লেজের কাহিনী

একটি মাছি একজন মানুষের কাছে উড়ে এসে বলল: তুমি সব জানোয়ারের মুরুব্বি, তুমি সব কিছুই করতে পার, কাজেই আমাকে একটি লেজ করে দাও।

মানুষটি বলল: কি দরকার তোমার লেজের?

মাছিটি বলল: আমি কী জন্যে লেজ চাইছি? যে জন্যে সব জানোয়ারের লেজ আছে- সুন্দর হবার জন্যে।

মানুষটি তখন বলল: আমি তো কোন প্রাণীকেই জানি না যার শুধু সুন্দর হবার জন্যেই লেজ আছে। তোমার লেজ না হলেও চলবে।

এই কথা শুনে মাছিটি ভীষণ ক্ষেপে গেল আর সে লোকটিকে জব্দ করতে আরম্ভ করে দিল। প্রথমে সে বসল তার আচারের বোতলের ওপরে, তারপর নাকে সুড়সুড়ি দিল, তারপর এ-কানে ও-কানে ভন্‌ভন্ করতে লাগল। শেষকালে লোকটি বাধ্য হয়ে তাকে বলল: বেশ, তুমি উড়ে উড়ে বনে, নদীতে, মাঠে যাও, যদি তুমি কোনো জন্তু, পাখি কিংবা সরীসৃপ দেখতে পাও যার কেবল সুন্দর হবার জন্যেই লেজ আছে, তার লেজটা তুমি নিতে পারো। আমি তোমায় পুরো অনুমতি দিচ্ছি।

এই কথা শুনে মাছিটি আহলাদে আটখানা হয়ে জানলা দিয়ে সোজা উড়ে চলে গেল।

বাগান দিয়ে যেতে যেতে সে দেখতে পেল একটা গুটিপোকা পাতার ওপর হামাগুড়ি দিচ্ছে। সে তখন গুটিপোকার কাছে উড়ে এসে চেঁচিয়ে বলল: গুটিপোকা! তুমি তোমার লেজটা আমাকে দাও, ওটা তো কেবল তোমার সুন্দর হবার জন্যে।

গুটিপোকা বলল: বটে? বটে? আমার মোটে লেজই হয়নি, এটা তো আমার পেট। আমি এটাকে টেনে ছোট করি,
এইভাবে আমি হচ্ছি, যাকে বলে, বুকে-হাঁটা প্রাণী।

মাছি দেখল তার ভুল হয়েছে, তাই সে দূরে উড়ে গেল।

তারপর সে নদীর কাছে এল। নদীর মধ্যে ছিল একটা মাছ আর একটা চিংড়ি। মাছি মাছটাকে বলল। তোমার লেজটা আমায় দাও, ওটা তো কেবল তোমার সুন্দর হবার জন্যে আছে।

মাছ বলল: এটা কেবল সুন্দর হবার জন্যে আছে তা নয়, এটা আমার দাড়। তুমি দেখ, যদি আমি ডান-দিকে বেঁকতে চাই, তা হলে লেজটা আমি বাঁ-দিকে বেঁকাই, আর বাঁ-দিকে চাইলে ডান দিকে বেঁকাই; আমি কিছুতেই আমার লেজটি তোমায় দিতে পারি না।

মাছি তখন চিংড়িকে বলল: তোমার লেজটা তাহলে আমাকে দাও, চিংড়ি।

চিংড়ি জবাব দিল: তা আমি পারব না। দেখ না, আমার পা গুলো চলার পক্ষে কি রকম সরু আর দুর্বল, কিন্তু আমার লেজটি চওড়া আর শক্ত। যখন আমি জলের মধ্যে এটা নাড়ি, তখন এ আমায় ঠেলে নিয়ে চলে। নাড়ি-চাড়ি, নাড়ি-চাড়ি- আর যেখানে খুশি সাঁতার কেটে বেড়াই। আমার লেজও দাঁতের মতো কাজ করে।

মাছি আরো দূরে উড়ে গেল।

ঝোপের মধ্যে মাছি একটা হরিণকে তার বাচ্চার সঙ্গে দেখতে পেল। হরিণটির ছোট্ট একটি লেজ ছিল- ক্ষুদে নরম, সাদা লেজ।

অমনি মাছি ভন্‌ভন্ করতে আরম্ভ করল: তোমার ছোট্ট লেজটি দাও না, হরিণ!

