এপ্রিল ১৯৭১

১ এপ্রিল (বৃহস্পতিবার)
রাত ৮টা
এইমাত্র রেডিও পাকিস্তান করাচীর সংবাদে বলা হলো, হিন্দুস্তানী সেনা পাকিস্তান সীমান্তে অনুপ্রবেশ করেছে। গত রাতে নারিন্দার গৌড়ীয় মঠ, বাসাবো, বাড্‌ডায় আগুন জ্বালিয়েছে। আজ তেজগাঁয়ের খাদ্যগুদাম থেকে সমস্ত চাল-সরানোর সংবাদ পাওয়া গেল। চাটগাঁর কোনো খবর নেই। কারফিউ চলছে। প্লেন এর আসা যাওয়ার বিরাম নেই। কাল থেকে নাকি ব্যাঙ্ক সব খোলা হবে।
আট আনায় ৩টি পান কিনলাম।
বাংলার ইতিহাস কে রচনা করবে?

২ এপ্রিল (শুক্রবার)
রাত ৮টা
গত রাতে জিঞ্জিরায় জমা অসহায় গৃহহীন নরনারীর উপর বোমা বেয়নেট গোলাগুলী বর্ষিত হয়। মিল ও কিছু কারখায় আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। আজ সকাল সাড়ে ৫টা থেকে ৬টা পর্যন্ত ঢাকায় কামান গুলীর শব্দ শোনা গেছে। র‍্যাঙ্কিন স্ট্রীটে হিন্দু বাড়ীতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে। রেডিও পাকিস্তান থেকে সীমান্তে ভারতীয় সৈন্য প্রবেশ অব্যাহত এবং সিলেট, চুয়াডাঙা, দিনাজপুর, যশোর, কুমিল্লা সীমান্তে ভারতীয় অস্ত্র সরবরাহ অব্যাহত বলে ঘোষণা করা হয়। ঢাকা শহর ও পুর্ব পাকিস্তানের অন্যান্য শহরে শান্তিময় পরিবেশ বলেও ঘোষিত হল। কি পরিহাস! নির্লজ্জ উক্তি! এর উত্তর কি দেওয়া যায়, কে দিতে পারে?

৩ এপ্রিল (শনিবার)

রাত ৯টা
কাল সারারাত ও আজ দিনেও কোনো গোলমাল শোনা যায়নি। কিন্তু ৬টায় কারফিউর পরেই গোলার আওয়াজ শোনা গেল। আজ লুলুরা বাড়ী এল। ৮ দিনের পর। দুলুদের খবরটাও যদি পেতাম। যশোর কুষ্টিয়ার খবর ভালো নয়। কিছুই জানা যাচ্ছে না। কোথায় কি হচ্ছে। সংঘাতে সংগ্রামে অন্তর ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায়, তার মধ্যেও আসে কোথা থেকে করুণ মধুর রস সঞ্চার। কিন্তু তাও সহ্য করার সাথী নেই। আমি চিরকালের বোকা, কিন্তু সবার কাছে শুনে শুনে আরও বোকা হয়ে যাচ্ছি। কাউকে খুশী করতে পারলাম না।

৪ এপ্রিল (রবিবার)
রাত ১০টা
গত রাতে সাড়ে ৯টায় গোলার শব্দ শুরু হল। সারারাত অবিরাম শব্দ পাওয়া গেছে। কোথায় কি হয়েছে জানা যায়নি। সারাদিন সারারাত প্লেন উড়ছে। রাশিয়ান কনসাল জেনারেল রাও ফরমান আলীর সাথে দেখা করেছেন। প্রতিবাদও করা হয়েছে। ভারতীয় বেতার বহু আশা ও আশ্বাসবাণী প্রচারিত করেছে, কার্যকালে কি হয় জানা যাবে কখন? গণহত্যা জিঞ্জিরায়ও শুরু হয়েছে। আজ সকালেও জিঞ্জিরার দিক হতে গোলাগুলীর শব্দ পাওয়া গেছে। চাটগাঁর কোর্টে খবর নেই। আল্লাহ নেগাহ্‌বান। আজ অনেক আমেরিকান, বৃটিশ ও অন্য বিদেশী পরিবার ঢাকা ছেড়ে গেলেন।

