জুলাই ১৯৭১

১ জুলাই (বৃহস্পতিবার)
রাত ১০টা।
দিনে দিনে এ মাসও এসে গেল। দুর্বিষহ দিনরাত কেটে যাচ্ছে। কি করে যে কাটায়, সেই অকরুণই শুধু সে খবর জানে আর কেউ জানে না। হত্যার শেষ নেই, নারীর লাঞ্ছনার সীমা নেই। জুলুম ধর-পাকড় অব্যাহত। দেশের মানুষ পরাশ্রয়ী, তবু এর কোনো সুরাহা করছে না শাসক দল। ইসলাম, মুসলমানের নাম শুনে আজ সবাই ঠাট্টা করে, ঘৃণাও করে, কি পরিতাপ। লিখতেও ইচ্ছা করে না। গ্রাম থেকে নিত্য নতুন অত্যাচারের খবর আসছে। বিশ্ববিদ্যালয় স্কুল সব খালি।

২ জুলাই (শুক্রবার)
রাত ১১টা
১০টায় আজ অনেক দিন পর দুলুমণিদের পেলাম। ওরা ভালো আছে। কওসরটার শরীর সুস্থ আছে জেনে আল্লাহর কাছে শোকর। ওর জন্য আমার বড় ভাবনা। লুলু টুলুদের চাটগাঁ পাঠাতে বলছে। কি করে যাবে। আল্লাহ সবাইকে যে যেখানে আছে সহিসালামতে রাখুন। সবাইকে এক সাথে দেখব বলে আশা করে আছি। ইনশাআল্লাহ দেখা হবে। ওগো নিষ্ঠুর দরদী। আর কত দুঃখ দিবে। ঘুচাও তোমার রুদ্ররূপ। দেশকে তোমার সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব মানুষকে বাঁচাও। রহম কর রহমান। তোমার নামের সার্থকতা বজায় রাখ। আবার সানন্দা হই।

৩ জুলাই (শনিবার)
রাত ১০টা
কাছে ধারে একটা বোম-এর শব্দ হল। সাথে সাথে ৯টা বাজল। বুড়ি এসেছিল শুনলাম। ওদিকে বেইলি রোড সিদ্ধেশ্বরীতে আলো নেই। আমরা কাল রাত ১টা থেকে আলো পাইনি, পানি ছিল না। সন্ধ্যায়ও খুব জোর আলো এল না। কি জানি কোথায় কি হচ্ছে। ছেলে মেয়েগুলোরও কোনো খবর নেই। কেউ আসেও না। থমথমে রাত দিন কাটছে। বরিশালের ওদিকে বোমারু বিমান ফেলে শেষ করছে। বাঙালী উচ্চপদস্থ নিম্নপদস্থদের চাকরি যাচ্ছে ত যাচ্ছেই।

৪ জুলাই (রবিবার)
রাত ১০টা
আজও ৮টার সময় একটা বোম-এর আওয়াজ হল। বৃষ্টিও হয়ে গেল। এতদিনে একটু বাইরে গেলাম। বুড়ির বাড়ীতে মিলাদ। এই লেকের ওপাড়ে, কতবার সে পথে হেঁটে কত জায়গায় গিয়েছি। কদিন থেকে কারুর খবর নেই, মনটা কেমন করছে। ওর পা-টার ঘাও সারছে না।
সারাদিন কাজ করি, তবুও সময় কাটে না।

৫ জুলাই (সোমবার)
রাত ৮টা
শামীম আজও রাতে অফিসে গেল। আল্লাহ নেগাহ্‌বান। আজ এতদিন পর কামরুন্নাহার লায়লী এল, কত কথাই না শুনলাম। রোকসানার ব্যাপারে বৌমা ঠিকই বলত। আজও কোনো খবর কারুর নেই। জাকিয়াও আসে না। ফোনও করছে না। কাল সারারাত ঘুম হয়নি। মেলা বর্ষণহীন বিষণ্ণ দিন, কাজ করে করেও দিন কাটে না। যে যেখানে আছে আল্লাহ তুমি হেফাজতে রেখো।

