংশোধন করে যে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা যায় না, তার প্রমাণ আমাদের সংবিধানের চতুর্থ, পঞ্চম, সপ্তম ও অষ্টম সংশোধনী। পঞ্চদশ সংশোধনী গণতন্ত্রের রক্ষাকবচ হবে কি না, তার প্রমাণ ভবিষ্যৎ দেবে।

এ মুহূর্তে সরকারের কর্তব্য হলো বিরোধী দলের সঙ্গে আলোচনায় বসে আগামী নির্বাচনের ব্যাপারে একটি সমঝোতায় আসা। সেই প্রায়-অসম্ভব কাজটি শেখ হাসিনা করতে পারলে ইতিহাস তাঁকে মনে রাখবে। না পারলে ভবিষ্যতে হয়তো এই সংশোধনী বাতিলের দাবিতে তাঁকেই রাজপথে নামতে হবে। এখন যাঁরা সহযোগী হিসেবে তাঁকে অনড় ও অনমনীয় থাকার সুপরামর্শ দিচ্ছেন, সে সময় তাঁদের অনেককেই খুঁজে পাওয়া যাবে না।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রায়ই বলেন, আওয়ামী লীগ জনগণের মধ্য থেকে উঠে আসা দল এবং জনগণই তাদের প্রধান শক্তি। তাহলে সেই দলের বিরোধী পক্ষের সঙ্গে আলোচনায় বসতে অসুবিধা কোথায়?

তাঁকে মনে রাখতে হবে, আগামী নির্বাচনই বাংলাদেশের এবং আওয়ামী লীগের জন্য শেষ নির্বাচন নয়।

প্রকাশকালঃ মে ১৭, ২০১৩।