৫ এপ্রিল (সোমবার)
রাত ৮টা
গতরাতে কোথায় যেন মেশিনগান চলেছে। নরসিংদিতে রাতে ধ্বংসলীলা চলেছে। সকাল ৫টা থেকে রাত সাড়ে ৭টা পর্যন্ত কারফিউ মওকুফ করা হয়েছে। ঢাকার রাস্তায় লোক নেই। বাজার দোকান অস্বাভাবিকরূপে চলছে। রেডিও পাকিস্তান থেকে শান্তিপূর্ণ জীবনযাত্রা চলছে বলে ঘোষিত হচ্ছে। কত মায়ের বুক খালি করে। সোনার সংসারকে ধ্বংস করে চলছে এখনও, আর শান্তির কথা বলছে! নির্লজ্জ! এদের আত্মসম্মানও নেই।

৬ এপ্রিল (মঙ্গলবার)
রাত ১০টা
গতরাতে ২টা পর্যন্ত অবিরাম প্লেন উড়েছে। নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদি ধ্বংস হয়েছে। আজও নারায়ণগঞ্জে আগুন জ্বলছে। অন্য কোথায় কি হচ্ছে, খবর আর পাওয়া যাচ্ছে। আমেরিকানরা বাড়ী রেখে, পরিবার পি, আই. এর প্লেনে পাঠিয়ে দিয়েছে। আজ সারা সকাল প্লেন উড়েছে। গোলাগুলীর শব্দ পাওয়া গেছে খুব কম, অনেক দূরে। দম বন্ধ করা অস্বাভাবিক আবহাওয়ার ঢাকার আকাশ বাতাস ভার। কালরাতে খুব বৃষ্টি হয়েছে। আজ জ্যোৎস্না প্লাবিত ধরা, কত মার বুক খালি, ঘর অন্ধকার।

৭ এপ্রিল (বুধবার)
রাত ৮টা
আজ সকালে জমিলারা করাচী চলে গেল। কত মানুষ যে ঢাকা ছেড়ে, বাংলাদেশ ছেড়ে গেল। ঘোড়াশালের সার ফ্যাক্টরী বন্ধ বলে রাশিয়ান কর্মচারী অনেকেই আজ গেল। আজ রাশিয়ান নেতা পদগর্নির হুঁশিয়ারির বাণী দৈনিক পাকিস্তানে দিয়েছে, সাথে ইয়াহিয়ার প্রতিবাদও দিয়েছে। মিথ্যাবাদীরা নাকি মুসলমান, পাকিস্তানী, এত মিথ্যা বলতে পারে। মাহমুদ আলী, হামিদুল হকের বিবৃতিও উঠেছে। ভীরু ভীতু শয়তানের গোলামরা যে কি করে এসব কথা বলে। আজ ঢাকা থমথমে, বেশী প্লেনও উড়ছেনা। গুলীগোলার শব্দ নেই। ফতুল্লা থেকে ডেমরা পর্যন্ত সাঁজোয়া বাহিনী ওৎ পেতে আছে শোনা গেল। চাটগাঁর কোনো খবর নেই।

৮ এপ্রিল (বৃহস্পতিবার)
রাত ১০টা
সারাদিন প্লেন উড়ছে। বেতারে নানা বেচাল প্রচারিত হচ্ছে। বীভৎস মৃত্যুর অন্ত নেই। আজ সৈন্যবাহিনী আরিচামুখী। সমস্ত দেশ ধ্বংস করে দেশে স্বাভাবিক অবস্থা প্রচার করছে তারা কি মানুষ? রাত ৯টায় কারফিউ হয়েছে। কিন্তু রাস্তাঘাট সন্ধ্যা থেকে নিঝুম। এ নীরবতা মৃত্যু শীতল ভয়াবহ। তবুও প্রচারের অন্ত নেই যে, দেশ স্বাভাবিকভাবে চলছে।
আজ ৮ তারিখ, বিবাহিত জীবনের বৃত্রিশ বছর পূর্ণ হল। কত পথ- কত কাল পাড়ি দিয়ে এলাম। আরও কতকাল যে বাঁচব। চাটগাঁর কোনো খবর নেই, শাব্বীরের চিঠি নেই। সিলেটের খবর নেই।

