ডিটেকটিভ

জলধরের মামা পুলিশের চাকরি করেন, আর তার পিশেমশাই লেখেন ডিটেকটিভ উপন্যাস। সেইজন্য জলধরের বিশ্বাস যে, চোর-ডাকাত জাল-জুয়াচোর জব্দ করবার সব রকম সঙ্কেত সে যেমন জানে এমনি তার মামা আর পিশেমশাই ছাড়া কেউ জানে না। কারও বাড়িতে চুরি-টুরি হলে জলধর সকলের আগে সেখানে হাজির হয়। আর, কে চুরি করল, কি করে চুরি হল, সে থাকলে এমন অবস্থায় কি করত, এ-সব বিষয়ে খুব বিজ্ঞের মত কথা বলতে থাকে। যোগেশবাবুর বাড়িতে যখন বাসন চুরি হল, তখন জলধর তাদের বললে, “আপনারা একটু সবধান হতে জানেন না, চুরি তো হবেই। দেখুন তো ভাঁড়ার ঘরের পাশেই অন্ধকার গলি। তার উপর জানালার গরাদ নেই। একটু সেয়ানা লোক হলে এখান দিয়ে বাসন নিয়ে পালাতে কতক্ষণ? আমাদের বাড়িতে ওসব হবার জো নেই। আমি রামদিনকে ব’লে রেখেছি, জানলার গায়ে এমনভাবে বাসনগুলো ঠেকিয়ে রাখবে যে জানালা খুলতে গেলেই বাসনপত্র সব ঝন্‌‌ঝন্‌‌ করে মাটিতে পড়বে। চোর জব্দ করতে ও-সব কায়দা জানতে হয়।” সে সময়ে আমরা সকলেই জলধরের বুদ্ধির খুব প্রশংসা করেছিলাম, কিন্তু পরের দিন যখন শুনলাম সেই রাত্রে জলধরের বাড়িতে মস্ত চুরি হয়ে গেছে, তখন মনে হল, আগের দিন অতটা প্রশংসা করা উচিত হয়নি। জলধর কিন্তু তাতেও কিছুমাত্র দমেনি। বলল, “ঐ আহাম্মক রামদিনটার বোকামিতে সব মাটি হয়ে গেল। যাক্‌‌, আমার জিনিস চুরি করে তাকে আর হজম করতে হবে না। দিন দুচার যেতে দাও না।”

