মার্চ ১৯৭১

১ মার্চ (সোমবার)
রাত ১০টা
বিক্ষুব্ধ বাংলা! ভুট্টো সাহেব পরিষদে যোগ দিবেন না সিদ্ধান্তে। পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য মুলতবী রইল। ১২টায় এ খবর প্রচারিত হওয়ায় স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে গেল। অনার্স পরীক্ষা ২ তারিখে আর ৬ তারিখে শেষ হওয়ার আশাও গেল। আজ ইন্টারমিডিয়েট কলেজে মেয়েরা শহীদ মিনার উদ্বোধন করার জন্য আমাকে নিয়ে গেল, কিন্তু গোলমালে সবই বন্ধ হয়ে গেল। শেখ মুজিবুর রহমান মওলানা ভাসানী, আতাউর রহমান, আরও অনেক নেতাদের এক হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। কাল ঢাকায় হরতাল, পরশু সারা প্রদেশব্যাপী হরতাল ঘোষণা করা হল।

২ মার্চ (মঙ্গলবার)
রাত ৯টা
আজ রাত ৮টা থেকে সকাল ৭টা পর্যন্ত কারফিউ অর্ডার হয়ে গেল। আমরা ঘরে এলাম ৭টায়। শামীম কাল রাতে অফিসে গেছে আজও আসতে পারল না, কালকেও পারবে না, পরশু বাড়ি আসবে। শুধু ঢাকায় হরতাল হবার কথা ছিল। কিন্তু প্রদেশের সব জায়গায় আজ হরতাল হল। কালও হবে। কাল সন্ধ্যা থেকে প্লেন সার্ভিস বন্ধ। এয়ার পোর্টের আলো পানি টেলিফোন লাইন সব কেটে দিয়েছে। ট্রেন চলাচলও বন্ধ। ফার্মগেট এ ইটের ব্যারিকেড ঘিরে দেওয়ার সময় আর্মির গুলীতে একজন মরেছে, ৩ জন আহত হয়েছে। এই মাত্র শোনা গেল নওয়াবপুরে খুব গণ্ডগোল চলছে। দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয় ও ইডেন বিল্ডিং এর পাকিস্তানী পতাকা নামিয়ে বাংলাদেশের ম্যাপ আঁকা পতাকা উড়িয়েছে। ভাসানী সাহেবের সাথে শেখ মুজিবুর রহমানের আলাপ আলোচনা প্রকাশ করা হয়নি। বায়তুল মোকাররম এ আমেনা বেগমকে জনতা অপমান করেছে বলে জানা গেল। কারফিউ ভেঙ্গে জনতা মিছিল করছে, মরছে।

৩ মার্চ (বুধবার)
কাল সারা রাত হট্টগোল চলেছে। জিন্না এভেনিউ, নবাবপুরে লুট মারামারি হয়েছে। আজ সকালে কাগজে ৩ জনের মৃত্যু সংবাদ দিল। বিকালে পল্টনে ছাত্রদের শোক সভায় লক্ষ লোকের সমাবেশে শেখ মুজিব নিজের আদেশ প্রচার করেছেন। সমস্ত অফিস কারখানা বন্ধ দিতে বিগ্রেডিয়ারকে বলেছেন, সে দেশ রক্ষার জন্য বেতন নিচ্ছে এখানে জনতার উপর গুলী না চালিয়ে বর্ডারে গিয়ে দেশ রক্ষার কাজ করুক। সাবাশ! এইত চাই। জনতা উন্মাদ হয়ে স্বাধীন পূর্ব বাংলা করছে। ৭ তারিখ পর্যন্ত হরতাল। সকাল থেকে ২টা পর্যন্ত চলবে। ১০ তারিখে ইয়াহিয়া নাকি ঢাকা এসে সভা ডাকছে, এসেম্বলি বসবে। আজ রাত ১০টা থেকে সকাল ৭টা কারফিউ। ভাসানী সাহেব পলাতক।

