ফেব্রুয়ারি ১৯৭১

১ ফেব্রুয়ারী (সোমবার)
আজ ভোরে ঘুম ভাঙ্গতেই মনে পড়ল লুলুর পরীক্ষা আজ। ঢাকা সময় ১১টায় বাজারে গেলাম। সেলিমা আহমদকে ফোন করলাম। বৌমার দেওয়া ইনভেলপ বুলু পৌঁছে দিল আফিসে তার হাতে। ৫টায় প্রবাসী পাঠ চক্রে গেলাম। সাড়ে সাতটায় এসে বেগম সেলিমা আহমদের ওখানে গিয়ে জেবুননিসা হামিদুল্লাহর বাড়ী ডিনার খেয়ে ঢাকা সময় ১১টায় বাড়ী এলাম। কাল আব্বু ঢাকা যাচ্ছেন- চিঠি লিখে দেবো।

২ ফেব্রুয়ারী (মঙ্গলবার)
রাত ৩টা, ঢাকা সময়
পান্না আর আমি এতক্ষণ ধরে বসে থাকলাম ট্রাঙ্ককল করে। লাইন পাওয়া গেল। আজ সকালে গিল্ড অফিস, রেহানার আম্মা ও রেহানার বাড়ি গেলাম। আব্বু আজ ঢাকা গেলেন, চিঠি দিলাম, ফোন করার কথা বলেছিলাম তাও লিখেছি। কিন্তু ফোনতে পেলাম না। মিসেস তাহের জামিল চায়ের দাওয়াত দিয়ে ছিলেন নাজিমাবাদ কলোনীতে। সেখান থেকে ফিরবার পথে কায়েদে আযমের মাজারে দেখে এলাম চীনের উপহার বাতির ঝাড়। বিরাট বটে। কিন্তু ওর চেয়ে কত সুন্দর আমাদের শায়েস্তাবাদের মসজিদে ছিল। সব গেছে। এয়ারপোর্টে আখতার সোলেমানের সাথে দেখা হল।

৩ ফেব্রুয়ারী (বুধবার)
রাত ১১টা
আজও ঢাকায় ফোন করে লাইন পেলাম না। জানিত আমার বাড়ীর ফোন! আজ হয়ত টেলিগ্রাম পেতে পারি। গিল্ড অফিসে গেলাম। মিটিং হল। আজ জিমখানা ক্লাব এ ডিনার আছে, গিল্ড এর সভ্যদের নিয়ে। আবারও ফোন বুক করে রাখলাম। যদি সকাল ৭টায় লাইন পাওয়া যায়। বেগম সেলিমা আহমদ রোজ ফোন করছেন, মার্কেটিংয়ে নিয়ে যাবেন। আমি করাচীর সওদা করার পয়সা কোথায় পাব?

৩ ফেব্রুয়ারী (বুধবার)
যে বাঁধন চাই এড়াতে সে থাকে সাথে সাথে
আগে পিছে ছায়ার মতো,
সে থাকে সুখে দুঃখে ব্যথা হয়ে থাকে বুকে
ছাড়াতে গেলে আবার জড়ায় ততো।
পথ খুঁজিতে পথ সে হারায়
ঘুরে ফিরে সেই সে কায়ায়
ফিরে ফিরে আসে।
কঠিন বাঁধন ছিঁড়তে গিয়ে তারেই ভালোবাসে।
মৃত্যুর সে বিষ পান করে হয় হৃদয় তন্দ্রাহত
কান্না যে হায় পান্না হয়ে ঝুঞ্জে গানের মতো।

৪ ফেব্রুয়ারী (বৃহস্পতিবার)
রাত ১টা
সকালে রেডিও অফিসে গেলাম, একটা ইন্টারভিউ হ’ল আমার। বুলু ও রেডিওর একজন মিলে নিল। কবিতা পড়া হল। বুলু মুখে মুখে ‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতাটির উর্দু তরজমা শুনিয়ে দিল। ফিরদৌসী ও সুফিয়া আমীন ছিল। এখানেও দেখছি কোন সুবিধা পাচ্ছে না। আর বর্তমান সময়টাতে বাঙালীর প্রাধান্য স্বীকার করে এরা অন্তর্দাহে জ্বলে মরছে।
আজ সকালে ঢাকায় ফোনে কথা বলে মনটা ঠাণ্ডা হল। রাতে আজ হাজেরা মাসরুর ডিনার দিয়েছেন কাছে ক্যান্টন হোটেলে। বিকাল ৫টায় গিল্ড আফিসে আমাকে সংবর্ধনা দেওয়া হল। বেশ উর্দুতে বক্তৃতা ঝাড়লাম। রেডিওতেও উর্দুতেই ইন্টারভিউ হল। বুলু আর আমি হার মানব না ইনশাআল্লাহ।