৯ এপ্রিল (শুক্রবার)
রাত ১১টা
কাল সারারাত আজ সারাদিন প্লেন উড়ছে। কারফিউ থাকা সত্ত্বেও ১০টায় কাছেই গুলীর আওয়াজ পাওয়া গেল। সন্ধ্যায় আগুন ধূম দেখা গেল হয়ত ২ বা ৩ নং রাস্তার দিক থেকে। সব ট্রাক বোঝাই মিলিটারী আরিচার দিকে কাল গেছে। আজও শহর নীরব নিঝুম। কোথাও কোনো খবর নেই। বিদেশী রেডিও শুধু সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন, আর হুশিয়ারি বাণী প্রেরণ করছেন। পাকিস্তানী রেডিও শুধু মিথ্যা প্রচার করেই কর্তব্য সমাপ্ত করছেন। এই নাকি পাকিস্তান! ইসলামী রাষ্ট্র!

১০ এপ্রিল (শনিবার)
রাত ৯টা
আজ জানা গেল কাল সন্ধ্যায় নিউ মার্কেটের কাঁচা বাজারটা পুড়িয়েছে। এখানে ওখানে হত্যাকাণ্ড চলছে। সারা দুনিয়ায় মানুষকে মিথ্যা সংবাদ দিচ্ছে রেডিও পাকিস্তান এবং খবরের কাগজগুলো। চোখে দেখছি ঢাকার অবস্থা, শোকে ক্ষোভে অসহায়তায় মানুষ অস্বাভাবিক হয়ে গেছে। আর, রেডিওতে মিথ্যা প্রচার হচ্ছে। বি বি সি, ভোয়া, ইন্ডিয়া রেডিও থেকে সবাই জেনে নিচ্ছে সত্যিকার অবস্থা ঢাকার। গতকাল টিক্কা খান বি. এ. সিদ্দিকীর কাছে শপথ নিয়ে গভর্ণর হল। বোমারু প্লেন উড়ছে, বোমা ফেলে আসছে, চাটগাঁ, রাজশাহী, খুলনা। দিনাজপুর, সিলেট, কুষ্টিয়ার খবর সঠিক কেউ বলতে পারছে না। আজ নাকি নৌবহর সেনা বরিশাল গেছে।

১১ এপ্রিল (রবিবার)
রাত ৯টা
আজ চাটগাঁয়ের কিছু খরব পেলাম, মন্দের ভালো। আল্লাহ নেগাহ্বান। ফেনীতে নাকি ২টা বোমারু বিমানের পতন হয়েছে, লালমনিরহাট, কুষ্টিয়া অন্য অন্য জায়গায় নাকি মুক্তিসেনারা জয়ী হচ্ছে। হচ্ছে কিন্তু নিরস্ত্র মানুষ কত যুঝবে? সারারাত প্লেন উড়েছে। বিকাল থেকে কিছুটা কম। আজ ঢাকায় আদেশ দেওয়া হয়েছে যানবাহন, ই. পি. আর. টি. সি’র রুট খোলা হয়েছে, কিন্তু মানুষ কোথায়? আসছে যাচ্ছে কারা? ভয় নয় ভীতি নয়, ঘৃণা ও মৃত্যুর জন্য শূন্য জনপদ।

১২ এপ্রিল (সোমবার)
রাত ৯টা
৩দিন থেকে প্রবল বৃষ্টির জন্য দু’দিন বোম শেল-এর শব্দ শোনা যায়নি, কাল সারারাত বৃষ্টির জন্যই হয়ত প্লেনও ওড়েনি। বেতারে খবর পাওয়া গেল শিলাইদহর রবীন্দ্রনাথের কুঠিবাড়ীতেও বোমা ফেলেছে। প্রচণ্ড যুদ্ধ ওদিকে চলছে। ঢাকার রাস্তাঘাট জনশূন্য। সদরঘাট টারমিনালে লঞ্চ, নৌকা জাহাজ কিছুই নেই। শহর ছেড়ে অসহায় গ্রামবাসীদের ধ্বংস করার জন্য ঢাকায় সামরিক অত্যাচার খুব বেশি শোনা যাচ্ছে না। অনেক প্রসিদ্ধ নাগরিক, ধনিক, ব্যবসায়ীদের আকস্মিক ধরপাকড়ের কথা শোনা যাচ্ছে। সঠিক কোনো খবর নেই। মীরপুরের কোনো খবর পেলাম না। আজ অবজারভারে বন্দী দেশ নেতার- মুজিবুর রহমানের ছবি দেখা গেল। হোক বন্দী, তবু যেন বেঁচে থাকে। মেঘ কেটে যাচ্ছে, আবার সূর্য উঠবে। আল্লাহ যেন দীর্ঘপরমায়ু দেন।