৪ মার্চ (বৃহস্পতিবার)
পল্টন ময়দানে শহীদদের জানাজা হল। কত মায়ের বাছা, বধূর স্বামী, ভাইয়ের ভাই চলে গেল। লুটতরাজ আওয়ামী লীগের স্বেচ্ছাসেবকরা রোধ করছে। কারফিউ উঠে গেল। হাসপাতালে আহতের সংখ্যা ৪০, বি. বি. সির খবরে ২ হাজার মারা গেছে। আরও কত যাবে কে জানে। রক্ত সংরক্ষণের জন্য আহ্বান জানানো হয়েছে। ড. আনিস রক্ত দিয়ে এলেন। সারাদিন মিছিল চলছে।

৫ মার্চ (শুক্রবার)
কাল রাতে কোনো গোলমাল হয়নি। সকালে টঙ্গিতে মিলিটারী বেপরোয়া গুলি চালিয়ে লোক মেরেছে। ৯টায় শ্রমিকরা মিছিল করে শেখ মুজিবের বাড়িতে এসেছে। আগামী কাল শহীদ মিনারে মহিলারা বিক্ষোভ মিছিল করবেন আওয়ামী লীগ থেকে। আবার মহিলা পরিষদের প্রতিবাদ সভা বায়তুল মোকাররমে অনুষ্ঠিত হবে। কাল রাতে হঠাৎ মোটর বাইকে করে ইডেন বিল্ডিংয়ের সামনে একটা বোমা নিক্ষেপ করে লোক পালিয়েছে। অন্য কোথাও গোলমাল শোনা যায়নি।

৬ মার্চ (শনিবার)
রাত ১০টা
আজ ৩টায় শহীদ মিনারে আওয়ামী লীগ মহিলা শাখার বিক্ষোভ সভা থেকে বায়তুল মোকাররমে পূর্ব পাকিস্তান মহিলা সমিতির বিক্ষোভ মিছিল বাহাদুর শাহ পার্কে গিয়ে শেষ হ’ল। আওয়ামী লীগের মহিলারা গেলেন তাদের অফিসে। ইয়াহিয়ার বেতার ভাষণে জনতা ক্ষুব্ধ। ২৫শে পর্যন্ত অধিবেশন মুলতবী হল। ইয়াহিয়া রূঢ়ভাবে ঘোষণা করলেন, আর্মি নেভি তার হাতে থাকা পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানের গুটিকয় সুবিধাবাদীদের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দেবেন না। দেখা যাক। আগামীকাল ঘোড়দৌড় ময়দানে শেখ মুজিবুর রহমানের বিরাট সভা অনুষ্ঠিত হবে।

৭ মার্চ (রবিবার)
রাত ৯টা
সকাল থেকে শহীদ সোহরাওয়ার্দী ময়দানে (ঘোড়দৌড় ময়দানের নাম বর্তমানে এটি) লোকজন জমা হচ্ছে। ১টার সময় তাড়াহুড়া করে আমরাও রিকশা করে গিয়ে পৌঁছলাম। মঞ্চের সামনেই স্থান পেলাম। মেয়ে স্বেচ্ছাসেবিকারা বল্ল, বসুন আপনি আমাদের নিজের লোক, মনের মানুষ কাছের মানুষ। এম. এন. এরা গিয়ে দূরে চেয়ারে বসুন। অন্তরটা জুড়িয়ে গেল শুনে। আমি দেশের মানুষের মনের মানুষ। একী ভাগ্যের কথা। ৩টা ২০ মিনিটে মুজিব এলেন বিমর্ষ মলিন মুখে। সৈন্যবাহিনী সামরিক আইন প্রত্যাহার না করলে তিনি অধিবেশনে যোগ দিবেন না। রেডিওতে তার বক্তৃতা রিলে করতে দেওয়া হলো না। তিনিও অফিস আদালত স্কুল কলেজ অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ রাখতে বললেন। স্বাধীনতা সংগ্রামের আহ্বান জানিয়ে সভা শেষ করলেন।

