দুই কবি: একটি কাল্পনিক সাক্ষাৎকার

গঙ্গাতীরে এক তীর্থক্ষেত্রে চৈত্র সংক্রান্তির পুণ্যস্নান
এসেছে অসংখ্য মানুষ, বলদর্পী রাজপুরুষ, বহু অকিঞ্চন
অনেক সৌভাগ্যবতী রমণী, তেমনই অনেক অভাগিনী
এসেছে বৃদ্ধ ও শিশুর দঙ্গল, প্রহরী ও পরস্ব-অপহারী
এবং দুই কবি।

একজন বহু খ্যাতিমান, সম্রান্ত ও মাল্যবান, সার্থকতা মাখা মুখ
এসেছেন পাল্কী-বেহারা ও সাঙ্গোপাঙ্গ, ঐশ্বর্যের বিচ্ছুরণ নিয়ে
মিথিলার রাজকবি ইনি, বিদ্যাপতি।
অন্য কবিটিকে কেউ চেনে না এখানে, অতি সাধারণ
পরিব্রাজী ব্রাহ্মণের মতো, অঙ্গে সেলাই-বিহীন বসন
মুণ্ডিত মস্তকে দীর্ঘ শিখা, ধূলি-ধূসরিত নগ্ন পা
ইনি বাশুলী-সেবক চণ্ডীদাস।

প্রথম অবগাহনের পর বক্ষ সমান জলে দাঁড়িয়ে
সূর্যবন্দনা করছেন বিদ্যাপতি।
চণ্ডীদাস জলে নামেন নি এখনো, অল্প দূরে, তীরে দাঁড়িয়ে
মুগ্ধ ভাবে দেখছেন, শুনছেন গভীর অভিনিবেশে
জলদগম্ভীর কণ্ঠস্বর, অতি নিখুঁত দেবভাষায় শ্লোক উচ্চারণ।

স্নান সেরে ওপরে এলেন বিদ্যাপতি, শিবিরের দিকে পা বাড়িয়ে
শীর্ণকায় ব্রাহ্মণের উৎসুক নয়ন দেখে থামলেন,
আজ তিনি কোনো প্রার্থীকেই ফেরাবেন না
হাঁক দিয়ে বললেন, ওরে, কে আছিস
এই ভিক্ষুটিকে দে কিছু তণ্ডুল ও স্বর্ণকণা!
চণ্ডীদাস ছুটে এসে নতজানু হয়ে বসলেন
বিদ্যাপতির পায়ের কাছে, আবেগবিহুল কণ্ঠে বললেন,
আপনি যে আমার প্রতি কৃপার দৃষ্টিতে চেয়েছেন
তাতেই ধন্য হয়েছি আমি, হে কবিকুল-তিলক
আমি শুধু দর্শন করতে এসেছি আপনাকে। এ অধমের নাম
দীন চণ্ডীদাস।

বিরক্তিসূচক ভুরু কপালে উঁচিয়ে বিদ্যাপতি
বললেন, সদ্য স্নান করে এসেছি আমি, তুমি অম্লত,
ব্রাহ্মণ, আমায় তুমি স্পর্শ করলে?
যেন বিদ্যাপতি তাঁকে পদাঘাত করবেন, এই ভেবে
দ্রুত সরে এলেন চণ্ডীদাস, হাত জোড় করে বললেন,
গঙ্গাতীরের বায়ুও পবিত্র, হে মান্যবর, এই বাতাসে
যে আচমন করেছে তার স্পর্শে কিছু অশুচি হয় কি?
এখানের ধারাবর্ষণও তো গঙ্গোদক, আমি সিক্ত ভোরের বৃষ্টিতে।
বিদ্যাপতি: তবু জেনে রেখো, শুচি বা অশুচি যাই হোক
পুরুষের স্পর্শে আমার প্রদাহ হয়, পুরুষেরা পরস্পর
দূরে থাকা ভালো।
চণ্ডীদাস: আমি অপরাধী; দর্শনই যথেষ্ট ছিল, পাদস্পর্শে
আমার অতি ব্যাকুলতা প্রকাশ পেয়েছে, ক্ষমা করুন।