১৩ এপ্রিল (মঙ্গলবার)

চুয়াডাঙ্গা স্বাধীন বাংলার রাজধানী, শেখ মুজিবুর রহমান প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন। নজরুল ইসলাম, মনসুর আলী, কামরুজ্জামানকে নিয়ে মন্ত্রী পরিষদ গঠিত হয়েছে। ভারতীয় বেতার থেকে প্রচারিত, অষ্ট্রেলিয়ান বেতার থেকে সমর্থিত। খবর সত্য নিশ্চয়ই আল্লাহ জানেন। শাহজালালের দরগা ধ্বংস করারও খবর পাওয়া গেল। প্ৰবল গোলাবর্ষণে চাঁদপুর, সিলেট, রাজশাহী, পাবনা, চট্টগ্রাম বিধ্বস্ত। বৃষ্টির দরুন বাংলায় সেনাবাহিনীর অসুবিধার কথাও বলা হয়েছে। ভারত, রাশিয়া বাংলাকে সাহায্য করতে ইচ্ছুক। সিলেটের বিমানবন্দরে শালুটিকরের রাডার যন্ত্র বাংলা বাহিনী নষ্ট করে দিয়েছে। দিনাজপুরে প্রচণ্ড বোমাবর্ষণ চলেছে।

১৪ এপ্রিল (বুধবার)
রাত ১০টা
গতকাল ১৪০ জনের শান্তি মিছিল। পথে পথে শান্তির বাণী শুনিয়ে রাতে চকবাজার পুড়িয়েছে। সারাদিন বোমারু বিমান হেলিকপ্টার উড়েছে। সাভার থেকে এসে দুধওয়ালারা মীরপুর পুলের উপর রক্ত স্রোত দেখে ফিরে গেছে। সিলেট দিনাজপুর নাকি আবার মুজিব বাহিনীর হাতে এসেছে। ঢাকা থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে প্রচণ্ড যুদ্ধ চলছে পাক-মুজিব বাহিনীতে। কিন্তু কোথায় সঠিক জানা যায়নি। বৃষ্টি থেকে থেকে ঝরছে। ভাইয়ার খবরও পেলাম। রাতে ৩দিন ধরে কোড, এ কারা কথা বলে বোঝা যায়না। পৌনে বারটা থেকে প্রায় সাড়ে বারোটা পর্যন্ত চলে।

১৫ এপ্রিল (বৃহস্পতিবার)
রাত ১০টা
আজ ১লা বৈশাখ। নববর্ষ, ১৩৭৬ সনের প্রথম দিনে। প্রতি বত্সর ভোরে রমনার ফুল পাতা শোভিত বটের ছায়াতলে নববর্ষ উৎসব অনুষ্ঠান হত। আজ সকালটা বিষণ্ণ মলিন, রাতে বৃষ্টি হয়েছে। ভোর থেকে প্লেনে বোমা ফেলছে মধুপুর, আখাউড়া, ব্রাহ্মণবাড়ীয়া, গঙ্গাসাগর, সমস্ত দেশব্যাপী। শয়তানীর সীমা আছে। গুটিয়ে আনতে হবে একদিন ওদের অত্যাচারের ফাঁদ। লাখ মানুষের জীবনদান ব্যর্থ হবে না, আজ নববর্ষে এ প্রার্থনা সর্বমানুষের অন্তর থেকে ধ্বনিত হচ্ছে। মুজিব জিন্দাবাদ। বাংলার সন্তান, শহীদেরা অমর। নববর্ষে যেন সূচিত হয় বাঙালীর নবজীবনের দীপ্তিময় পথের সূচনা।

