“এই দাখ টেঁপি, দ্যাখ কিরকম করে হাউই ছাড়তে হয়। বড় যে রাজুমামাকে ডাকতে চাচ্ছিলি? কেন, রাজুমামা না হলে বুঝি হাউই ছোটানো যায় না? এই দ্যাখ।”
দাদার বয়স প্রায় বছর দশেক হবে, টেঁপির বয়স মোটে আট, অন্য-অন্য ভাই-বোনেরা আরো ছোট। সুতরাং দাদার দাদাগিরির আর অন্ত নেই! দাদাকে হাউই ছাড়তে দেখে টেঁপির বেশ একটু ভয় হয়েছিল, পাছে দাদা হাউয়ের তেজে উড়ে যায়। কিন্তু দাদার ভরসা দেখে তারও একটু ভরসা হল।
দাদা হাউইটাকে হাতে নিয়ে, একটুখানি বেঁকিয়ে ধরে বিজ্ঞের মতো বলতে লাগল, “এই সলতের মতো দেখছিস, এইখানে আগুন ধরাতে হয়। সলতেটা জ্বলতে জ্বলতে যেই হাউই ভসভস করে ওঠে, অমনি, ঠিক সময়টি বুঝে- এই এমনি করে হাউইটিকে ছেড়ে দিতে হয়। এইখানেই হচ্ছে আসল বাহাদুরি। কাল দেখলি তো, প্রকাশটা কিরকম আনাড়ির মতো করছিল। হাউই জ্বলতে না জ্বলতে ফস করে ছেড়ে দিচ্ছিল। সেইজন্যই হাউইগলো আকাশের দিকে না উঠে নিচু হয়ে এদিক-সেদিক বেঁকে যাচ্ছিল।” ‘ এই বলে সবজান্তা দাদা একটি দেশলাইয়ের কাঠি ধরালেন। ভাইবোনেরা সব অবাক হয়ে হাঁ করে দেখতে লাগল। দেশলাইয়ের আগুনটি সলতের কাছে নিয়ে দাদা ঘাড় বেঁকিয়ে, মুচকি হেসে আর একবার টেঁপিদের দিকে তাকালেন। ভাবখানা এই যে, আমি থাকতে রাজুমামা-ফাজুমামার দরকার কি?
ফ্যাঁস-ফোঁস-ছররর! এত শিগ্গির যে হাউয়ের আগন ধরে যায় সেটা দাদার খেয়ালেই ছিল না, দাদা তখনো ঘাড় বেঁকিয়ে, হাসি-হাসি মুখ করে, নিজের বাহাদুরির কথা ভাবছেন। কিন্তু হাসিটি না ফুরোতেই হাউই যখন ফ্যাঁস করে উঠল, তখন সেই সঙ্গে দাদার মুখ থেকেও হাঁউমাউ গোছের একটা বিকট শব্দ আপনা থেকেই বেরিয়ে এল। আর তার পরেই দাদা যে একটা লম্ফ দিলেন, তার ফলে দেখা গেল যে ছাতের মাঝখানে চিৎপাত হয়ে অত্যন্ত আনাড়ির মতো তিনি হাত-পা ছুঁড়ছেন। কিন্তু তা দেখবার অবসর টেঁপিদের হয় নি। কারণ দাদার চিৎকার আর লম্ফভঙ্গির সঙ্গে সঙ্গে তারাও কান্নার সুর চড়িয়ে বাড়ির ভেতরদিকে রওনা হয়েছিল।
কান্নাটান্না থামলে পর রাজুমামা যখন দাদার কান ধরে তাকে ভেতরে নিয়ে এলেন, তখন দেখা গেল যে, দাদার হাতের কাছে ফোস্কা পড়ে গেছে আর গায়ের দু’তিন জায়গায় পোড়ার দাগ লেগেছে। কিন্তু তার জন্য দাদার তত দুঃখ নেই, তার আসল দুঃখ এই যে, টেঁপির কাছে তার বিদ্যেটা এমন অন্যায়ভাবে ফাঁস হয়ে গেল। রাজুমামা চলে যেতেই সে হাতে মলম মাখতে মাখতে বলতে লাগল, কোথাকার কোন দোকান থেকে হাউই কিনে এনেছে- ভালো করে মশলা মেশাতেও জানে না। বিষ্টু পাঠকের দোকান থেকে হাউই আনলেই হত। বারবার বলেছি- রাজুমামা হাউই চেনে না, তবু তাকেই দেবে হাউই কিনতে।” তারপর সে টেঁপিকে আর ভোলা ময়না আর খুক্নুকে, বেশ করে বুঝিয়ে দিল যে, সে যে চেঁচিয়েছিল আর লাফ দিয়েছিল সেটা ভয়ে নয়, হঠাৎ ফুর্তির চোটে।
সন্দেশ- ১৩২৯