৫ ফেব্রুয়ারী (শুক্রবার)
রাত ১২টা
হাজেরা মাসরুর ডিনার দিলেন- ‘ক্যান্টন’ এ। অনেক- প্রায় কুড়ি-জন আমরা, মিঃ ও মিসেস আলীও ছিলেন। আজকে পাক সোভিয়েট সমিতির মিটিং ও আখতার সোলেমানের ওখানে ডিনার ছিল। পাক সোভিয়েট সমিতি নিজেরাই ক্যানসেল করে দিল। আমরা সবাই মিলে ডিনার বাদ দিয়ে আলী সাহেবকে নিয়ে খুব আড্ডা জমালাম। এত সুন্দর গানে গজলে বেগম আলীর ছেলেমেয়েদের হাসিখুশীতে সময় কাটল। বন্দু খান এর দোকানে সবাই পরাটা কাবাব খেয়ে রাত ১২টায় বাড়ী ফিরলাম। আজ শেষ রাত করাচীর। আমার জন্য সবাই অস্থির আছে ঢাকায়। ফোনে লুলু বলল, হেনা টেলিগ্রাম করেছে। আজও এল সে টেলিগ্রাম।

৬ ফেব্রুয়ারী (শনিবার)
আকাশ পথ-৭০৭ বোয়িং।। ঢাকা সময় ৬টা
সকাল ৫টায় উঠে ৬টায় সবাই এয়ারপোর্টে পৌঁছাতে এসে শুনলাম ৭টায় প্লেন যাবে। ৪টায় একটা আছে। আবার সাড়ে তিনটায় এলাম। জাষ্টিস সাত্তার, ভীমজির সাথে দেখা হল। ভি. আই. পি, রুমে বসে থাকলাম। জাষ্টিস সাত্তার তার মোটরে করে প্লেন এর সিঁড়িতে পৌঁছে দিলেন। বুলু, পান্না চলে গেল। সাড়ে চারটার প্লেন পৌনে ৫টা উড়ল। এখন সমুদ্র উপকূল ধরে চলছে। হাজার ফুট উপর থেকে কিছুই দেখা যাচ্ছে না।

রাত ১১টা
বঙ্গোপসাগর পাড়ি দেওয়া গেল। বেল্ট বাঁধার কথা প্রচার হল। ঢাকা আসছে। ফিরদৌসী, তার মাও সাথে আছেন। কলম্বো দেখাই গেল না।

২৭ ফেব্রুয়ারী (শনিবার)
ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয় ও সাংস্কৃতিক সম্মেলন উপলক্ষে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী সাহেবের দাওয়াতে আজ সন্তোষ হয়ে এলাম। সাথে ছিলেন বৌমা মিসেস নারগিস জাফর ও আয়েশা জাফর। মওলানা আহমদ হোসেন, ইসলামিক একাডেমীর ডিরেকটার সাহেবও আমাদের সাথে গেলেন। অর্ধ সমাপ্ত বিশ্ববিদ্যালয়, তার উদ্বোধন! ড. কাজী মোতাহার হোস্টেল মূল সভাপতি, প্রধান অতিথি জনাব আবুল হাশেম সাহেব সস্ত্রীক একদিন আগেই গিয়েছিলেন। জনসমাবেশ প্রচুর। লাঠি খেলা হল। ফিরদৌসী, আলীম, আলতাফ আরও কয়েক জন গায়ক শিল্পীরও সমাবেশ হল। অদ্ভুত মওলানার প্রাণশক্তি। সন্তোষের ইতিহাস বর্ণনা হল ১ ঘণ্টা, তারপরও আধ ঘণ্টা ধরে তার ভাষণ। অক্লান্ত কর্মী হিসাবে এই লোকটিকে শ্রদ্ধা না করে পারা যায় না। মুগ্ধের মত লোকেরা তার ভাষণ শুনল। স্মৃতিশক্তিও প্রখর। কবে কখন কোন তারিখে কোথায় কি কাজ করেছেন তা অনর্গল বলে গেলেন। পায়ে হেঁটে সারা বাংলাদেশ বেড়িয়েছেন চাষীদের দুঃখদুর্দশা উপলব্ধি করেছেন। এখনও প্রচুর কৃষক গ্রামীণ লোকেরা তার মুরিদান, তারাই এত লোক খাওয়ার জন্য চাল ডাল মাছ তরকারী যোগাল, রাঁধল খাওয়াল। এ এক বিরাট ব্যাপার।