দু মাস গেল, চার মাস গেল, চোর কিন্তু ধরাই পড়ল না। চোরের উপদ্রবের কথা আমরা সবাই ভুলে গেছি, এমন সময় হঠাৎ‌ আমাদের ইস্কুলে আবার চুরির হাঙ্গামা শুরু হল। ছেলেরা অনেকে টিফিন নিয়ে আসে, তা থেকে খাবার চুরি যেতে লাগল। প্রথম দিন রামপদর খাবার চুরি যায়। সে বেঞ্চির উপর খানিকটা রাবড়ি আর লুচি রেখে হাত ধুয়ে আসতে গেছে- এর মধ্যে কে এসে লুচিটুচি বেমালুম খেয়ে গিয়েছে। তারপর ক্রমে ক্রমে আরো দু-চারটি ছেলের খাবার চুরি হল। তখন আমরা জলধরকে বললাম, “কি হে ডিটেকটিভ! এই বেলা যে তোমার চোর-ধরা বুদ্ধি খোলে না, তার মানেটা কি বল দেখি?” জলধার বলল, “আমি কি আর বুদ্ধি খাটাচ্ছি না? সবুর কর না।” তখন সে খুব সাবধানে আমাদের কানে কানে এ কথা জানিয়ে দিল যে, ইস্কুলের যে নতুন ছোকরা বেয়ারা এসেছে তাকেই সে চোর বলে সন্দেহ করে। কারণ, সে আসবার পর থেকে চুরি আরম্ভ হয়েছে। আমরা সবাই সেদিন থেকে তার উপর চোখ রাখতে শুরু করলাম। কিন্তু দুদিন না যেতেই আবার চুরি! পাগলা দাশু বেচারা বাড়ি থেকে মাংসের চপ এনে টিফিন ঘরের বেঞ্চের তলায় লুকিয়ে রেখেছিল, কে এসে তার আধখানা খেয়ে বাকিটুকু ধুলোয় ফেলে নষ্ট করে দিয়েছে। পাগলা তখন রাগের চোটে চীৎ‌কার করে গাল দিয়ে ইস্কুল বাড়ি মাথায় করে তুলল। আমরা সবাই বললাম, “আরে চুপ্‌‌ চুপ্‌‌, অত চেঁচাসনে। তা হলে চোর ধরা পড়বে কি করে?” কিন্তু পাগলা কি সে-কথা শোনে? তখন তাকে জলধর বুঝিয়ে বলল, “আর দুদিন সবুর কর, ঐ নতুন ছোকরাটাকে আমি হাতে হাতে ধরিয়ে দিচ্ছি- এ সমস্ত ওর‌‌ই কারসাজি।” শুনে দাশু বলল, “তোমার যেমন বুদ্ধি! ওরা হল পশ্চিমা ব্রাহ্মণ, ওরা আবার মাংস খায় নাকি? দারোয়ানজীকে জিগ্‌‌গেস কর তো?” সত্যি‌‌ই আমাদের তো সে খেয়াল হয়নি! ছোকরা তো কতদিন রুটি পাকিয়ে খায়, ক‌‌ই একদিনও তো ওকে মাছ-মাংস খেতে দেখি না। দাশু পাগলা হোক আর যাই হোক, তার কথাটা সবাইকে মানতে হল। জলধার কিন্তু অপ্রস্তুত হবার ছেলেই নয়। সে এক গাল হেসে বলল, আমি ইচ্ছে করে তোদের ভুল বুঝিয়েছিলাম। আরে, চোরকে না ধরা পর্যন্ত কি কিছু বলতে আছে, কোনো পাকা ডিটেকটিভ ও-রকম করে না। আমি মনে মনে যাকে চোর বলে ধরেছি, সে আমি‌‌ই জানি।”

তারপর কদিন আমরা খুব হুঁশিয়ার ছিলাম, আট-দশদিন আর চুরি হয়নি। তখন জলধর বললে, “তোমরা গোলমাল করেই তো সব মাটি করলে। চোরটা টের পেয়ে গেল যে আমি তার পেছনে লেগেছি। আর কি সে চুরি করতে সাহস পায়? তবু ভাগ্যিস তোমাদের কাছে আসল নামটা ফাঁস করিনি।” কিন্তু সেই দিন‌‌ই আবার শোনা গেল, স্বয়ং হেডমাস্টার মশাইয়ের ঘর থেকে তার টিফিন খাবার চুরি হয়ে গেছে। আমরা বললাম, “ক‌‌ই হে? চোর না তোমার ভয়ে চুরি করতে পারছিল না? তার ভয় ঘুচে গেল দেখছি।”

তারপর দুদিন ধরে জলধরের মুখে আর হাসি দেখা গেল না। চোরের ভাবনা ভেবে ভেবে তার পড়াশুনা এম্নি ঘুলিয়ে গেল যে পণ্ডিত মহাশয়ের ক্লাশে সে আরেকটু হলেই মার খেত আর কি! দুদিন পর সে আমাদের সকলকে ডেকে একত্র করল, আর বলল, তার চোর ধরবার বন্দোবস্ত ঠিক হয়েছে। টিফিনের সময় সে একটা ঠোঙায় করে সরভাজা, লুচি আর আলুর দম রেখে চলে আসবে। তারপর কেউ যেন সেদিকে না যায়। ইস্কুলের বাইরে থেকে লুকিয়ে টিফিনের ঘরটা দেখা যায়। আমরা কয়েকজন বাড়ি যাবার ভান করে সেখানে থাকব। আর কয়েকজন থাকবে উঠোনের পশ্চিম কোণের ছোট ঘরটাতে। সুতরাং, চোর যেদিক থেকেই আসুক, টিফিন ঘরে ঢুকতে গেলেই তাকে দেখা যাবে।