৮ মার্চ (সোমবার)
আজ সাড়ে আটটায় মুজিবুর রহমানের সম্পূর্ণ ভাষণ রেডিওতে রিলে হলো। সেই তো মল খসালি, তবে কেন লোক হাসালি। এই কথাই মনে হয়। আজ ঢাকার নাগরিক জীবন স্বাভাবিক। কিন্তু কেমন একটা থমথমে ভাব ঘরে ঘরে। কারুর যেন সোয়াস্তি নেই। আল্লাহ্ মুজিবুর রহমানকে সুস্থ ও দীর্ঘায়ু করুন। এই প্রার্থনা। আজ ত মহরমের আশুরা। কিন্তু কোনো মিছিল বা অনুষ্ঠান হয়নি। সারা বছরই শহীদ দিবস নতুন করে আর কি হবে। কাল সন্ধ্যায় রেডিও অফিসের সামনে জীপে করে কারা দুটো হাত বোমা ফেলে গেছে।

৯ মার্চ (মঙ্গলবার)
রাত ৯টা
আজ বেলা ১টায় মুজিবুর রহমানের বাড়ীর সামনে ছদ্মবেশী পাগল সেজে ৩ জন লোক এসেছিল, সন্দেহজনক ভাব দেখে গ্রেফতার করে। ৩টা পিস্তল শুদ্ধ ধরা পড়েছে মিলিটারী ইনটেলিজেন্সের কাগজপত্রসহ। ৩টার সময় ভাসানী সাহেব পল্টনে বক্তৃতায় স্বাধীন বাংলা ঘোষণ করেছেন। আতাউর রহমান সাহেব সুদ্ধ তা সমর্থন করেছেন। টিক্কা খান এর গবর্ণর পদ শপথে কোনো জজই উপস্থিত হয়ে শপথ গ্রহণ করাননি। ভাসানী বলেছেন, দুই পাকিস্তানের আলাদা সংবিধান হবে। দুই দেশের রাষ্ট্রদূত দুই দেশে থাকবে। অখণ্ড পাকিস্তান আর থাকবে না।

১০ মার্চ (বুধবার)
রাত ১০টা
আজ ঢাকা স্বাভাবিক। চট্টগ্রামে যে লোকেরা বিহারীদের হাতে মরেছে, তার হিসাব নেই। ট্রেন চলছে। প্লেন বন্ধ, ফরেন অফিস, পোস্ট অফিস বন্ধ। শাব্বীরকে চিঠি দিতে পারলাম না। ৩ জাহাজ ভর্তি সৈন্য চাটগাঁ বন্দরে উপস্থিত। পি. আই. এ’র বাঙালি কর্মচারীর হাত থেকে পি. এ. এফ.- সম্পূর্ণ ক্ষমতা নিয়ে সৈন্য আনছে। ঢাকার ক্যান্টনমেন্ট সৈন্যে অস্ত্রে সম্পূর্ণ প্রস্তুত।

১১ মার্চ (বৃহস্পতিবার)
রাত ১১টা
মহিলা পরিষদে শান্তি কমিটি গঠনের প্রস্তাব নেওয়া হল। সারা আলীর বাড়ীতে কমিটি মিটিংয়ে আরও সিদ্ধান্ত নেওয়া হল মহিলা পরিষদ থেকে ১ হাজার টাকা রোকেয়া স্মৃতি কমিটিতে দেওয়া হবে। আজ কাগজে আছে সামরিক রসদ সরবরাহের ব্যবস্থা সুষ্ঠুভাবে না চললে সামরিক আইনে বিশেষভাবে ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। রাতে হাজারীর বাড়ী নিয়োগী বাবুর সাথে দেখা হল, অনেক কথা হল। অন্তর্দ্বন্দ্বে ভুগছি বলে বল্লেন, এ অন্তর্দ্বন্দ্বের কি শেষ আছে? বহু যশ, মান আরও ভাগ্যে নাকি আছে। কিন্তু মৃত্যুর চেয়ে কাম্য আর কি আছে? আজ বসন্ত পূর্ণিমা।