৬ জুলাই (মঙ্গলবার)
রাত ১০টা
অনেক দিন পর জাকু এল। ভালো লাগছে না। সব শহর নাকি লোকে গিজগিজ করছে। কিন্তু ধানমণ্ডি গোরস্থান হয়ে গেছে। আজও শামীম রাতে অফিসে থাকবে। আল্লাহ নেগাহ্‌বান। কি কি যে গুজব রটছে। সারা দিন ত বোমারু বিমান উড়ছে। অথচ কালিয়াকৈর-এর পুল উড়ছে। সিঙ্গারবিল বা ময়মনসিংহ-এর পথ বন্ধ। মাইনু ত চাঁটগা থেকে প্লেনে এল। ফোন করা মাত্রই কেটে গেল। আজ বৌমা আসেনি। শাব্বীরের ২টি চিঠি এক সাথে পেলাম। ওরা ভালো আছে। হাজার শোকর।

৭ জুলাই (বুধবার)
রাত ১০টা
সোয়া ৮টায় বোম-এর শব্দ হল। খুব কাছে মনে হল। মাইনু এসে চলে গেল। কাল ৭টা সকালের প্লেনে ইসলামাবাদ যাচ্ছে। আল্লাহ হেফাজতে রাখুন।

৮ জুলাই (বৃহস্পতিবার)
রাত ৯টা
আজ আষাঢ় পূর্ণিমা, কদম ফোটার রাত। আমাদের বাগানে কদম গাছ নেই। অন্য সব ফুল ফুটেছে, মানিকের হাতের লাগানো সব গাছ, মানিক মিলিটারী গুলীতে আজ দুনিয়া ছেড়ে যেখানে আছে, সেখান কে কি দেখছে?- জ্যোত্সার প্লাবন নেমেছে, সাড়ে ৮টায় বোমার শব্দ হল, কাছেই মনে হল। কাল ৮টার বোমা নাকি সাংহাই রেস্তরায় পড়েছে। রাতে আরও ২ বার শব্দ শোনা গেছে। আজ সকাল সাড়ে ১০টায় শব্দ শুনলাম সেটা নাকি লালমাটিয়ায় মাহমুদ আলীর বাড়ীতে পড়েছে। রাজশাহীতে খুব নাকি সামনাসামনি লড়াই চলছে, আল্লাহ জানেন কি হবে। সব মানুষের সুবুদ্ধি হোক, দুনিয়ার ভালো হোক। রাত সাড়ে ১০টায় আবার বোম-এর শব্দ হল।

৯ জুলাই (শুক্রবার)
রাত ১০টা
আজ সারা দিনে কেউ এল না। কারুর কোনো খবর পেলাম না। মনটা যে কি অশান্ত হয়ে ওঠে। বার বার আল্লাহর কাছে নিবেদন করি, আবেদন জানাই, তবুও মানুষের মন ত। অশান্ত অধীর হয়। আল্লাহ সবার ভালো করুন, সকলের নেগাহ্‌বান থাকুক। দেশের ভালো হোক।

১০ জুলাই (শনিবার)
রাত পৌনে ৯টা
এইমাত্র একটা বোমার শব্দ হল। সারাদিন পাগলের মতো বোমারু প্লেন উড়েছে। গরমও অসহ্য, মন মেজাজ কিছুই ভালো নয়। কোনো খবরও কারুর কোথাও থেকে পাওয়া যাচ্ছে না। এতদিনেও কি আল্লাহ মানুষকে শুভবুদ্ধি দিতে পারছেন না। দেশের মানুষই যদি না রইল, তবে কাকে নিয়ে দেশ।

