জানুয়ারি ১৯৭১

১ জানুয়ারী (শুক্রবার)
ভি. এম. জলকপোত।। রাত ১২টা
১৯৭১ সনের একটি দিন গত হয়ে গেল। ঘর সংসার স্বামী-সন্তান থেকে দূরে আজ সকালে গলাচিপা থেকে বেলা ৩টায় ধানখালি এলাম। এবারে এ রিলিফের ব্যাপারে এত যে গণ্ডগোল হচ্ছে। আজও চাল পাওয়া যায়নি। সুলতানারা এতক্ষণে ধানখালি রিলিফ অফিস হতে ফিরল। ২টায় স্পীড বোট অচল। ক্যাম্প করে কিছু মাল নামিয়ে কতক ছেলেরা সেখানে থাকল। কাল থেকে রিলিফ শুরু হবে। বারো হাজার লোক। ৯টা ইউনিয়ন। গলাচিপা থেকে রেডক্রস কম্বল, কাপড়, খাবার জিনিস, দুধ, চকলেট, শাড়ী বাচ্চাদের কাপড় প্রচুর দিল। খুব শীত পড়েছে। বাড়ীতে সবাই ঘুম।

২ জানুয়ারী (শনিবার)
রাত ১১টা
আজ সারা দিন দু’হাজার মানুষকে বিবি দিয়ে রাত ১০টায় শেষ হল। ধন্য মেয়ে এই সুলতানা জামান। ওই পারছে, কী যে মানুষ আমাদের দেশের। দারিদ্র্যে ভিক্ষাবৃত্তি মজ্জাগত হয়ে গেছে এদের। কত মানুষ এসে দেখে গেল, দোওয়া করে গেল আমাকে। দেশের মানুষ চেনে, ভালোবাসে, শ্রদ্ধা করে এর চেয়ে গৌরব আর কী আছে?

৩ জানুয়ারী (রবিবার)
রাবনাবাদ নদী৷। রাত ১২টা
আজও ঢাকার কোনো খবর জানা গেল না। আল্লাহ্ নেগাহ্‌বান। গিয়ে যেন সবাইকে ভালো দেখি। দলে দলে লোক আসছে, রিলিফ সংগ্রহ করেছে। সব শেষ হয়ে গেছে ওদের। হাত না পেতে কি করবে? ধানের দেশ গানের দেশ বরিশাল। তার মানুষ আজ মুষ্টি ভিক্ষা নিয়ে বাচ্চা কাচ্চার প্রাণ বাঁচাবার প্রয়াস পাচ্ছে। আমাদের দেশে শিক্ষার যে কী পদ্ধতি, আর কী প্রয়োজন তা বুঝা গেল। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের কাণ্ড দেখলাম। জাহাজের লোকদের এবং জনসাধারণকে দেখলাম। এ শিক্ষা আমাদের দেশে না থাকলেই ভাল হত।

৪ জানুয়ারী (সোমবার)
রাত ১২টা
হাজার হাজার মানুষ। সর্বহারা, অন্নহীন, বস্ত্রহীন, গৃহহীন। এককালে খেয়েদেয়ে চরের মানুষেরা স্বাস্থ্যবান ছিল। তাই আজও এরা মরণের সাথে যুঝেও সবল। অসহায়, সরল, বোকা, চালাক লোকের অভাব নেই। যুগ যুগ ধরে এরা শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত। আজও এরা মৌন, মূক, অসহায়, ভীতু, ভীরু। রাত ১২টা বাজল। ১১টা পর্যন্ত চলেছে রিলিফ। ছেলেরা মেয়েরা, মহিলারা যা অমানুষিক পরিশ্রম করছে! সরকারি কর্মচারীরা যদি তা করত কত দুঃখ লাঘব হত।

৫ জানুয়ারী (মঙ্গলবার)
রাবনাবাদ নদী।। রাত ১২টা
চর বিশ্বাস, চর সাগস্তিতে গেলাম যখন তখন সে জায়গাকে ধোয়ামোছা একটি মাটির থালার মতো লেগেছিল- না পশুপাখি, না একটা মশা মাছি। এখানে চারদিকে এখনও অনেক লাশ পড়ে আছে, ভেসে এসে হোগলা বনে, ধান ক্ষেতের আলে আলে লেগে আছে। অবশ্য আমাদের কাছ থেকে দূরে। কিন্তু মাঝে মাঝে গন্ধ পাওয়া যায় আর মাছি এত, যে খাওয়া দাওয়া কষ্টকর। আজীজ এত মৃত দেহের স্কেচ এত সুন্দর করে করেছে। ভয়াবহ মৃত্যুর বীভৎস চিত্র। আল্লাহ্ যেন সুমৃত্যু দেন মানুষকে!

