হরতাল

রেলে ‘হরতাল’ ‘হরতাল’ একটা রব উঠেছে। সে খবর ইঞ্জিন, লাইন, ঘন্টা, সিগন্যাল এদের কাছেও পৌঁছে গেছে। তাই এরা একটা সভা ডাকল। মস্ত সভা। পূর্ণিমার দিন রাত দুটোয় অস্পষ্ট মেঘে ঢাকা চাঁদের আলোর নীচে সবাই জড়ো হল। হাঁপাতে হাঁপাতে বিশালবপু সভাপতি ইঞ্জিন মশাই এলেন। তাঁর লেট হয়ে গেছে। লম্বা চেহারার সিগন্যাল সাহেব এলেন হাত দুটো লট্‌পট্ করতে করতে। তিনি কখনো নীল চোখে, কখনো লাল চোখে তাকান। বন্দুক উচাঁনো সিপাইদের মত সারি বেঁধে এলেন লাইন ক্লিয়ার করা যন্ত্রের হাতলেরা। ঠকাঠক ঠকাঠক করতে করতে রোগা রোগা লাইন আর টেলিগ্রাফের খুঁটিরা মিছিল করে সভা ভরিয়ে দিল। ফাজলামি করতে করতে ইস্‌টিশানের ঘন্টা আর গার্ড সাহেবের লাল-সবুজ নিশানেরাও হাজির। সভা জমজমাট। সভাপতি শুরু করলেন:

“ভাই সব, তোমরা শুনেছ মানুষ মজুরেরা হরতাল করেছে। কিন্তু মানুষ মজুরেরা কি জানে যে তাদের চেয়েও বেশী কষ্ট করতে হয় আমাদের, এইসব ইঞ্জিন-লাইন-সিগন্যাল-ঘণ্টাদের? জানলে তারা আমাদের দাবিগুলিও কর্তাদের জানাতে ভুলত না। বন্ধুগণ, তোমরা জান আমার এই বিরাট গতরটার জন্য আমি একটু বেশী খাই, কিন্তু যুদ্ধের আগে যতটা কয়লা খেতে পেতুম এখন আর ততটা পাই না, অনেক কম পাই। অথচ অনেক বেশী মানুষ আর মাল আমাদের টানতে হচ্ছে যুদ্ধের পর থেকে। তাই বন্ধুগণ, আমরা এই ধর্মঘটে সাহায্য করব। আর কিছু না হোক, বছরের পর বছর একটানা খাটুনির হাত থেকে কয়েকদিনের জন্যে আমরা রেহাই পাব। সেইটাই আমাদের লাভ হবে। তাতে শরীর একটু ভাল হতে পারে।”

প্রস্তাব সমর্থন করে ইঞ্জিনের চাকারা, বলল: ধর্মঘট হলে আমরা এক-পাও নড়ছি না, দাঁতে দাঁত দিয়ে পড়ে থাকব সকলে।

সিগন্যাল সাহেব বলল: মানুষ-মজুর আর আমাদের বড় বাবু ইঞ্জিন মশাইরা তাও কিছু খেতে পান।আমরা কিছুই পাই না, আমরা খাঁটি মজুর। হরতাল হলে আমরা আর রাস্তার পুলিশদের মত হাত ওঠান-নামান মানব না, চোখ বন্ধ করে হাত গুটিয়ে পড়ে থাকব।

লাইন ক্লিয়ার করা যন্ত্রের হাতল বলল: আমরাও হরতাল করব। হরতালের সময় হাজার ঠেলাঠেলিতেও আমরা নড়ছি না। দেখি কি করে লাইন ক্লিয়ার হয়।

লাইনেরা বলল: ঠিক্‌ ঠিক্‌, আমরাও নট নড়ন-চড়ন, দাদা।

ইস্‌টিশানের ঘন্টা বলল: সে সময় আমায় খুঁজেই পাবে না কেউ। ড্যাং ড্যাং করে ঘুরে বেড়াব। লাল-সবুজ নিশান বন্ধুরাও আমার সঙ্গে সঙ্গে থাকবে। ট্রেন ছাড়বে কি করে?

সভাপতি ইঞ্জিন মশাই বললেন: আমাকে বড়বাবু ইঞ্জিন মশাই বলে আর সম্মান করতে হবে না। আমি তোমাদের, বিশেষ করে আমার অধীনস্থ কর্মচারী চাকাদের কথা শুনে এতই উৎসাহিত হয়েছি যে, আমি ঠিক করেছি অনশন ধর্মঘট করব। এক টুকরো কয়লাও আমি খাব না, তাহলেই সবকিছু অচল হয়ে পড়বে।

এদিকে কতগুলো ইস্‌টিশানের ঘড়ি আর বাঁশি এসেছিল কর্তাদের দালাল হয়ে সভা ভাঙবার জন্যে। সভার কাজ ঠিক মত দেখে বাঁশিগুলো টিক্‌ টিক্ করে টিট্‌কিরী মেরে হট্টগোল করতে লাগল। অমনি সবাই হৈ-হৈ করে তেড়ে মেরে মারতে গেল ঘড়ি আর বাঁশিদের। ঘড়িরা আর কী করে, প্রাণের ভয়ে তাড়াতাড়ি ছ’টা বাজিয়ে দিল। অমনি সূর্য উঠে পড়ল। দিন হতেই সকলে ছুটে চলে গেল যে যার জায়গায়। সভা আর সেদিন হল না।