১১ জুলাই (রবিবার)
রাত ৯-২২ মি
এই মাত্র একটা বোম এর শব্দ হল, আজ স্বপন এসেছিল। আহা! কি করুণ মূর্তিই না দেখলাম। কান্না নেই হাসিও নেই দৃঢ় কঠোর মুখ, বুঝি অন্তরও কৈশোর ছেড়ে মাত্র যৌবন শুরু। এখনই ওকে সাথীহারা স্বামীহারা আল্লাহ কি করলে। একি তার মঙ্গল লীলা বুঝি না। আবার আজকেই রুচির ছেলের বৌভাত খেয়ে এলাম। সুন্দর বৌটি হয়েছে, আল্লাহ মোবারক করুন। ওরা পরিবারটি শান্তিতে জীবন যাপন করুক। এই দোয়া করি। কেউ আসে না। কারুর কোনো খবর নেই। আল্লাহ নেগাহ্‌বান। ১০-২৫শে আবার একটা বোম-এর শব্দ হল।

১৩ জুলাই (মঙ্গলবার)
জুলাই ১৩, মঙ্গলবার রাত ১০টা
১ মাস হবে পরশু, আমার পাখীরা নীড়ভ্রষ্ট, কদিন থেকে মন এত অস্থির। ওদের কারুর অসুখ করল নাকি তাই ভাবছি। চারটি প্রাণ দূরে আছে। আল্লাহ নেগাহ্‌বান থাকুক। কালরাতে ১০টায় একটা ও অনেক রাতেও ১টা বোম-এর শব্দ পেলাম। আজ সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত পাগলের মতো বোমারু প্লেনগুলো উড়েছে। শামীম রাতের অফিস করছে। সন্ধ্যায় দুলুদের ফোন পেলাম। তবুও অনেক আশা ও সান্ত্বনা ওরা ভালো আছে। কাল সন্ধ্যায় বাচ্চু এসেছে।

১৪ জুলাই (বুধবার)
রাত ১০টা
আল্লাহর কাছে শোকর। আজ অনেক দিন পর জাকু এল। খবর ভালোই সবার। এখন আল্লাহ দেশের দশের ভালো করুন। সুমতি সুবুদ্ধি দেন অমানুষগুলোকে। মানুষ হোক সবাই। কালও ২/৩ বার বোম-এর শব্দ হয়েছে, আজ এ পর্যন্ত কিছু হল না। সকাল থেকে বোম্বারগুলো উড়েছে। প্রচণ্ড গরমে সবাই কাতর, আর বাছারা। যারা মাঠে ময়দানের পথে প্রান্তরে যুঝছে, মরছে, তারা কি করছে।

১৫ জুলাই (বৃহস্পতিবার)
রাত ১০টা
বাংলাদেশে পরীক্ষা শুরু হয়েছে, কে কে কি পরীক্ষা দিচ্ছে আল্লাহ জানে। ঘর ছাড়া মা বাপ ছাড়া মরা আধমরারা পরীক্ষা দিচ্ছে। এও এক প্রহসন। আজ ১৫ তারিখ ঠিক এমনই সময়ে ওরা ঘর ছেড়ে গেল। সমুদ্রে কত তরঙ্গ। নদীতে কত স্রোত। বৃষ্টির কত ধারা। মায়ের বুকের কত ব্যথা। আল্লাহ নেগাহ্‌বান। বৃষ্টি প্রচুর হল না। ঝড় ঝড় ভাব। গরমটা কমেছে। কোথায় কোথায় যে বোম পড়েছে। বাচ্চু আজ সকালে রওয়ানা হয়ে গেল। নিশ্চয় ভালোমতো পৌঁছে গেছে।