হরিণ ভয় পেয়ে গেল।
হরিণ বললে: কেন ভাই? কেন? যদি তোমায় আমি লেজটা দিই, তাহলে আমি যে আমার বাচ্চাদের হারাব।
অবাক হয়ে মাছি বললে: তোমার লেজ তাদের কী কাজে লাগবে?
হরিণ বললে: বাঃ, কী প্রশ্নই না তুমি করলে! ধর, যখন একটা নেকড়ে আমাদের তাড়া করে- তখন আমি বনের মধ্যে ছুটে গিয়ে লুকোই আর ছানারা আমার পিছু নেয়। কেবল তারাই আমায় গাছের মধ্যে দেখতে পায়, কেন না আমি আমার ছোট্ট সাদা লেজটা রুমালের মত নাড়ি, যেন বলি: এই দিকে, বাছারা, এই দিকে। তারা তাদের সামনে সাদা মত একটা কিছু নড়তে দেখে আমার পিছু নেয়। আর এইভাবে আমরা নেকড়ের হাত থেকে পালিয়ে বাঁচি।

নিরুপায় হয়ে মাছি উড়ে গেল।

সে উড়তে লাগল- যতক্ষণ না সে একটা বনের মধ্যে গাছের ডালে একটা কাঠঠোক্‌রা দেখতে পেল।

তাকে দেখে মাছি বলল: কাঠঠোক্‌রা তোমার লেজটা আমায় দাও। এটা তো তোমার শুধু সুন্দর হবার জন্যে।

কাঠঠোক্‌রা বললে: কী মাথা-মোটা তুমি! তাহলে কী ক’রে আমি কাঠঠুক্‌রে খাবার পাব? কী ক’রে বাসা তৈরী করব বাচ্চাদের জন্যে?

মাছি বলল: কিন্তু তুমি তো তা তোমার ঠোঁট দিয়েই করতে পার!

কাঠঠোক্‌রা জবাব দিল: ঠোঁট কেবল ঠোঁটই। কিন্তু লেজ ছাড়া আমি কিছুই করতে পারি না। তুমি দেখ আমি কী করে ঠোক্‌রাই।

কাঠঠোক্‌রা তার শক্ত লাজ দিয়ে গাছের ছাল আঁকড়ে ধরে গা দুলিয়ে এমন ঠোক্কর দিতে লাগল যে, তার থেকে ছালের চোকলা উড়তে লাগল।

মাছি এটা না মেনে পারল না যে, কাঠঠোক্‌রা যখন ঠোক্‌রায় তখন সে লেজের ওপর বসে। এটা ছাড়া সে কিছুই করতে পারে না। এটা তার ঠেক্‌নার কাজ করে।

মাছি আর কোথাও উড়ে গেল না। মাছি দেখতে পেল সব প্রাণীর লেজই কাজের জন্যে। বে-দরকারী লেজ কোথাও নেই- বনেও না, নদীতেও না। সে মনে মনে ভাবলো- বাড়ি ফিরে যাওয়া ছাড়া আর কিছুই করবার নেই। “আমি লোকটাকে সোজা করবই। যতক্ষণ না সে আমায় লেজ করে দেয় আমি তাকে কষ্ট দেব।”

মানুষটি জানলায় বসে বাগান দেখছিল। মাছি তার নাকে এসে বসল। লোকটি নাক ঝাড়া দিল, কিন্তু ততক্ষণে সে তার কপালে গিয়ে ব’সে পড়েছে। লোকটি কপাল নাড়ল- মাছি আবার তার নাকে।

লোকটি কাতর প্রার্থনা জানাল: আমায় ছেড়ে দাও, মাছি!

ভন্‌ভন করে মাছি বলল: কিছুতেই তোমাকে ছাড়ব না। কেন তুমি আমায় অকেজো লেজ আছে কি না দেখতে পাঠিয়ে বোকা বানিয়েছ। আমি সব প্রাণীকেই জিগ্‌গেস করেছি- তাদের সবার লেজই দরকারী।

লোকটি দেখল মাছি ছাড়বার পাত্র নয়- এমনই বদ এটা। একটু ভেবে সে বলল; মাছি, মাছি! দেখ, মাঠে গরু রয়েছে। তাকে জিগ্‌গেস করো তার লেজের কী দরকার।

মাছি জানলা দিয়ে উড়ে গিয়ে গরুর পিঠে বসে ভন্‌ভন্ করে জিগ্‌গেস করল: গরু, গরু! তোমার লেজ কিসের জন্যে? -তোমার লেজ কিসের জন্যে?

গরু একটি কথাও বলল না- একটি কথাও না। তারপর হঠাৎ সে তার লেজ দিয়ে নিজের পিঠে সপাৎ করে মারল- আর মাছি ছিটকে পড়ে গেল।

মাটিতে পড়ে মাছি শেষ নিঃশ্বাস বেরিয়ে গেল- পা দুটো উঁচু হয়ে রইল আকাশের দিকে।

লোকটি জানলা থেকে বলল: এ-ই ঠিক করেছে মাছির। মানুষকে কষ্ট দিও না, প্রাণীদেরও কষ্ট দিও না। তুমি আমাদের কেবল জ্বালিয়ে মেরেছ।

[সোভিয়েট শিশু সাহিত্যিক ভি বিয়াঙ্কির “টেইলস” গল্পের অনুবাদ।]