১৬ এপ্রিল (শুক্রবার)
রাত ১১টা
আজ বৃষ্টি নেই। সিলেট ময়মনসিংহ, কসবা, চুয়াডাঙায় বোমাবর্ষণ চলেছে। ঢাকা আজও অস্বাভাবিক। খবরের কাগজে খুব মিথ্যা প্রচারণা চলছে। কাল সন্ধ্যায় মাগরেবের আজান হচ্ছে আর নিউমার্কেট-এর পিছনের বস্তিতে আগুন জ্বলছে। কাল বেলা ১১টায় আঠার নম্বরের ওদিকে এক বাড়ীতে গুলী চলেছে মানুষ মেরেছে, ঘরে বসে শব্দ শুনলাম, আগুন দেখলাম। শহীদ মিনারকে মসজিদ বানাচ্ছে। গত পরশু রাত ও দিনে ভারত থেকে কামরুল সত্য ঘটনা বলেছে। ওরা বাঁচুক। আর কে যে কোথায় ঘর ছাড়া দেশ ছাড়া। আল্লাহ্ ওদের নেগাহ্বানী করবেন। শাব্বীরের কোনো চিঠি পাচ্ছি না। আজ শমুরা চলে গেছে। ভালোভাবে যেন গিয়ে পৌঁছায়।

১৭ এপ্রিল (শনিবার)
রাত ১০টা
দুপুর ৩টা থেকে বৃষ্টি হচ্ছে, এও আল্লাহর রহমত। কসবা, আখাউড়া, ব্রাহ্মণবাড়ীয়ায় প্রচণ্ড গোলাবর্ষণ হচ্ছে। কোথাও কোনো পথঘাট খোল নেই। কাগজে জঘন্য মৃত্যুর প্ররোচনা, মিথ্যা প্রচার চলছে। মেহেরপুরে স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠার কথা শোনা গেল। যে যেখানে আছে যেন আল্লাহ হেফাজতে রাখেন। বড় দুঃখ, বড় শোকের ব্যাপার, মেহেরুন নেসা, তার মা, দুই ভাইকে হত্যা করা হয়েছে। আল্লাহ যেন এই নিস্পাপ অসহায়দের রক্তের বিনিময়েই বাংলাদেশকে স্বাধীন করেন। আর কত রক্ত, কত প্রাণ দিতে হবে! বাংলার লাখ লাখ মানুষ কাদের হাতে কোন মোনাফেকের হাতে মরছে। আল্লাহ কি দেখছে না!

১৮ এপ্রিল (রবিবার)
রাত ৯টা
আজ বিকাল ৪টা ফোনের উপর ফোন করে নুরুল কাদের এডভোকেট আমাদের বাড়ী আছে কিনা, কোথায় সে থাকে জিজ্ঞাসাবাদ হল। আমি আওয়ামী লীগের মেম্বার কিনা উনি মেম্বার কিনা, আমি কি করি, কখন কোথায় থাকি, রিলিফে কোথায় কোথায় গিয়েছি, এন্টি পার্টি করি কিনা জিজ্ঞাসা করল, বাড়ীর ঠিকানা রাস্তার নম্বর উর্দু ভাষায় জেনে নিল।
পাকিস্তানের রেডিওতে শালুটিকর বিমানবন্দর বলে কোনো বন্দরই নেই বলা হল। টিক্কা খানের ভাষণে সামরিক কর্মচারী, ই. পি, আর.-এর কর্মচারীরা কাজে যোগ না দিলে নাস্তানাবুদ করে দেওয়া হবে বলে প্রচারিত হল। নাস্তানাবুদ করতে বাকি আছে কি? বাংলা বাহিনী চুয়াডাঙ্গা, ব্রাহ্মণবাড়ীয়া, দিনাজপুরে তার জয় নিশান উড়াচ্ছে। ভারতে পাকিস্তানী ডেপুটি হাই কমিশনার হুসেন আলী পাকিস্তানি অফিসে জয় বাংলার পতাকা উড়িয়েছে।
বৃষ্টি আজ এখনও হয়নি। শাব্বীর এর কোনো খবর পাচ্ছি না।