১২ মার্চ (শুক্রবার)
রাত ৯টা
কাল গেল বসন্ত পূর্ণিমা। বড় সুন্দর রাত কিন্তু বড় যন্ত্রণায় রাতটা কাটল। মানুষের দেহ কারাগারে বন্দী, আত্মার ক্রন্দনের সীমা নেই, গুমরে গুমরে কাঁদে সে মুক্তির জন্য, সুন্দরে বিলীন হওয়ার জন্য। সংসার যে কত কঠোর! বেঁচে থাকার সে কত মাল দিতে হয়!
ঢাকার অবস্থা স্বাভাবিক। মিছিল চলছে সারা দিন রাত। কিন্তু এই স্বাভাবিকতাই এখন এত অস্বাভাবিক লাগছে। ঝড়ের আগের স্তব্ধতা নয়ত। টিক্কা খান এত অবহেলা লাঞ্ছনা অপমান নির্বিকারে সহ্য করে যাচ্ছে, আশ্চর্যত!

১৩ মার্চ (শনিবার)
রাত ১১টা
পথ সভা আর পথ সভা। সারা দিন চলছে মিছিল মিটিং। আজ ইয়াহিয়া মুজিবুর রহমানের সঙ্গে দেখা করতে ঢাকা আসছেন। রাত ৮টায় ঘোষণা হল ১৪৪ ধারা। সামরিক কর্মচারীরা সোমবার থেকে কাজে যোগদান না করলে ১০ বত্সর কারাদণ্ড হবে। বি. বি. সি. থেকে নাকি প্রচার হয়েছে, মুজিবুর রহমান যেন ইয়াহিয়ার সাথে দেখা না করে, বামপন্থী ছাত্ররা আপত্তি তুলেছে।
আজ সারা দিন ব্যর্থ গেল। কি জানি একটা আশা ছিল মনে, সেটা হল না। যে আসবার সে আসেনি।

১৪ মার্চ (রবিবার)
রাত ১০টা
এতক্ষণে হয়ত রোজী-শাব্বীরের বিয়ে হয়ে গেল। কাল সারা রাত ভেবেছি আল্লাহ যেন ওদের জীবন শান্তিময় করেন। ছোট পাখীটা অসহায় সন্তানটিকে তেজগাঁ বিমানবন্দরে উড়িয়ে দিয়ে ছিলাম সাড়ে সাত বছর আগে। আজ যেন ও জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়।
রাশিয়ান কনসাল জেনারেল মি. পপোভ ও মি. নভিকভ আজ এসেছিলেন। শহীদুল্লা কায়সার ও আলী আকসাদও এসেছিল। অনেক কথা হল। কিছু উপহারও পেলাম। দিনে দিনে খ্যাতির বোঝা মানের বোঝা বেড়ে উঠেছে। একী আমি চেয়েছিলাম! আমি কি এর যোগ্য হাজারীবাগ এ মহিলা পরিষদের সভা করে প্রাথমিক শিক্ষা ও প্রাথমিক স্বাস্থ্য রক্ষার প্রস্তাব গৃহীত হল। ইয়াহিয়া খান আজ ঢাকায় আসেননি।
কাল রাতেও যে আসবার, সে আসেনি।

১৫ মার্চ (সোমবার)
আজ ১লা চৈত্র। বিকাল ৪টার মহিলা পরিষদের পথ সভা ও পথ মিছিল করে ৬ টায় বাড়ী এসে ৭টায় হাজারীর বাড়ী গেলাম। নিয়োগী বাবু লুলু টুলুর বিষয়ে বল্লেন, টুলুর বিয়ে খুব শিগগির হয়ে যাবে। বিদেশে বহু দিন থাকবে। সবাই কিন্তু টুলুর বিষয়ে এ কথা বলে, ছবি আঁকায়ও সুনাম অর্জন করবে। লুলুর নাকি শনি প্রভাবে স্বাস্থ্য নষ্ট হয়েছে, গোমেদ ও হীরা ধারণ করতে বলেছেন।
কাল রাতেও সে আসেনি কিন্তু নিয়োগী বাবু বল্লেন আজ রাতে সে আসবে। ইয়াহিয়া খান ঢাকায় এসেছেন, আজ রাতে মুজিবুর রহমানের সাথে কথা বলবেন। ফার্মগেটে আজ একজন পাঞ্জাবী চেকপোস্ট পার হতে গিয়ে সংঘর্ষে গণ্ডগোল হয়েছে।