১৬ জুলাই (শুক্রবার)
রাত ১০টা
কাল থেকে বৃষ্টি খুব হচ্ছে। আজ বাইজু এসেছিল। ওর দিকে চাইতে পারি না। বেচারী সাইদ। এত ভালো লোকটি ছিল। কি পশুর দল দানব দল অসুর দল দেশে এসেছে। ঘর, বুক খালি করে দিল। সব ঘরে হাহাকার। আতঙ্ক। রাজরাণী পথের ভিখারিণী হয়েছে। ভিখারিণী ভিক্ষা পাচ্ছে না। আরও যে আল্লাহ কত দেখাবে। এ বারে শেষ কর। রহিম রহমান। অবসান হোক তোমার রুদ্র রূপের।

১৭ জুলাই (শনিবার)
আজ মানিকের চিঠি পেলাম। এতদিন ওরা বেঁচে আছে আল্লাহর কাছে শোকর। আহমদ আলীও এসে দেখা করে গেল। আজ ফোন এল, বলল লুলুর বন্ধু ওরা ভালো আছে। কে কোথা থেকে কি বলে বুঝতেও পারি না। যে যেখানে আছে আল্লাহ নেগাহ্বান থাকুন। বৃষ্টি হয়ে গেল। গরম পড়ছে। আজ যেন ঢাকা শহর থমথমে, কি জানি কোথায় কি হচ্ছে।

১৮ জুলাই (রবিবার)
আজ ১লা শ্রাবণ। কেতকী-গন্ধা শ্রাবণ আজ, শশাণিত-গন্ধা শ্রাবণ আমার শত সন্তান-শহীদ-শোণিত-গন্ধা শ্রাবণ। তবু শ্রাবণ এল। আমার বাগানভরে দোলনচাঁপা জুঁই চামেলী লিলি কামিনী রজনীগন্ধা ফুঁটে আছে। শ্রাবণ এল। কেতকী কোন কুঞ্জে জানি ফুটেছে। ধানমণ্ডিতে কেতকী নেই। রোদ বৃষ্টির আলোছায়ায় দিন রাতটি আজ। এই সাড়ে আটটায় একটা বোমা পড়ল জানি কোথায়। কাল ও আজ বোমারু বিমানগুলো উড়ছে না। কোথায় আছে আমার পাখীরা। কি করছে, আল্লাহ নেগাহ্‌বান থাকুন।

২০ জুলাই (মঙ্গলবার)
রাত ৯টা
কাল থেকে দিনে রাতে কতবার যে বোমার শব্দ হল। চামেলীবাগ, হাতীরপুল, ধানমণ্ডি স্কুলে গত রাতে বোমা পড়েছে। আজ বোমারু বিমান উড়েনি। রোদ বৃষ্টি আলো ছায়ায় দিন কাটছে। ক্ষণে ক্ষণে আলো পানি বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। কাল থেকে এই বোমা পড়ার দরুন তেজগাঁ টঙ্গি কোথাও ইলেকট্রিসিটি নেই। ঢাকার অনেক জায়গায় বিদ্যুৎ ও পানি বন্ধ। শাব্বীরের চিঠি নেই, কারুর কোনো খবর নেই, ফোন করছে না কেউ। বৌমাও আসেননি, ফোন করেনি।

২২ জুলাই (বৃহস্পতিবার)
রাত ১১টা
সাড়ে ১০টায় বোমার শব্দ হল। আজ সূর্যগ্রহণ ছিল, পাক-ভারতে অদৃশ্য। বৃষ্টিও খুব ছিল সারাদিন। আজ ক’দিন ধরে শ্রাবণ ধারা ঝরছে, বাংলাদেশের চোখের জল। শাব্বীরের চিঠি আজও এল না। আমি চিঠি দিলাম। আর কারুরই কোনো খবর নেই, জাকিয়াও আসেনি। ফোনও করেনি। কালা-আলু ২টি বাচ্চা দিয়েছে, আজ সে যাকে খুঁজছে, তা আমি বুঝতে পারছি, আল্লাহই একদিন আবার অবলা পশুর আদরের ধনকে পৌঁছে দেবেন ওদের কাছে।