১৯ এপ্রিল (সোমবার)
রাত ১০টা
ব্রাহ্মণবাড়ীয়া, টাঙ্গাইল ও ঢাকার উপকণ্ঠে প্রচণ্ড গোলাগুলী চলছে। গত রাতেও মীরপুরে আগুন ধরিয়েছে। রিলিফের জন্য দেওয়া কপ্টারগুলো আজ বাংলার মানুষের উপর বোমাবর্ষণ করার কাজে নিযুক্ত করা হয়েছে। সমস্ত বিশ্ব এই অন্যায় অবিচারে প্রতিবাদে মুখর, কিন্তু সক্রিয় অংশ কে নিচ্ছেক বোঝা যায় না। ভারত বাংলার শরণার্থীদের আশ্রয় দিচ্ছে। নির্লজ্জ পাক-বাহির লজ্জা শরম নেই। ইমান নেই। পদস্থ কর্মচারীর লাঞ্ছনা পশুর অধম সেনাবাহিনীর হাতে দিন দিন বেড়ে চলেছে। আজ বৃষ্টি নেই। বৈশাখী দিন অবসন্ন, ম্লান, বিষণ্ণ।

২০ এপ্রিল (মঙ্গলবার)
রাত ১০টা
আজ আবার সিলেট, ভৈরব, কসবা আর ঢাকার কাছে কালিগঞ্জে প্রচণ্ড বোমা নিক্ষেপ করা হচ্ছে। ঢাকার আকাশে আজ খুব কম প্লেন চলেছে। কেমন থমথমে ভাব। বাড়ীর সামনে ৩দিন থেকে সন্দেহজনক লোককে পায়চারী করতে দেখা যাচ্ছে। নিউ মার্কেটে দোকানপাট বেশীর ভাগই বন্ধ দেখা যায়। কাজের লোক পাওয়া যাচ্ছে না। বস্তির বাসিন্দারা ঢাকা ছেড়ে বেশীর ভাগ চলে গেছে। সরকারী কর্মচারীরা প্রাণের ভয়ে কেউ কেউ কাজে যোগ দিচ্ছেন। সব কিছু স্বাভাবিকভাবে চলছে বলে রেডিও খবরের কাগজে প্রচার হলেও অফিস, বাজার ফাকা। ৫টার পর রাস্তাঘাটে লোক চলাচলও কম।
আজ বৃষ্টি নেই আকাশ বাতাসও থমথমে।

২১ এপ্রিল (বুধবার)
রাত ১১টা
আজ ইকবাল দিবস। ইকবাল পাকিস্তানের স্বপ্নদ্রষ্টা কবি। কিন্তু খাস পাকিস্তানী বলে যারা দাবী করেন, তারা এর কি মর্যাদা দিচ্ছেন আজ?
কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, ময়মনসিংহ মুক্তিফৌজের দখলে, সিলেটও। বৃষ্টি কালরাত থেকে বেশ হয়েছে। আল্লাহর রহমত। শহরে সামরিক গতিবিধি আজ শ্লথ। কোনো গ্রাম বা শহরের খবরাখবর বা লোক চলাচল নেই। মিথ্যা প্রচার চলছে।
করাচী প্লেন’ এর টিকিটও পাওয়া যায় না। হেলিকপ্টার খুব উড়ছে বোমারু প্লেন আজ দেখা গেল না। সীমান্তে কি হচ্ছে আল্লাহ জানেন।

২২ এপ্রিল (বৃহস্পতিবার)
রাত ৯টা
আজ শাব্বীর রোজীর টেলিগ্রাম পেলাম। আর্জেন্ট টেলিগ্রাম করে দেওয়া হল, আমরা ভালো আছি। দুলুদের কওসরের সঠিক খবরটা পেলেও আল্লাহর কাছে শোকর করতাম।
সকাল থেকে খুব প্লেন উড়েছে, সিলেট পাক বাহিনীর দখলে। মিলিটারী গাড়ী চলছে। রাতদিন থমথমে ভাব। ফরিদ আহমদ যে বিবৃতি দিয়েছিল তাতে করে সরকার তথা সেনাবাহিনীর উপকার না হয়ে অপকারই হয়েছে। মিথ্যার পাপ ওদেরকেই গ্রাস করবে। বাঙালী বিনা দোষে অনেকেই মরেছে আরও মরবে। দিন দিন খাবার দাবার জিনিস দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠছে। দেখা যাক, কতদিন আল্লাহ খাওয়ায়।