১৬ মার্চ (মঙ্গলবার)
রাত ১০টা
আজ মুজিব ইয়াহিয়া আলাপ হল। কিন্তু কি কথা হয়েছে এখনও প্রকাশ হয়নি। শিল্পী সাহিত্যিক কবিদের সভা শহীদ মিনার থেকে বায়তুল মোকাররম হয়ে বাহাদুর শাহ পার্কে মিছিল করে যাওয়া হল। অনেক মিছিল, অনেক সভা, অনেক জনতা, সবাই বেপরোয়া। মরণের মধুর স্বাদ এদের উন্মাদ করেছে। কোনো ভয় ভীতি নেই।
কাল রাত বড় অস্থিরতায় কেটেছে, সে আসতে চেয়েও আসে না। দূর থেকে কাল দেখা দিয়ে গেছে। আজ হয়ত আসবে। সামান্য কথা নিয়ে বড় আঘাত সয়ে যাচ্ছি। এত সংকটের বোঝা যে আর বইতে পারছি না। বাইরের এত সম্মান, কত মূল্য যে দিতে হয়।

১৭ মার্চ (বুধবার)
কাল রাতে ও আজ সকালে মুজিবুর রহমান- ইয়াহিয়ার বৈঠক হল, কোনো কথাই এখনও জনসাধারণের কাছে প্রকাশিত হল না। কাল আবার বৈঠক বসবে। জাস্টিস কর্নেলিয়াসকে আনানো হয়েছে, চারজন জেনারেলও বৈঠক কালে প্রেসিডেন্ট হাউজে উপস্থিত থাকেন। মুজিব বন্দী জনগণের মতামতে, ইয়াহিয়া বন্দী সেনা বাহিনীর হাতে। আজ মুজিবের ৫২ বছরের জন্ম দিন। আল্লাহ হায়াত দেন। জয়ী হোক বাংলাদেশের ছেলে।

১৮ মার্চ (বৃহস্পতিবার)
আজিমপুর লেডিস ক্লাব-এ আজ মহিলা পরিষদ থেকে সংগ্রাম কমিটির সভা হল। অনেক মেয়েরা এসেছিলেন। বেশ উৎসাহী আজ-কাল দেশের মানুষ। তাই দেখা গেল কয়েকজন পুরুষও এসে সভায় শামিল হলেন। উৎসাহ বাক্যে সমর্থন জানালেন। সব দুঃখের মাঝে এযে কত বড় আশা।

১৯ মার্চ (শুক্রবার)
আজ ১১টায় কবি শামসুর রাহমান ও আমার কবিতা রেকডিং হল। যে কবিতা আগে রেডিওতে পড়া হত না, এখন তা স্বচ্ছন্দেই পড়া চলছে। একেই বলে দুনিয়া! বেশ ভালো লাগল দেশের মানুষ জেগেছে, কে ঠেকাবে। আজ মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠক হল। বিকালে আবার মুজিবের পক্ষের ও সৈন্যবাহিনীর পক্ষের লোকের বৈঠক হল। কি বলা কওয়া হল জানা যায়নি। ২৩ তারিখের জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই।

২০ মার্চ (শনিবার)
৪০ নং এনায়েত বাজার, চট্টগ্রাম।। রাত ১টা
মহিলা পরিষদের সভায় চাটগাঁ আসবার জন্য বেলা ১২টায় এসে ট্রেনে বসেছি। রাত ১০টায় চাটগাঁ এসে উঠলাম। মালেকা আর আমি। দুলু, সিমিন, আব্বু স্টেশনে ছিল, নজমুল হুদা ছিলেন। কওসর, মোরদি কেউ বাড়ী নেই। এতক্ষণে দুলুর সাথে গল্প করে উঠলাম।