সেদিন টিফিনের ছুটি পর্যন্ত কারও আর পড়ায় মন বসে না। সবাই ভাবছে কতক্ষণে ছুটি হবে, আর চোর কতক্ষণে ধরা পড়বে। চোর ধরা পড়লে তাকে নিয়ে কি করা যাবে, সে বিষয়েও কথাবার্তা হতে লাগল। মাস্টারমশাই বিরক্ত হয়ে ধমকাতে লাগলেন, পরেশ আর বিশ্বনাথকে বেঞ্চির উপর দাঁড়াতে হল- কিন্তু সময়টা যেন কাটতেই চায় না। টিফিনের ছুটি হতেই জলধর তার খাবারের ঠোঙাটা টিফিন-ঘরে রেখে এলো। জলধর, আমি আর দশ-বারোজন উঠোনের কোণের ঘরটাতে র‌‌ইলাম, আর একদল ছেলে বাইরে জিমনাস্টিকের ঘরে লুকিয়ে থাকল। জলধর বলল, “দেখ চোরটা যে রকম সেয়ানা দেখছি, আর তার যে রকম সাহস, তাকে মারধর করা ঠিক হবে না। লোকটা নিশ্চয় খুব ষণ্ডা হবে। আমি বলি, সে যদি এদিকে আসে তাহলে সবাই মিলে তার গায়ে কালি ছিটিয়ে দেব আর চেঁচিয়ে উঠব। তাহলে দারোয়ান-টারোয়ান সব ছুটে আসবে। আর, লোকটা পালাতে গেলেও ঐ কালির চিহ্ন দেখে ঠিক ধরা যাবে।” আমাদের রামপদ ব’লে উঠল, “কেন? সে যে খুব ষণ্ডা হবে তার মানে কি? সে কিছু রাক্ষসের মতো খায় বলে তো মনে হয় না। যা চুরি করে নিচ্ছে সে তো কোনোদিন‌‌ই খুব বেশি নয়।” জলধর বলল, “তুমিও যেমন পণ্ডিত। রাক্ষসের মতো খানিকটা খেলেই বুঝি ষণ্ডা হয়? তাহলে তো আমাদের শ্যামাদাসকেই সকলের চেয়ে ষণ্ডা বলতে হয়। সেদিন ঘোষেদের নেমন্তন্নে ওর খাওয়া দেখেছিলে তো! বাপু হে, আমি যা বলেছি তার উপর ফোড়ন দিতে যেও না। আর তোমার যদি নেহাৎ‌ বেশি সাহস থাকে, তুমি গিয়ে চোরের সঙ্গে লড়াই কর। আমরা কেউ তাতে আপত্তি করব না। আমি জানি, এ-সমস্ত নেহাৎ‌ যেমন-তেমন চোরের সাধ্য নয়। আমর খুব বিশ্বাস, যে লোকটা আমাদের বাড়িতে চুরি করেছিল- এ-সব তার‌‌ই কাণ্ড!”

এমন সময় হঠাৎ‌ টিফিন-ঘরের বাঁ দিকের জানলাটা খানিকটা ফাঁক হয়ে গেল, যেন কেউ ভিতর থেকে ঠেলছে। তার পরেই শাদা মতন কি একটা ঝুপ করে উঠোনের মধ্যে লাফিয়ে পড়ল। আমরা চেয়ে দেখলাম, একটা মোটা হুলো বেড়াল- তার মুখে জলধরের সরভাজা! তখন যদি জলধরের মুখখানা দেখতে, সে এক বিঘৎ‌ উঁচু হাঁ করে উঠোনের দিকে তাকিয়ে র‌‌ইল। আমরা জিগ্‌‌গেস করলাম, “কেমন হে ডিটেকটিভ! ঐ ষণ্ডা চোরটাই তো তোমার বাড়িতে চুরি করেছিল? তাহলে এখন ওকেই পুলিশে দি‌‌ই?”