৬ জানুয়ারী (বুধবার)
রাত ১২টা
অফুরন্ত দায়িত্ব আর আকাঙ্ক্ষার আজ শেষ। রিলিফ শেষ হল। ১৫ হাজার মানুষ অতি আনন্দে কৃতজ্ঞতায় আপ্লুত হয়ে আমার নাম গানে মুখর হল। এ যে আমার অত্যন্ত গুনাহ্‌র কথা। আজ বিকালে মাঠে জনসাধারণ সভা করল। কবে কার পুরানো কাগজের মালা আমার আর সুলতানার গলায় পরাল। হোক নোংরা পুরানো তুচ্ছ কাগজের মালা, কিন্তু সবার অন্তরের শ্রদ্ধায়, পূত পবিত্র অমূল্য এ মালা। মহিলারা উপস্থিত ছিলেন, কান্নায় আমার বুক ভেঙ্গে গেল। ওরা ভিক্ষা নিয়ে শ্রদ্ধা দিল। আজ দুপুরে মাছ ভাজছি হঠাৎ ওহিদুল হক এসে উপস্থিত। ভোলানাথ কী খুশি আমাকে দেখে! আমারও যে কত ভালো লাগলো।

৭ জানুয়ারী (বৃহস্পতিবার)
রাত ১১টা
পটুয়াখালী ছাড়লাম। আজ সারা সকাল থেকে ২টা পর্যন্ত গ্রামে ঘুরলাম। এখনও মৃতদেহ পড়ে আছে। ৩টায় লঞ্চ ধানখালি থেকে ছাড়ল। লোকেরা কী কান্নাটাই কাঁদল। কত মেয়েরা জড়িয়ে চুমু খেল। সালাউদ্দীন হেসে অস্থির। ৫টায় গলাচিপা এসে বেলজিয়াম হাসপাতাল দেখে, সোশ্যাল ওয়েল ফেয়ার অব অরফানেজ ক্যাম্পে গেলাম। তবু যা হোক নিজের দেশের একটি প্রতিষ্ঠান দেখলাম। বেলজিয়াম হাসপাতাল ও ক্যাম্প কী পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। ওরা কম ইংরেজী জানে। বাংলা শিখছে। ঢাকা যাচ্ছি, যেন আল্লাহ সবাইকে ভালোই দেখান!

৮ জানুয়ারী (শুক্রবার)
ভি. এম. জলকপোত নদী পথে নন্দীর বাজার
যে মৃত্যু সুন্দর নয় তার কাছ থেকে রাখো দূরে
মৃত্যু-পদধ্বনির নূপুরে
শুনি যেন আনন্দের গান
যত দিনে এত দিনে জীবনের হবে অবসান।
তোমার সান্নিধ্যে যাব সানন্দ অন্তরে
মৃত্যুর প্রশান্ত ছায়া লয়ে মুখ প’রে
নয়নে লইয়া সেই আলো
ভালোবেসেছিনু ধরণীরে
আর তুমি মোরে বাসিয়াছ ভালো।
সৃজেছ সুন্দর করি মানুষের দেহ, আত্মা, মন
দিয়েছ লাবণ্য স্নিগ্ধ, শুচি, প্রেম, স্নেহের বন্ধনে,
আবার নিঠুর করি ছিনায়েছ অকরুণ কঠোর হে তুমি
তোমার সুন্দর সৃষ্টি যে সমুদ্র নদী, তীর ভূমি
কী আক্রোশে এ বীভৎস মৃত্যুর খেলায়
মেতেছ একান্তে, তুমি নাকি দয়াময়!
নাকি যে ভয়াল রুদ্র প্রকাশ তোমার
চিরদিন সে রূপ আমার
ধেয়ানে রয়েছে, আছ নিভৃত অন্তরে
মুছি ফেলি তব রুদ্র করে
ভীষণ ভয়াল হয়ে সৃষ্টি করি নাশ
বাড়িবে কি তোমার উল্লাস?
দিয়োনা কুৎসিত করি সে অন্তিমে তোমার
মহৎ মৃত্যুরে। দাও মধুর মৃত্যুর উপহার।

৩০ জানুয়ারী (শনিবার)
বিমান পথে ঢাকা।। সময় সোয়া আটটা
হৃদয় আমার! রানো বাঁশীর সুরে
কেনর্দিস তুই সাড়া?
তোর হাতে পায়ে শিকল বাঁধা
চার দিকে যে কারা।
ওরে হরিণ মন!
ব্যাধের বাঁশী শুনে যে তুই হস্‌রে উচাটন
ও যে নিঠুর নিষাদ
মধুর মধু সুরের জালে পেতে রাখে ফাঁদ
তুই আপন ভুলে সেই সে সুরে
সেই ফাঁদে দিস্‌ ধরা।
সবায় ভালোবাসতে গিয়ে
আপন করিস পর
ভাঙ্গন ভরা নদীর কূলে বাঁধতে চাস তুই ঘর
সেথায় এ কূল ভেঙ্গে ও কূল জাগে
বহে সর্বনাশের ধারা।