২১ মার্চ (রবিবার)
রাত ২টা
সকাল ১০টায় বের হলাম, ফজল সাহেব, বুলবুল, আপার সাথে দেখা করলাম। ১টায় ফিরে এসে খেয়ে সভায় গেলাম জে. এম. সেন হলের মাঠে দেড় হাজারের মতো মেয়ে, বাইরেও পুরুষের অসম্ভব ভিড় হল। মালেকা বক্তৃতা দিল। ওখানে হান্নানা, পদ্মপ্রভা সেনগুপ্তা, মিসেস শরফুদ্দিন, মুশতারী শফী বল্লেন। উমু (উমরাতুল ফজল) সভানেত্রী। আমি বল্লাম। আবার মিছিলে জিন্না পার্কে শহীদ মিনার পর্যন্ত গেলাম। ফজল সাহেবের বাড়ীতে কমিটি মিটিং করে বাড়ী এসে ৮টায় বুলুকে দেখতে জাহেদের বাড়ী গেলাম। সাড়ে দশটায় এসে শাহজাহানের বাড়ীতে খেয়ে ১২টায় বাড়ী এসে মাহবুবের কবিতা লিখে দিলাম। ৩টায় শুলাম।

২১ মার্চ (রবিবার)
রাত ১২টা
দিগন্তে প্রদীপ্ত সূর্যকর
উদ্ভাসিয়া তুলিয়াছে দিনের প্রহর
নবীন জীবনালোকে ক্ষরি
প্রান্তরের দীর্ণ বক্ষভরি
শ্যামল সতেজ সমারোহ
উদগত হতেছে অহরহ।
প্রাণধর্মে মর্ম মধু রসে
নিত্য পুষ্প বিকশিছে আলোক পরশে।
দিনান্ত ত শূন্য নহে নিত্য সূর্য চন্দ্র তারকার
জ্যোতির লিখন লেখি নাশি অন্ধকার
প্রভাতে সন্ধ্যায় রাতে দিনে
সুষমা বিথরি যায় বিপিনে বিপিনে
নিত্য আনে নব জাগরণ
সুবীরে জাগায়ে স্পন্দন-
আত্ম সমাহিতে করি জাগ্রত প্রভায়
সীমান্তে নবীন সূর্য লক্ষ প্রাণ অঙ্কুর জাগায়।

২২ মার্চ (সোমবার)
রাত ১০টা
রাত ৩টায় শুয়ে ৫টায় উঠে ৬টার উলকা ধরে বেলা ৩টায় ঢাকা এলাম। ৭টায় শহীদ মিনারে ছায়ানটের গান শুনতে গিয়ে শুনলাম কাল সকালে ৭টায় সেটা শহীদ মিনারে হবে।
বৌমার বাড়ী থেকে ৯টায় ফিরলাম। কওসর ও বুলুর জন্য মনটা যে কি অস্থির। বাড়ীতে এসে আল্লাহর ফজলে সবাইকে ভালো দেখলাম। দুলুটার বাড়ীর চাকর নেই। সিমিন দুলু যা খাটছে। মনটা ভালো নেই। বড় ক্লান্তি লাগছে এখন।

২৩ মার্চ (মঙ্গলবার)
রাত ১১টা
২৩শে মার্চ-এ পাকিস্তান দিবস উৎসব এবার স্বাধীন বাঙলা উৎসব বলে পালিত হল। বাংলার ম্যাপ আঁকা পতাকা উড়ল ঘরে ঘরে, অফিস, হাইকোর্ট, হোটেল, গাড়ী, বাড়ীতে। অভূতপূর্ব উত্তেজনায় কাটল। এত আন্দোলন, জয়ী হতেই হবে, এই কথাটা মনে পড়ছে।
আজ জিগাতলা-রায়ের বাজার মহিলা পরিষদের সগ্রাম পরিষদ শাখা উদ্বোধন করে এলাম। এত উত্তেজনায় মেয়েরা দলে দলে যোগ দিচ্ছে সভা শেষে পরদানশীল বোরকা পরা মহিলারা মিছিল করে শেখ মুজিবের বাড়ী পর্যন্ত এল। বেচারাকে লোকেরা পাগল করে না দেয়।
শাব্বীরের কোন চিঠি আজও পেলাম না।