২৩ এপ্রিল (শুক্রবার)
রাত ১০টা
গত ২৩শে সকালে ছায়ানট-এর গণসঙ্গীতের আসর হয়েছিল। আজকের সকালটি সে দিনের মতো সোনা রাঙা ঝলমলে ছিল, কিন্তু সেদিনের তারা আর আজ অনেকেই নেই। অনেকেই নেই। অনেকেই আবার ঘর ছাড়া, স্বজন ছাড়া হয়ে কে যে কোথায় আছে আল্লাহ জানেন। যে যেখানে আছে, আল্লাহ যেন নেগাহ্‌বান থাকেন।
গতরাতে নাকি ইন্ডিয়া রেডিওতে আমার মৃত্যু সংবাদ দিয়েছে। আমরা শুনিনি, কিন্তু আজ ভোর ছটা থেকে যত লোক পেরেছে ফোন করেছে, এসেছে, খবর নিয়েছে। আহা, যদি আমার প্রাণের বিনিময়ে একটিও প্রাণ বাঁচত, কত সার্থক এ জীবন হত। আমি ত বাঁচতে চাই না কিন্তু নিঠুর, কঠোর আমাকে যে বাঁচিয়েই রেখেছে, আরও কি লীলার জন্য কে জানে!

২৪ এপ্রিল (শনিবার)
রাত ১০টা
সকালটা ঝলমলে রোদে সুন্দর হয়ে এসেছিল। ভোরে অনেক দূরে গোলার শব্দ পাওয়া গেছে। বিকাল থেকে মেঘ করে সন্ধ্যা থেকে বৃষ্টি হচ্ছে। আজ গুজব ছিল, ঢাকায় অবাঙালীরা গত ২৫ তারিখের চট্টগ্রাম দিবস পালন করবে ঢাকায় বাঙালী হত্যা করে, কি কারণে এখন পর্যন্ত তারা এগিয়ে আসেনি। অবশ্যই এখন মাত্র সন্ধ্যা, রাত বেশী হতে কি হয় বলা যায় না। শহরে মিলিটাৎপরতা অনেক বেড়ে গেছে। আজও সারা দিন আমি বেঁচে আছি কি না জানতে কত লোকের আনাগোনা হয়েছে। আমার মৃত্যু কিভাবে হবে জানি না। তবে দেশের, দশের ভালোর জন্য যেন হয়। কুমিল্লার কোনো খবর পাচ্ছি না। আমি ত বেঁচে আছি। কিন্তু নীলিমা ইব্রাহিম কোথায়? সেই জন্য বুঝি রেডিওতে আমাকে আমার বেঁচে থাকার ঘোষণা করতে দেওয়া হয়নি।

২৫ এপ্রিল (রবিবার)
রাত ১০টা
ঠিক ১ মাস পর ঢাকার পথে বের হলাম। কি দেখলাম। প্রায় শহরটাই ঘোরা হল, জনমানবহীন রাজপথ। প্রধান প্রসিদ্ধ দ্রষ্টব্য স্থান ধ্বংসস্তূপ। স্বাভাবিকভাবে চলছে বলে পাক রেডিও, খবরে কাগজে যা প্রচার করছে তা সবই অস্বাভাবিক। এই ঢাকায় দিকে দিকে এখনও মরণযজ্ঞ চলেছে- এর শেষ পরিণতি কি আল্লাহ জানেন। গত রাতেও দূরে কামান গর্জন শোনা গেছে। আজ সকালেও প্লেন উড়েছে। বিকালে বৃষ্টি হয়েছে, কাল সারারাত বৃষ্টি হয়েছে। আল্লাহর রহমত। দলে দলে সেনাবাহিনী ধানমণ্ডি স্কুলে এসেছে। শেখ সাহেবের বাড়ীতে ভিতরে আলো জ্বলছে, লোকজনও আছে বলে মনে হয়। বাইরে থেকে কিছু বোঝা যায় না।