২৪ জুলাই (শনিবার)
রাত ১০টা
আজ শামীমের জন্মদিন। ওরে আমার বাছা। আল্লাহ সুপথে সৎ স্বভাবে সুষম রুজিতে হায়াতে বরকত দিয়ে যেন মানুষের মতো বাঁচিয়ে রাখেন। মনটা ভালো নেই, কালরাত থেকে যাত্রাবাড়ীতে মুক্তিবাহিনী-পাকসেনায় প্রচণ্ড লড়াই চলেছে। আজ দুপুর পর্যন্ত নিরীহ গ্রামবাসীদের উপর গোলাগুলী চলেছে। বোমারুগুলো সারাদিন উড়েছে। রাতে দুলুর ফোন পেয়ে জানলাম বুলুর শেষ অবস্থা। রক্তবমি হচ্ছে। আজ দুপুরে স্বপ্নটা দেখে অবধি মন খুব অস্থির ছিল। তবুও বলি আল্লাহ যত শিগগির ওকে কষ্ট থেকে মুক্তি দেন। ফোনে কথা বলাও গেল না। ডেড হয়ে গেল। আজ রাত বুলুর কি করে কাটবে, আল্লাহ জানেন। যেন শান্তিতে মরে।

২৫ জুলাই (রবিবার)
রাত ১০টা
৮-৪৫-এ বোমা পড়ার শব্দ হল যাত্রাবাড়ীর পথে। কাল থেকে কারফিউ। আজ শিরিনের বিয়েতে গেলাম। কত মানুষের ভালোবাসাভরা সাদর সঙ্গ লাভ করলাম। আজও লাভ করলাম দেশের প্রতি সবার কি ভালোবাসা। আর দুঃখের খবর। চিঙ্কু ও খসরুর কথা যা শুনলাম, তা যদি সত্যি হয়ে থাকে, সে বড় মর্মান্তিক। আল্লাহ জানেন, ওদের ভাগ্যে কি হয়েছে। আজ আর বুলুর খবর কিছু পেলাম না। ছোটনের চিঠিও না।

২৭ জুলাই (মঙ্গলবার)
রাত ১০টা
কারুর কোনো খবর নেই। ছোটনের চিঠি নেই। কেউ আসছেও না। এইত সাড়ে ৭টায়ও এক সাথে ৪টা বোম-এর শব্দ পাওয়া গেল। কাল থেকে বাজার শহর ঢাকা থেকে সব দলে দলে চলে যাচ্ছে, কে কোথায় যাচ্ছে কে কোথায় আছে, কিছুই জানা যাচ্ছে না। বরিশাল ফরিদপুরে অমানুষরা তাদের বীভৎস কাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। আল্লাহ আর কত এ নিষ্ঠুর লীলা চলাবেন। আজ বাবু এসেছিল। বৌমা আসেনি।

২৮ জুলাই (বুধবার)
রাত ১০টা
আজ ২২ দিন ছোটনদের কোনো খবর নেই। কাল রাতে ৫টা বোমের শব্দ শোনা গেছে। আজ সারাদিন পাগলের মতো বোমারু বিমানগুলো উড়েছে। ঢাকায় নাকি মুক্তিফৌজ-এর পোষ্টার লিফলেট ছড়িয়ে বলা হয়েছে ঢাকা ছাড়তে। অবস্থা দিন দিন শ্বাসরুদ্ধকর হয়ে উঠছে।
আজ দুপুরে অদ্ভুত একটা স্বপ্ন দেখলাম। কে একজন আমার গোসল করা ভিজা কাপড় দেখবার জন্য ঘুরে বেড়াচ্ছে, আর আমি প্রাণপণে শরমে লুকিয়ে বেড়াচ্ছি। আজ সকালে খবর পেলাম কাল রাত ১০টায় হাসপাতালে হাসিনার একটি ছেলে হয়েছে। আল্লাহ হায়াত দেন। বাচ্চা হবার সময়ও মা কাছে থাকবার অনুমতি পেল না। অমানুষরা মানুষ হবে কি?