২৪ মার্চ (বুধবার)
রাত ৯টা
পলাশী ব্যারাক স্কুলে আজ মহিলা পরিষদের সংগ্রাম কমিটির শাখা করে এলাম। শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। তবুও মেয়েদের এই উৎসাহে ভাটা পড়ে না যায়। সেই জন্য যাচ্ছি ঐ সব জায়গায়। সবাই যখন আমাকেই চায় তখন না গিয়ে উপায় কি?
একি সৌভাগ্য না দুর্ভাগ্য তা বুঝতে পারছি না। আজ সকালে মেহেরুন এসে বল্লে বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়েছে বলে কাল রাতে মীরপুর ওদের সেকশনে বিহারীরা আগুন লাগিয়েছে। এই রূঢ়, রুষ্ট বিহারীদের নিয়ে দিনে দিনে সমস্যা জমে উঠছে, বাঙ্গালিরা এবার যথেষ্ট ধৈর্য দেখিয়েছে। আজও ভুট্টো ইয়াহিয়ার কোনো শুভবুদ্ধির পরিচয় পাওয়া গেল না। বৈঠকের শেষ নেই।

২৫ মার্চ (বৃহস্পতিবার)
রাত ১০টা
নিয়োগী বাবুর সাথে দেখা করে এলাম। দেশের অবস্থা ভালোর দিকে যাচ্ছে না। ২৯ তারিখের মধ্যে কিছু সমঝোতা হলে ভালো, নয়তো ধাক্কা সামলাতে কষ্ট হবে। আজ সারা ঢাকার জনগণ অধৈর্য। এতদিন ধরে বৈঠক চলছে, কোনো নিষ্পত্তির কথাই শোনা যাচ্ছে না। জানিনা, মুজিবের কপালে কি আছে!
নিয়োগী বললেন, বিপ্লব মাথা তুলবে। আজ কোনো সভা সমিতিতে যাইনি। শরীরটা ভালো না। মন ভালো নেই বলে লিখতেও পারছি না কিছু।

২৬ মার্চ (শুক্রবার)
রাত ১০ টা
গতকাল রাত পৌনে ১২টায় হঠাৎ করে চট্টগ্রাম থেকে ফোন এল, ঢাকায় কোনো গণ্ডগোল হচ্ছে কিনা। ততক্ষণ পর্যন্ত ঢাকা শান্ত। ফোনটা রাখা মাত্র পুলের উপর ‘মা’ বলে একটি আর্তনাদ শুনা গেল, পরপর মেশিনগানের শব্দ ও জয়বাংলা শব্দের পর অবিরাম রাইফেল বোমা স্টেনগান মেশিনগান এর শব্দ, সাত মসজিদ, ই. পি. আর. এর দিক থেকে গোলা কামানের শব্দ, জয় বাংলা আল্লাহু আকবর এর আওয়াজ ২টা পর্যন্ত হল, তারপর থেকে শুধু কামান গোলা গুলির শব্দ, রাত সাড়ে ৩টায়। মিলিটারী ভ্যান বাড়ীর সামনে দিয়ে এসে আবার চলে গেল। কাল থেকে কারফিউ জারী। শোনা যাচ্ছে, মুজিব বন্দী। ও দিক থেকে আগুনের আভা দেখা যাচ্ছে। আজ রাত ১০টা পর্যন্ত। রেডিওতে ইয়াহিয়া ৮টায় ভাষণ দিল। আওয়ামী লীগ বন্ধ। মুজিব শর্তে আসেননি, সামরিক শাসন অমান্য করেছেন বলা হচ্ছে। এখন পর্যন্ত মেশিনগানের শব্দ আসছে। মানুষের শব্দ কোথাও নেই, ঘর থেকে বের হতে পারছি না।

