অক্টোবর ১৯৭১

অক্টোবর ৩ (রবিবার)
রাত ৮টা। কিছুই যেন নতুন করে জানার নেই, বােঝাবার নেই, একই পুনরাবৃত্তি চলছে মাস ধরে কোনো খবর কারুর নেই। আজ ১০ দিন হল জামাইটা গেছে ফেরাউনের দেশে এজিদের ব্যুহের মধ্যে, কোনাে খবর নেই, চাটগাঁয়ে ফোন করা যাচ্ছে না তবে মনটা বলছে সবাই ভালাে আছে, কাহহার ফিরে এলে নিশ্চিন্ত হতাম। অকটোবর বিপ্লব দিবস গত ক’বছরে কত যে সমারােহে পালন করা হয়েছে, এবার কি করে কি হবে জানি না। আল্লাহ নেগাহবান। একটু খবর যদি সবার পেতাম।

অক্টোবর ৫ (মঙ্গলবার)
আজ শব-ই-বরাত, ভাগ্যের রাত। ওগো দিন রাতের সন্ধ্যা ঊষা, ইহকাল পরকালের মালিক। তুমি কার ভাগ্যে কি লিখন লিখেছ, কি দান কাকে দিলে প্রভু। সারাদেশ, কোটি মানুষের ভাগ্যে লিখন কি লিখলে? কত আর দিন কাটাবে এই নিয়ে? আজ একটু খবর পেলাম ঘর ছাড়াদের, দুলুটায় ফোনও পেলাম। এও তোমার কাছে শােকর। আর শবেবরাত, কতঘর মায়ের বুক খালি। ভালো কর। সবার ভালাে হোক, শান্তি সােয়াস্তি ফিরিয়ে দাও। কাটাকাটি মারামারি জুলুম আর কত সহ্য করবে মানুষ।

অক্টোবর ৭ (বৃহস্পতিবার)
সন্ধ্যা ৭টা। একটু আগে দুলুর ফোন পেলাম। বাবা বাড়ী এসেছেন, লাখ শোকর, শােকরানার নামাজ পড়লাম। ঝুনুর মা খালা মুক্তার বিয়ের দাওয়াত দিয়ে গেলেন। বাছা ননিদেরও খবর পেলাম। আল্লাহর কাছে শোকর। কত যে হালকা লাগছে বুকটা, আল্লাহ। তুমি ইজ্জত হুরমত হায়াতের মালিক। ছােটনের চিঠি আজও পেলাম না।

অক্টোবর ৮ (শুক্রবার)
মিলনদের সঙ্গে ওর ভাইয়ের সাথে মুক্তার বিয়ের গায়ে হলুদের জন্য গুলশানে কুটির বাড়ী গিয়ে কত কথা যে শোনা গেল। আজব গুজব, সুখের দুঃখের ক্ষোভের ব্যাথার, আল্লাহ মেয়েদের বেইজ্জতি আর কত সহ্য করবে তা আল্লাহই জানে। দুঃখে ক্ষোভে ব্যথায় বুকের রক্ত ফেটে বের হতে চায়। অসহায় মানুষ। ওগাে স্রষ্টা। ওগাে রহমানুর রহিম। এখনও তােমায় রহমত নাজেল হবে না। বুক, ঘর সব খালি করেও কি ধ্বংসলীলার সাধ তোমার মিটল না।

অক্টোবর ১১ (সোমবার)
মুক্তার বিয়েও হয়ে গেল। বিয়েতে গেলাম আজ দুপুরে বৌভাতও খেয়ে এলাম। শান্তিতে যেন থাকে দু’টি জীবন। আজ শিউলি গাছে ৫টি ফুল পেলাম। পাঁচটি প্রাণ। নির্মল সুগন্ধ সুন্দর নির্মল হয়ে উঠুক, এই শরত দিনের মতাে। আমার বাছারা নিরাপদে থাকুক। কাল রাত থেকে কুকুরগুলো এক সাথে কাঁদছে। আল্লাহ রহম করুন, সর্ব অমঙ্গল থেকে তার মঙ্গল আশীষ ঝরে পড়ুক। মনটা অবসন্ন, বিষণ্ন ক্লান্ত হয়ে পড়ছে কেন। আল্লাহ নিশ্চয়ই ভালো করবেন সব কিছু। ছোটনদের চিঠিও পাইনি।

অক্টোবর ২০ (বুধবার)
রাত ৯টা। কতদিন, কতদিন যে লেখাপড়া কিছুই করছি না শুধু আল্লাহর দিকে চেয়ে দিন কাটাচ্ছি, সে অনঙ্গ অন্তরঙ্গের কি খেয়াল আছে। কি করে কাটছে দিনরাত। তবু একটা সুখবর মন্টু খান ছাড়া পেয়েছে, শােকর আল্লাহর কাছে। আলতাফের খবর নেই, কারুর কোনাে খবর নেই, কেউই আসে না আমার এখানে। ভয়ে নয়, আমার জন্যেই আসে না। ওরা যে আমাকে ভালােবাসে সেইজন্য। আজ বিকালে ঝুনুর মাকে দেখতে গেলাম। তখন পাড়ায় মিলিটারী ঘুরছিল। মিলটনদের বাড়ী বৌমার বাড়ী জিজ্ঞাসাবাদ হয়েছে। আমি বাড়ী ছিলাম না, কেউ যে আসেনি ভালাে হয়েছে। কেউইত ছিলাম না। এসে কি করত কে জানে।