দুই ভৃত্য দুই দিক থেকে মুছে দিতে লাগলো বিদ্যাপতির
গৌর তনু, তিনি ঊর্ধ্বমুখে চেয়ে রইলেন আকাশের দিকে
অকস্মাৎ দৃষ্টি নামিয়ে প্রশ্ন করলেন তিনি, কী নাম বললে হে,
চণ্ডীদাস? যেন চেনা চেনা
তুমি কিছু গীত রচেছো নাকি?
চণ্ডীদাস আপ্লুত স্বরে উত্তর দিলেন,
স্বয়ং রচনা করি এমন সাধ্য কি আমার!
দেবী বাশুলীর দয়া, কখনো আমাকে দিয়ে
কিছু কাব্যলহরীর প্রকাশ ঘটান!
বিদ্যাপতি: ‘গাইল বড়ু চণ্ডীদাস বাসলীগণ’, তুমি… মহাশয়,
আপনি কি সেই চণ্ডীদাস?
চণ্ডীদাস: আছেন অসংখ্য কবি, তার মধ্যে অতি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র এক
চণ্ডীদাস। আমি সে-ই বটে!

ভৃত্য দু’জনকে সরে যাবার ইঙ্গিত করলেন বিদ্যাপতি
তার প্রশস্ত ললাট হলো সীমাবদ্ধ
উন্নত মুখশ্রীতে পড়লো বিষাদের ছায়া
দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, এবারে বুঝেছি!
আমার স্মৃতি-বিভ্রম, ঊষাকাল থেকেই আমি রয়েছি বিষম অন্যমনা
সেই সুযোগে আপনি
বিদ্রূপের কশাঘাত হানতে এসেছেন আমাকে।
আপনি বঙ্গের শ্রেষ্ঠ কবি
আর আমি এক রাজভৃত্য মাত্র!
চণ্ডীদাস: এ কী কথা বলছেন, হে কবি-অগ্রগণ্য
আপনার খ্যাতি এ ভারতমণ্ডলে কে না জানে?
স্বয়ং মহারাজ শিব সিংহ আপনার কাব্যসুধার অনুরক্ত
এমনকি দিল্লির বাদশাহ পর্যন্ত দিয়েছেন জায়গির…
বিদ্যাপতি: অবশ্যই! রাজসভায় যত আছে বেতনভুক পাঠক
তারা উচ্চৈস্বরে গায় আমার অলংকারবহুল কাহিনী-গাথা
অভিজাতবৃন্দ তা শোনে, বুঝুক বা না বুঝুক আহা আহা করে
আর, আপনার গীত আস্বাদন করে
আপামর জনসাধারণ দূর দূরান্তরে
আমি জানি, বাতাস-বৃষ্টি ও রৌদ্রের মতন স্বতঃস্ফূর্ত
আপনার পদাবলী সমগ্র রাঢ়-বঙ্গে
অতি সাবলীল ভ্রমণ-স্বপনে যায়
আপনি ধন্য, আমি বন্দী!
চণ্ডীদাস: কাব্যকলার অধীশ্বর, আপনি, আমাদের গুরু
আপনার রসজ্ঞান ও শাস্ত্রজ্ঞান গঙ্গা-যমুনার
মতো মিলে মিশে আছে
আপনার শব্দ ঝংকার, চকিত রঙ্গিন উপমার ব্যবহার
আপনার নব রসের অতি নিপুণ সুষ্ঠু প্রয়োগ
এসব কোথায় পাবো আমি
আমি শিক্ষাহীন, দীন হীন অভাজন।
বিদ্যাপতি: অনেক জেনেছি, তাই আমি সারল্য ভুলেছি।
সুষ্ঠু নব-রস নয়, প্রথম রসেরই স্রোত বইয়ে দিয়েছি বেশি
কেননা নপুংসক রাজবর্গ শুধু ও রসেই তৃপ্তি পায়।
চণ্ডীদাস: আপনি অমর প্রেম-সঙ্গীতের উদগাতা