৩০ জানুয়ারী (শনিবার)
বিনাম পথে।। সাড়ে ৭টা, ঢাকা সময়
৬টা ২ মিনিটে বোয়িং ৭০৭ আকাশে উড়ল। বত্রিশ হাজার ফিট উপর দিয়ে লৌহ বিহঙ্গ চলেছে। নীচে তুষার শুভ্র মেঘলোক। পশ্চিমে এগিয়ে আসছি, দিগন্তে গোধূলি, শাদা শাড়ীর কমলা পাড়। প্রকৃতি সন্ধ্যার আগে সেজেছে। যত পশ্চিমে এগোচ্ছি গোধূলি উজ্জ্বল, দিগন্তে দিনের চিতা জ্বলছে। যাচ্ছি করাচী লাহোর পিণ্ডি, লেখক সংঘের বার্ষিক প্রতিষ্ঠা দিবস উপলক্ষে প্রধান অতিথি হয়ে। বাংলাদেশ, ঢাকা থেকে। সত্যি কি বৃক্ষহীন দেশে এর কাণ্ড আমি হলাম? আল্লাহ জানেন উনি, জামাল, আলভী লুলু, টুলু, শমু এতক্ষণে ঘরে ফিরে কী করছে!

৩০ জানুয়ারী (শনিবার)
রাত ১২টা
প্লেন সোয়া ৯টায় এয়ারপোর্ট এল। কী ভিড়! বুলু, জামাল উদ্দিন খালি ছিলেন। পান্না, ছেলেমেয়েরা। বহু দিন পর করাচী এলাম। আমার লেখা, ভাষণ বুলুর পছন্দ হল। আরও কিছুটা জুড়ে ইংরেজী অনুবাদ করাচ্ছে মিলুকে দিয়ে বুলু। এরা যে কত হাসি খুশী করে কাজ করে। বাপ বেটাবেটি, স্বামী স্ত্রী, কত সাবলীল সুন্দর করে সংসারটা চলছে, আল্লাহ নেগাহ্‌বান থাকুন। লাহোর যাওয়া হবে না। ভারতীয় প্লেন হাইজ্যাক করে লাহোর নামিয়েছে।

৩১ জানুয়ারী (রবিবার)
রাত ১২টা
বিকেল সাড়ে ৪টায় পাকিস্তান আর্ট কাউন্সিল হলে লেখক সংঘের দ্বাদশ প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উদযাপন করা হল। সভাপতি কেউ নেই, জাহেদী সেক্রেটারী, আমি প্রধান অতিথি। বেশী লোকজনও নেই, লাহোরে প্লেন হাইজ্যাক হয়েছে ওখান থেকে কেউ আসতে পারেনি। শওকত সিদ্দিকী আমার ভাষণের খুব সুন্দর অনুবাদ করে শোনাল। আমার কবিতা ‘মোর বাংলা’ পড়তেই হল। উপস্থিত বাংলা বুঝবে কে- তাই রোজী আহাদ উপস্থিত ছিল, মুখে মুখে কথাগুলোর সুন্দর অনুবাদ করে শোনাল। আহাদ সাহেবও ছিলেন। সন্ধ্যা ৭টায় নজরুল একাডেমীতে মুনীর চৌধুরীর একাঙ্কিকা ‘জমা খরচ ইজা’ ঘরোয়া অভিনয় করা হল। এত সুন্দর অভিনয় ও ঘরের পটভূমিকার পরিবেশে এত মানানসই হল যে দেখে খুশী লাগল। প্রধান অতিথি হয়ে নাজির আহমদ এল। বহু দিন পর দেখলাম। দেখে কত খুশী কত গৌরবও বোধ করলাম। এই সব ছেলেরা একালে পাকিস্তানের স্বপ্নকে সত্য সফল করতে কী না করেছে!
নজরুল একাডেমীর ভিতরের অবস্থা দেখে রক্ত গরম হয়ে যায়। আব্বুও সাথে ছিলেন। তারই প্রতিষ্ঠিত নজরুল একাডেমীর এই দশা দেখে খুব দুঃখ করলেন বুলু ও মুজিবুর রহমান। এ দেশের মুজিবুর রহমান এখন চেষ্টা করেছে ভালো করতে। আজ হাজেরা মাসরুর ও তার স্বামী দেখা করে গেলেন।