অক্টোবর ২১ (বৃহস্পতিবার)
রমজান এল। গত পবিত্র পাবক বিদগ্ধ তাপস কোন সওগাত নিয়ে এবার এল। আগামী কাল রমজান। আজ চাঁদ রাত, কত খুশী কত হাসি আনন্দ আশা আকাঙ্ক্ষায় ভরা এই দিনটি আসত মুসলিমের ঘরে। আজ আকাশ ঘন মেঘাচ্ছন্ন, বিদ্যুৎ বজ্র গর্জনে ভয়াল রূপ বাংলা থমথমে আবহাওয়ায় ভর্তি। একটু আনন্দ উল্লাস হাসি খুশীর সুর শোনা গেল না। ঘরে ঘরে চাঁদ দেখে আদাব সালাম মোবারকবাদের আওয়াজ পাওয়া গেল। আল্লাহ যেন সব শেষ ভালো দিয়ে করেন। দুলুদের ফোন পেলাম। এইটুকু খুশী। বিব্বু মাইনুর খবরও পেলাম।

অক্টোবর ২৩ (শনিবার)
এতদিনে আজ হাফিজটা দেখলাম। এলও। গলা জড়িয়ে ধরে কত আদর যে করল। খসরু, চিঙ্কুর কোন খবর নেই। আলতু, ইকবাল এখনও বন্দী। আল্লাহ জানেন কি আছে ওদের ভাগ্যে। অল্লাহ যেন ভালাে করেন। ২টা রোজা চলে গেল। এ পুণ্য মাসের বরকতেও কি ভালাে হবে না? মঙ্গল আসবে না?

অক্টোবর ২৪ (রবিবার)
ফজরের নামাজ পড়ে শুয়ে কিছুতেই ঘুম এল না ৬টায় একটু তন্দ্রা এল। দেখলাম টুলুরা এসে রান্না ঘরে ঢুকছে, বল্লাম আমার তুগুর মুগুররা এসে গেলি। চুমু খেতে গেলাম, লুলুটা বললো আমাকে দেবেনা? আমিত আগেও একবার এসেছিলাম। টুটাকে আদর কর। টুটা গলা জড়িয়ে ধরে কত যে চুমু খেল। আল্লাহ ওদের যেন সবাইকে সুদ্ধ সহিসালামতে ফিরিয়ে দেন। আজ ডা. আলমকে নিয়ে হেনার মাকে দেখে এলাম। ভালাের দিকেই আছেন। আগামী রবিবার খুলনা যেতে চাইছেন। আল্লাহ সবাইকে ভালাে করুন। উনি এবারে বড় কাহিল হয়ে পড়েছেন। কাল ঘুমাতে পারেননি। আবার কাল অফিসে যাবেন।

অক্টোবর ২৬ (মঙ্গলবার)
রাত সাড়ে ৪টা। আড়াইটার সময় স্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙ্গে গেল। দেখলাম লালানি হঠাৎ এসেছে, এসেই আবার হাফিজের সাথে বেরিয়ে গেল। কতক্ষণ পর আবার এল। একটা পাটি পেতে শুয়ে শুয়ে আমাকে ডেকে বল্ল- আমি ভাত খাব ৭টার সময়, সাতটার সময় খাব, ঠিক এই কথা বলল। আমি ওকে আদর করে অনেক কথা বলার জন্য কোলে নিতে গেলাম, ঘুম ভেঙ্গে গেল। আর ঘুম আসে না। কি অদ্ভুত স্বপ্ন যে দেখছি কদিন ধরে। আল্লাহ যেন ওদের সহিসালামতে রাখেন। ৭ মাস পূর্ণ হল দেশের দুর্দিন চলছে। মা বাপের আপনজনদের কি দুর্ভোগ যাচ্ছে। আল্লাহ ভালো কর সবার।

অক্টোবর ২৭ (বুধবার)
আতোয়ার ফোন করে দুপুরে জানাল, রাত ৩টায় ওর একটি ছেলে হয়েছে। আল্লাহ মোবারক করুন, বেঁচে থাক, মানুষ হােক। আতোয়ারের সুমতি হােক। সংসার শান্তিময় হােক।

