ভদ্রলোক

“শিয়ালদা-জোড়া-মন্দির-শিয়ালদা” তীব্র কণ্ঠে বার কয়েক চিৎকার করেই সুরেন ঘন্টি দিন ‘ঠন্ ঠন্’ করে। বাইরে এবং ভেতরে, ঝুলন্ত এবং অনন্ত যাত্রী নিয়ে বাসখানা সুরেনের ‘যা-ওঃ, ঠিক হ্যায়’ চিৎকার শুনেই অনিচ্ছুক ও অসুস্থা নারীর মতো গোঙাতে গোঙাতে অগ্রসর হল। একটানা অস্বস্তিকর আওয়াজ ছড়াতে লাগল উঁ-উঁ-উঁ-উঁ-উঁ।

“টিকিট, বাবু, টিকিট আপনাদের” -অপরূপ কৌশলের সঙ্গে সেই নিশ্ছিদ্র ভিড়ের মধ্যে দিয়ে সুরেন প্রত্যেকের পয়সা আদায় করে বেড়াতে লাগল। আগে ভিড় তার পছন্দ হ’ত না, পছন্দ হ’ত না অনর্থক খিটির- মিটির আর গালাগালি। কিন্তু ড্রাইভারের ক্রমাগত প্ররোচনায় আর কমিশনের লোভে আজকাল সে ভিড় বাড়াতে ‘লেট’- এরও পরোয়া করে না। কেমন যেন নেশা লেগে গেছে তার: পয়সা-আরো পয়সা; একটি লোককে, একটি মালকেও সে ছাড়বে না বিনা পয়সায়।

অথচ দু’মাস আগেও সুরেন ছিল সামান্য লেখাপড়া-জানা ভদ্রলোকের ছেলে। দু’মাসে সে বদলে গেছে। খাকির জামার নীচে ঢাকা পড়ে গেছে ভদ্রলোকের চেহারাটা। বাংলার বদলে হিন্দী বুলিতে হয়েছে অভ্যস্ত। হাতের রিস্টওয়াচটাকে তবুও সে ভদ্রলোকের নিদর্শন হিসাবে মনে করে; তাই ওটা নিয়ে তার একটু গর্বই আছে। যদিও কনডাক্টারী তার সয়ে গেছে, তবুও সে নিজেকে মজুর বলে ভাবতে পারে না। ঘামে ভেজা খাকির জামাটার মতোই অস্বস্তিকর ঐ ‘মজুর’ শব্দটা।

-এই কনডাকটার, বাঁধো। একটা অতিব্যস্ত প্যাসেঞ্জার উঠে দাঁড়াল। তবুও সুরেন নির্বিকার। বাস ‘স্টপেজ’ ছাড়িয়ে চলে যাচ্ছে। লোকটা খাপ্পা হয়ে উঠল: কী শুনতে পাওনা না কি তুমি?

সুরেনও চোখ পাকিয়ে বলল: আপনি ‘তুমি’ বলছেন কাকে?

-তুমি বলব না তো কি ‘হুজুর’ বলব? লোকটা রাগে গজগজ করতে করতে রাস্তায় লাফিয়ে পড়ল। প্যাসেঞ্জারদেরও কেউ কেউ মন্তব্য করল: কনডাক্টাররাও আজকাল ভদ্দরলোক হয়েছে, কালে কালে কতই হবে।

একটি পান-খেকো লুঙ্গিপরা লোক, বোধহয় পকেটমার, হেসে কথাটা সমর্থন করল। বলল: মার না খেলে ঠিক থাকে না শালারা, শালাদের দেমাক হয়েছে আজকাল।

আগুন জ্বলে উঠল সুরেনের চোখে। নাঃ, একদিন নির্ঘাৎ মারামারি হবে। … একটা প্যাসেঞ্জার নেমে গেল। ধাঁই-ধাঁই বাসের গায়ে দু’তিনটে চাপড় মেরে চেঁচিয়ে উঠল সুরেন: যা-ওঃ। রাগে গরগর করতে করতে সুরেন ভাবল: এমন আর অপরাধ করেছিল সে। ভাড়াটেদের মেয়ে গৌরীর সঙ্গে প্রেম করা কি গো-মাংস খাওয়ার মতো অপরাধ? উনিশ বছর বয়েসে থার্ডক্লাশে উঠে প্রেম করে না কোন মহাপুরুষ।

-এই শালা শুয়ার কি বাচ্চা, ড্রাইভারের সঙ্গে সুরেনও চেঁচিয়ে উঠল। একটুকুর জন্যে চাপা পড়ার হাত থেকে বেঁচে গেল লোকটা। আমার ঘন্টি দিয়ে সুরেন চেঁচিয়ে উঠল: যা-ওঃ, ঠিক হ্যায়। লোকটার ভাগ্যের তারিফ করতে লাগল সমস্ত প্যাসেঞ্জার।

সুরেনকে কিছুতেই মদ খাওয়াতে পারল না রামচরণ ড্রাইভার। সুরেন বোধহয় এখনো আবার ভদ্রলোক হবার আশা রাখে। এখনো তার কাছে কুৎসিত মনে হয় রামচরণদের ইঙ্গিতগুলো। বিশেষ করে বীভৎস লাগে রাত্রিবেলার অনুরোধ। ওরা কত করে গুণ ব্যাখ্যা করে মদের: মাইরি মাল না টানলে কি দিনভোর এমন গাড়ি টানা যায়? তুই খেয়ে দেখ, দেখবি সারাদিন কত ফুর্তিতে কাজ করতে পারবি। তাই নয়? কি বল গো পাঁড়েজী?