২৯ জুলাই (বৃহস্পতিবার)
রাত ৯টা
ছোটনের চিঠি আজও নেই। জাকু এসেছিল, তবুও কিছু সান্ত্বনা। কোনো খবরই কারুর নেই, আল্লাহ নেগাহ্‌বান থাকুন। কাল নাকি কমলাপুর রেল স্টেশনে বোমা পড়েছে, ঠিক জানি না। আজ একটু আগে একটা শব্দ হলো। কোথায় কি জানি। বোমারু খুব উড়ছে। দলে দলে লোক চলে যাচ্ছে। সব জিনিসের দাম বাড়ছে। জামাল এসেছিল। আল্লাহ সবাইকে ভালো রাখুন। সবার ভালো হোক।

৩০ জুলাই (শুক্রবার)
রাত ৯টা
বিকালে বৌমা আমি হাসিনার ছেলে দেখতে হাসপাতালে গেলাম। কি ভীষণ দুর্ব্যবহার যে করল ওখানের মিলিটারীর পাহারাদারটা। হাসিনার মা মাত্র ১০ মিনিটের জন্য গতকাল ওদের দেখতে পেয়েছিলেন। আজ হতে কড়া নিয়ম চালু করা হল, কোনো মানুষই আর ওদের দেখতে যেতে পারবে না। এ যে কি অমানুষিক ব্যবহার। জেলখানার কয়েদীও সাক্ষাতের জন্য সময় পায়। আল্লাহ আর কত যে দেখাবে। আজও ছোটনের চিঠি নেই, কারুর কোনো খবর নেই। আল্লাহর হাতে সঁপে দিয়েছি, আল্লাহ নেগাহ্‌বান।

৩১ জুলাই (শনিবার)
রাত ১১টা

কে আছে সৌভাগ্যবতী আমার মতন
এক পুত্রহীনা হয়ে শত পুত্র ধন
লভেছি, সৌভাগ্য মোর। শতেক দুহিতা
সারা বাংলাদেশ হতে ডাকে মোরে
মাতা জননী আমার! তুমি করিয়ো না শোক
তুমি আছ পূর্ণ করি সর্বান্তর লোক।
এ সান্ত্বনা, এ সৌভাগ্য লভি কুণ্ঠা মানি
কতটুকু সাধ্য মোর, কি যোগ্যতা আমি নাহি জানি
পথে চলে যেতে শুধায় কুশল কত হাসিভরা মুখ
মোর পানে চায়, কি জানি আশায় ভরে ওঠে মোর বুক।
আমি ভালোবাসি এ দেশের মাটি, এদেশের মানুষেরে
পথে পথে ফিরি ভিক্ষা মেগেছি সব মানুষের তরে
ভিক্ষার ঝুলি ভরেছে ওরাই ওদেরি হাতের দানে
ওদেরই সভায় ঘুচাতে চেয়েছি ওরা তাও জানে।
অন্তর দিয়ে অনুভব করি ধুঁকে এই বাঁচা
অত্যাচারীর ছুরিকার তলে দিল প্রাণ মোর বাছা
পথের ধূলায় লুটায়ে রুহির এখনও দেশের মাটি
রক্তে নাহিয়া হয়ে সোনা- হীরকের চেয়ে খাঁটি
আমার বাছার রক্তের সাথে কত সে মায়ের বাছা
বাঁচিয়া বাঁচায় বিপুল ভুবনে মোর সব সন্তানে
বক্ষ বহ্নি হাসির পুস্পে ফুটাইব সযতনে
শতেক জনার মা ডাকায় মোর শান্তি লভুক মন
কে আছে সৌভাগ্যবতী আমার মতন!