অক্টোবর ২৮ (বৃহস্পতিবার)
আজও সেহরী খেয়ে শুয়েছি। ৫টার পর একটু তন্দ্রা মতন হল, স্বপ্নে দেখলাম লুলু এসেছে, বেশ হাসিখুশী। বল্লাম, আয় আমার কাছে শাে, শুয়ে শুয়ে শুনি এতদিন কোথায় কি করে কাটালি, ওকে বুকে নিয়েই ঘুম ভেঙ্গে গেল। কি যে হয়েছে, কি স্বপ্ন দেখছি এ সব আল্লাহ জানেন। ভালাে থাকুক, ইজ্জতে থাকুক ওরা যে যেখানে আছে। সন্ধ্যায় পি. পি. আই. থেকে শামীম ফোন করে জানাল, বারি সাহেব ইন্তেকাল করেছেন। যুথীর কাছে ফোন করে জানলাম গতকাল এডিনবরায় বারি সাহেব ইন্তেকাল করেছেন, ছােট মেয়ে লিপির কাছে। ছেলে সুইজারল্যান্ডে আছে, বীথি লন্ডনে, যুথি ঢাকায় আছে। ঢাকায় তার দাফন হবে কি না যুথীও বলতে পারল না। আল্লাহ জান্নাত নসীব করুন। ৬ রোজার দিন মারা গেলেন।

অক্টোবর ২৯ (শুক্রবার)
ছােটনের চিঠি পেলাম। এরা সবাই আল্লাহর ফজলে ভালাে আছে। তবু ত খবরটুকু পেলাম। কত কত দীর্ঘ দিনে একটু খবর পাই। এও আল্লাহর কাছে শোকর। চারিদিকে গোলাগুলী বোম-এর শব্দ। প্লেন উড়ছে সারা দিন রাত।

অক্টোবর ৩০ (শনিবার)
আজও সেহরী খেয়ে নামাজ পড়ে শুয়েছি, ৫টার পর ঘুম এল। দেখলাম টুলুটা হাসতে হাসতে এসে বলছে, তুমি নাকি রোজ রোজ লুলুকেই স্বপ্নে দেখো, এইত আমি আজ এসেছি। বলবার সাথে সাথে দেখি ভীষণভাবে যুদ্ধ লেগেছে, বোমা ফাটছে। প্লেন থেকে বােম্বিং হচ্ছে, আগুন জ্বলছে। অনেক লােক জমা হয়েছে মণিদের বাড়ী, আমাদের বাড়ী ভর্তি। ঝুনুর মা খুব অসুস্থ আর কুটি তাকে নিয়ে এসেছে, বড় এক কেটলি ভরা চা বানানাে হয়েছে, কিন্তু অত লােকের কুলাবে কি? কুটি বল্ল আপার মেয়েদের চা বানাতে বলাে, টুলুর হাতে করে দিলে কুলিয়ে যাবে, ওরা বেশ বরকত করে সবাইকে খাইয়ে দেবে, ঘুম ভেঙ্গে গেল। আল্লাহ সবার ভালো করুক, ভালো হোক। কাল রাত থেকে টিপ টিপ বৃষ্টি, ঝড়ের লক্ষণ।

অক্টোবর ৩১ (রবিবার)
রাত ৮টা। আশ্চর্য কি যে অদ্ভুত সব সপ্ন দেখে চলেছি। আজ ভোর ৫টায় স্বপ্ন দেখছি, লুলু বলছে দ্যাখো মা কারা যেন এসেছে। দেখি অতীন রায়। ছেলে বুড়ো সবার দাদু যিনি ছিলেন ঐ লােক। মহারাজ এসে বলছেন দিদি, আপনাকে দেখতে একজন লােক যে এসে দাঁড়িয়ে আছেন, এর আগে ৩ বার এসে ফিরে গেছেন, আপনি খেতে বসেছিলেন। এখন খেতে যাচ্ছিলেন ত? আমি বল্লাম, না খাব পরে, কে এসেছেন দেখি, তারা কিছু বল্লেন না। কিন্তু দেখলাম স্বপ্নালু শিশুর মতো চোখে আমার দিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। একজন কালো কুচকুচে চাপ দাড়ি হাসিহাসি মুখ ছবিতে দেখেছিলাম কালাে একটা জামা হাটু পর্যন্ত ধুতি পরা রামকৃষ্ণ পরম হংস। কি আশ্চর্য উনি বল্লেন, না না, খেতে যাবে আমি একটু দেখতে এসেছি, দেখেই চলে যাচ্ছি, বলে তিনি যাচ্ছেন, কিন্তু পিছু ফিরে নয়, আমার দিকে চেয়ে চেয়েই পিছু হটে যাচ্ছেন, মিলিয়ে যাচ্ছেন যেন, নৌকায় করে যাবেন তাও আবার আমাদের শায়েস্তাবাদের বাড়ীর ভিতরের পুকুর কুল গাছের তলার ঘাট দিয়ে। আমি লুলু সাথে সাথে নৌকা পর্যন্ত এসে ওদের মিলিয়ে যাওয়া দেখলাম। কি স্বপ্ন এ? বাল্য কৈশাের যৌবনে স্বপ্ন দেখছি আমার প্রভু প্রিয় স্বপ্নের ধন মহানবীকে। আবার এ বৃদ্ধ বয়সে এ সব কাদের স্বপ্ন দেখছি। ঘুম ভেঙে গেল। ভোর হয়েছে তখন। আল্লাহ বাংলাদেশের দুর্যোগ রাতেরও অবসান করুন। সুপ্রভাত হোক।