২৭ মার্চ (শনিবার)
রাত ১০টা
সন্ধ্যা ৭টা থেকে রায়ের বাজারের মিলিটারী ধ্বংসলীলা চলেছে ১০টা পর্যন্ত। সমস্ত ঢাকা সামরিক শাসনে সন্ত্রস্ত। হাট বাজার নেই। বৃষ্টি নেই, সব পুড়ে যাচ্ছে। পুড়ে যাচ্ছে অভাবী, সহায়হীন দুঃস্থ মানুষের জীবন। এদের উপর যে অমানুষিক অত্যাচার চলছে, তার জওয়াব আল্লাহর কাছে কারা দেবে? কি দেবে? শোনা গেল টিক্কা খান আহত। মুজিব বন্দী। কারফিউ সকাল ৭টা পর্যন্ত। রাতে কামানের আওয়াজও শোনা গেল। ট্যাঙ্ক বাহিনী সব ধ্বংস করে দিচ্ছে।

২৮ মার্চ (রবিবার)
অজি ১২টায় কারফিউ হবার কথা ছিল। আবার সময় পালটে বেলা ৫টায় কারফিউ হল। ছেলে মেয়ে কার বুকের ধনরা কে কোথায়? আল্লাহ নেগাহ্বান। আল্লাহ সবার ভালো করুন, সুমতি দেন। সারা ঢাকা- সারা দেশ আতঙ্কিত। এই যদি পাকিস্তান বান্দাদের ভাগ্যে আছে, তবে কেন পাকিস্তান হয়েছিল? ‘বিজাতির’ দমনে অতিষ্ঠ হয়ে মুসলমানরা সর্বহারা হয়ে পাকিস্তান এনেছিল। আজ পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি পাকিস্তানবাসীদের বুকে গুলী চালাচ্ছে, অসহায়, নিরস্ত্র, নির্বোধ মানুষের বুকে।

২৯ মার্চ (সোমবার)
রাত ৯টা
এত দিনে আজ বহু গর্জনের পর বৃষ্টি নামল। অরুণের করুণা ধারা। বাংলার বুক শ্যামল হোক, সুশোভন হোক, পবিত্র শহীদের রক্ত গন্ধমুক্ত হয়ে শান্ত হোক, শীতল হোক, সিন্ধ হোক, কাটুক বাংলার অভিশাপ। মুক্ত হোক, বন্দী ব্যথিত আর্ত অসহায় জনের আত্মার আত্মীয়। বাংলার বুক ভরুক গৌরবে। আনন্দে। কাল সারারাত আজ সারা দিন এ পর্যন্ত কোনো অঘটন ঢাকায় শোনা যায়নি। চাটগাঁর অবস্থা অজ্ঞাত। রেডিও বন্ধ। বৃষ্টি শুধু নয়, প্রবল শিলা বৃষ্টিও হল সাথে কঠোরতার আর সীমা নেই। সব ফুল ফল আমের গুটি শেষ। আল্লাহ কি করছে এ সব?

৩০ মার্চ (মঙ্গলবার)
রাত ১০ টা
কত দিন হয়ে গেল। চাটগাঁর কোনো খবর নেই। কওসার সিলেটে, তারও কোন খবর নেই। আমার দোলন, ওর স্বামী সন্তান, সংসার নিয়ে কিভাবে আছে। আছে না মরে গেছে জানি না। মন অস্থির। নামাজ পড়ি, কোরান পড়ি, মন অস্থির। সমস্ত দেশ জ্বলে পুড়ে মরে নিঃশেষ হয়ে যাবে। এ যে কোন্ জালেমের জুলুম বুঝতে পারি না, আতঙ্কে আশঙ্কায় মানুষের রাত দিন কাটছে। আমার ভয় নেই, ভাবনা কিছু এদের জন্য, নিজের মৃত্যু ত কাম্য।

৩১ মার্চ (বুধবার)
রাত ৯টা
আজ ৩টা থেকে আবার বৃষ্টি, শিলা বৃষ্টি প্রচুর হল। কোথাও কোনো ভালো খবর নেই। চাটগাঁর কোনো খবর নেই, সিলেটের খবর নেই। নামাজ পড়েও ভালো লাগছে না, ওগো অকরুণ! এত পরীক্ষা ভঙ্গুর মানুষের উপর চালালে কত সে সইবে, শান্তিনগরের বাজারটা কাল পুড়িয়েছে।