কানা-খোঁড়া সংবাদ

পুরাতন কালে ছিল দুই রাজা,
নাম-ধাম নাহি জানা,
একজন তার খোঁড়া অতিশয়,
অপর ভূপতি কানা।
মন ছিল খোলা, অতি আলাভোলা,
ধরমেতে ছিল মতি,
পরধনে সদা ছিল দোঁহাকার
বিরাগ বিকট অতি!
প্রতাপের কিছু নাহি ছিল ত্রুটি,
মেজাজ রাজারই মতো,
শুনেছি কেবল বুদ্ধিটা নাকি
নাহি ছিল সরু তত।
ভাই ভাই মতো ছিল দুই রাজা,
না ছিল ঝগড়াঝাঁটি
হেনকালে আসি তিন হাত জমি
সকল করিল মাটি।
তিন হাত জমি হেন ছিল তাহা
কেহ নাহি জানে কার,
কহে খোঁড়া রায়, “এক চক্ষু যার
এ জমি হইবে তার।”
শুনি কানা রাজা ক্রোধ করি কয়,
“আরে অভাগার পুত্র!
এ জমি তোমারই দেখ-না এখনি,
খুলিয়া কাগজপত্র।”

নকশা রেখেছে একশো বছর
বাক্সে বাঁধিয়া আঁটি,
কীট কূটমতি কাটিয়া কাটিয়া
করিয়াছে তারে মাটি;
কাজেই তর্ক মিটিল হায়,
বিরোধ বাধিল ভারি,
হইল যুদ্ধ হদ্দ মতন
চৌদ্দ বছর ধরি।
মরিল সৈন্য,ভাঙিল অস্ত্র,
রক্ত চলিল বহি,
তিন হাত জমি তেমনি রহিল,
কারও হারজিৎ নাহি।

তবে খোঁড়া রাজা কহে, “হায়, হায়,
তর্ক বিষম বটে,
ঘোরতর রণে অতি অকারণে,
মরণ সবার ঘটে।”
বলিতে বলিতে চটাৎ করিয়া
হঠাৎ মাথায় তার
অদ্ভুত এক বুদ্ধি আসিল
অতীব চমৎকার।
কহিল তখন খোঁড়া মহারাজ,
“শুন মেরি কানা ভাই,
তুচ্ছ কারণে রক্ত ঢালিয়া,
কখনো সুযশ নাই।
তার চেয়ে জমি দান করে ফেল
আপদ শান্তি হবে।।”
কানা রাজা কহে, “খাসা কথা ভাই
কারে দিই কহ তবে।”
কহেন খঞ্জ, “আমার রাজ্যে
আছে তিন মহাবীর-
একটি পেটুক, অপর অলস
তৃতীয় কুস্তিগীর।
তোমার মুলুকে কে আছে এমন
এদের হারাতে পারে?-
সবার সমুখে তিন হাত জমি
বখসিস্‌ দিব তারে।”
কানা রাজা কহে, “ভীমের দোসর
আছে তো মল্ল মম,
ফলাহারে পটু পঁচাশি পেটুক
অলস কুম্‌ড়াসম।
দেখা যাবে কার বাহাদুরি বেশি
অসুক তোমার লোক;
কারে দিই কহ তবে।”
যে জিতিবে সেই পাবে এই জমি”-
খোঁড়া বলে, “তাই হােক।”

পড়িল নোটিস ময়দান মাঝে
আলিশান সভা হবে,
তামাশা দেখিতে চারিদিক হতে
ছুটিয়া আসিল সবে।
ভয়ানক ভিড়ে ভরে পথ ঘাট,
লোকে হল লোকাকার,
মহা কোলাহল, দাড়াবার ঠাঁই
কোনোখানে নাহি আর।

তার পর ক্রমে ‘রাজার হুকুমে
গোলমাল গেল থেমে,
দুই দিক হতে দুই পালােয়ান
আসরে আসিল নেমে।
লম্ফে ঝম্ফে যুঝিল মল্ল
গজকচ্ছপ হেন।
রুষিয়া মুষ্টি হানিল দোঁহায়-
বজ্র পড়িল যেন!
গুঁতাইল কত, ভোঁতাইল নাসা
উপাড়িল গোঁফদাড়ি,
যতেক দন্ত করিল অন্ত
ভীষণ চাপট মারি।

তার পরে দোঁহে দোঁহারে ধরিয়া
ছুড়িল এমনি জোরে,
গোলার মতন গেল গো উড়িয়া
দুই বীর বেগভরে।
কি হল তাদের কেহ নাহি জানে
নানা কথা কয় লোকে,
আজও কেহ তার পায় নি খবর
কেহই দেখে নি চোখে।

যাহোক এদিকে, কুস্তির শেষে
এল পেটুকের পালা,
যেন অতিকায় ফুটবল দুটি,
অথবা ঢাকাই জালা।
অজনেতে তারা কেহ নহে কম
ভোজনেতে ততোধিক,
বপু সুবিপুল, ভুড়ি বিভীষণ-
ভারী সাতমণ ঠিক।
অবাক দেখিছে সভার সকলে
অজিব কাণ্ড ভারি-
ধামা লুচি নিমিষে ফুরায়
দই ওঠে হাঁড়ি হাঁড়ি।
দাঁড়িপাল্লায় মাপিয়া সকলে
দেখে আহারের পরে,
দুজনেই ঠিক বেড়েছে ওজনে
সাড়ে তিনমণ করে।
কানা রাজা বলে, “এ কি হল জ্বালা,
আক্কেল নাহি কারও,
কেহ কি বোঝে না, সোজা কথা এই-
হয় জেতো, নয় হারো।”

তার পর এল কুঁড়ে দুইজন
ঝাঁকার উপরে চড়ে,
সভামঝে দোঁহে শুয়ে চিৎপাত
চুপচাপ রহে পড়ে।
হাত নাহি নাড়ে, চোখ নাহি মেলে,
কথা নাহি কারও মুখে,
দিন দুই তিন, রহিল পড়িয়া
নাসাগীত গাহি সুখে।
জঠরে যখন জ্বলিল আগুন
পরাণ কণ্ঠাগত,
তখন কেবল মেলিয়া আনন
থাকিল মড়ার মতো।
দয়া করে তবে সহৃদয় কেহ
নিকটে আসিয়া ছুটি,
মুখের নিকটে ধরিল তাদের
চাটিম কদলী দুটি।
খঞ্জের লোকে কহিল কটে,
“ছাড়িয়ে দে মা রে ভাই”,
কানার ভৃত্য রহিল হাঁ করে,
মুখে তার কথা নাই!
তখন সকলে কাষ্ঠ আনিয়া
তায় কেরোসিন ঢালি,
কুঁড়েদের গায়ে চাপাইয়া রোষে
দেশলাই দিল জ্বালি।
খোঁড়ার প্রজাডি “বাপ্‌রে!” বলিয়া
লাফ দিয়া তাড়াতাড়ি
কম্পিতপদে চম্পট দিল
একেবারে সভা ছাড়ি।
‘দুয়ো’ বলি সবে দেয় করতালি,
পিছু পিছু ডাকে ‘ফেউ,
কানার অলস বলে, “কি আপদ!
ঘুমুতে দিবি নে কেউ?
‘শুনে সবে বলে, “ধন্য ধন্য!
কুড়ে-কুল-চূড়ামণি!”
ছুটিয়া তাহারে বাহির করিল
আগুন হইতে টানি।
কানার লোকের গুণপনা দেখে
কানা রাজা খুশী ভারি,
জমি তো দিলই আরো দিল কত,
টাকাকড়ি, ঘরবাড়ি।