পাঁড়েজী ড্রাইভার মাথা নেড়ে রামচরণের কথা সমর্থন করে। অনুরোধ ক’রে ক’রে নিস্ফল হয়ে শেষে রামচরণ রুখে উঠে ভেঙচি কেটে বলে: এঃ শালা আমার গুরু-ঠাকুর এয়েছেন।

সুরেন মৃদু হেসে সিগারেট বার কের।

যথারীতি সেদিনও “জোড়া-মন্দির- জোড়া-মন্দির” বলে হাঁকার পর গাড়ি ছেড়ে দিল। উঁ-উঁ-উঁ শব্দ করতে করতে একটা স্টপেজে এসে থামতেই সুরেন চেঁচিয়ে উঠলঃ জলদি করুন বাবু, জলদি করুন। এক ভদ্রলোক উঠলেন স্ত্রী- ছেলে-মেয়ে ইত্যাদি নিয়ে। সুরেন-অভ্যাস মতো “লেডিস সিট ছেড়ে দিন আপনারা” বলেই আগন্তুকদের দিকে ছেয়ে চমকে উঠল- একি, এরা যে তার মামার বাড়ির ভাড়াটেরা। গৌরীও রয়েছে এদের সঙ্গে। সুরেনের বুকের ভিতরটা ধ্বক্ ধ্বক্ কাঁপতে লাগল বাসের ইঞ্জিনটার মতো। ভাড়াটেবাবু সুরেনকে এক নজর দেখে নিলেন। তাঁর বাচ্চা ছেলেমেয়ে দুটো হৈ-হৈ বাঁধিয়ে দিল: মা, মা, আমাদের সুরেন-দা। ঐ দ্যাখো সুরেন-দা। কী মজা! সুরেন-দা, বাড়িতে যাওনা কেন? এ্যাঁ?

গাড়ি শুদ্ধ লোকের সামনে সুরেন বিব্রত হয়ে পড়ল। কিছুক্ষণ টিকিট দিতেই মনে রইল না তার। ভদ্রলোক ধমকে নিরস্ত করলেন তাঁর ছেলেমেয়েদের। কেমন যেন গোলমাল হয়ে গেল সবকিছুই- বন্ধ হয়ে গেল সুরেনের হাঁক ডাক। একবার আড়চোখে তাকাল সে গৌরীর দিকে- সে তখন রাস্তার দিকে মুখ ফিরিয়ে বসে আছে। আস্তে আস্তে সে বাকী টিকিটের দামগুলো সংগ্রহ করতে লাগল। বাসের একটানা উঁ-উঁ-উঁ শব্দকে এই প্রথম তার নিজের বুকের আর্তনাদ বলে মনে হল। কনডাক্টারীর দুঃসহ গ্লানি ঘাম হয়ে ফুটে বেরুল তা কপালে।

গৌরীর বিমুখ ভাব সুরেনের শিরায় শিরায় বইয়ে দিল তুষারের ঝড়; দ্রুত, অত্যন্ত দ্রুত মনে হল বাসের ঝাঁকুনি-দেওয়া গতি। বহুদিনের রক্ত-জল-করা পরিশ্রম আর আশা চূড়ান্ত বিন্দুতে এসে কাঁপতে লাগল স্পিডোমিটারের মতো। একটু চাহনি, একটু পলক ফেলা আশ্বাস, এরই জন্যে সে কাঁধে তুলে নিয়েছিল কন্ডাক্টারের ব্যাগ। কিন্তু আজ মনে হল বাসের সবাই তার দিকে চেয়ে আছে, সবাই মৃদু হাসছে, এমন কি গৌরীর বাবাও। ছুঁড়ে ফেলে দিতে ইচ্ছা হল সুরেনের টাকাকড়ি- শুদ্ধ কাঁধে ঝোলান ব্যাগটা।

ওরা নেমে যেতেই দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে ঘন্টি মেরে দুর্বল স্বরে হাঁকল: যা-ওঃ। কিন্তু ‘ঠিক হ্যায়’ সে বলতে না। কেবল বার বার তার মনে হতে লাগল: নেহি ঠিক নেহি হ্যায়।

সেদিন রাত্রে সুরেন মদ খেল, প্রচুর মদ। তারপর রামচরণকে অনুসরণ করল। যাত্রীদের গন্তব্যস্থলে পৌঁছে দেওয়াই রামচরণের কাজ। সে আজ সুরেনকে পৌঁছে দিল সৌখিন ভদ্রসমাজ থেকে ঘা-খাওয়া ছোটলোকের সমাজে।

(‘ভদ্রলোক’ গল্পটিও অরণিতে ১৪ই ফেব্রুয়ারী ১৯৪৪ সালে প্রকাশিত হয়েছে।)