বিদ্যাপতি: আর আপনি, বিপ্র চণ্ডীদাস, প্রণয়ের সঙ্গে
অবাধে মেশাতে পেরেছেন উদাসীনতা
আপনি গান বেঁধেছেন কানু ও রাইকে নিয়ে
আমার কাব্যে ওরা রাধা-কৃষ্ণ, যেন অন্য মানুষ
আমার কৃষ্ণের সঙ্গে লালসাময় বয়স্ক রাজার আদল
আর আপনার কানু যে-কোনো রাখাল
চণ্ডীদাস: আপনি পেয়েছেন প্রতিষ্ঠা
বিদ্যাপতি: আপনি পেয়েছেন নাম-না-জানা অসংখ্য মানুষের ভালোবাসা
চণ্ডীদাস: কী যে বলেন, মহাকবি! আমি অভাজন
দুবেলা জোটে না অন্ন, হট্টমন্দিরে শুয়ে থাকি
যদি পেতাম আপনার মতন স্বাচ্ছন্দ্য, সুখের আশ্রয়
হয়তো আর একটু মন দিতে পারতুম কাব্য-সরস্বতীর
সাধনায়!
বিদ্যাপতি: আমার অন্ন ও বস্ত্র প্রয়োজনের অনেক বেশি, তাই
এসেছে অরুচি!
পার্থিব কিছুরই নেই অভাব, হায়, তবু
অপার্থিব কোনো চিন্তা মস্তিষ্কে আসে না!
চণ্ডীদাস: আপনি পেয়েছেন রাজমহিষী লছিমা দেবীর প্রশ্রয়
এমন সৌভাগ্য হয় কোন কবির?
বিদ্যাপতি: আমিও শুনেছি, রজকিনী রামতারা, নারী শ্রেষ্ঠা,
আপনার সাধনসঙ্গিনী
চণ্ডীদাস: সে যে অতি নগণ্যা
বিদ্যাপতি: তবু সে-ই জানে প্রণয়ের গূঢ় মর্ম, তাই আপনার কবিতার
প্রতিটি চরণে এত সুধা-সরোবর!
রাজমহিষীর আলিঙ্গন
আমাকে দিয়েছে শুধু সোনার শৃঙ্খল!
চণ্ডীদাস: কবি বিদ্যাপতি, আপনি মিছে আত্মগ্লানি করছেন
যে জীবন অনিশ্চিত, পদে পদে অন্নচিন্তা, প্রতিবেশীদের
অবহেলা
সে জীবন সুখের মোটেই নয়, বড় জ্বালা, পথে পথে
অনেক কণ্টক
অনেক সয়েছি আমি, আজ ক্লান্ত, পেতে ইচ্ছে হয়
কিছু স্বস্তি, কিছু আরামের দ্রব্য, কিছু উপভোগ।
বিদ্যাপতি: আমার তো ইচ্ছে হয় সর্বস্ব দিতে বিসর্জন!
এখনো সময় আছে…
চণ্ডীদাস: কী আশ্চর্য, আপনি স্বেচ্ছায় বরণ করতে চান দারিদ্র্য?
অথচ দরিদ্র আমি, মনে ছিল সুপ্ত অভিলাষ
আপনার সূত্র ধরে পাই যদি কোনো রাজ-অনুগ্রহকণা
একখানি নিজস্ব কুটির, কিছু শস্যভূমি

বিদ্যাপতি থমকে রইলেন ক্ষণকাল, বুঝি অশ্রুবাম্পে
রুদ্ধ হয়ে এসেছে তাঁর কণ্ঠ
পুনরায় মুখ তুলে বললেন, ভ্রাতঃ, তা হলে আসুন
এখুনি বদল করি আমাদের দুজনের জীবনের গতি
নিন সব মূল্যবান বস্ত্র, অলঙ্কার, দাসদাসী
ভিক্ষা দিন আপনার ছিন্ন উত্তরীয়
আসন গ্রহণ করুন আপনি রাজসভায়
আমি ভ্রাম্যমাণ হবো উন্মুক্ত প্রান্তরে
রানী লছিমার বক্ষ আপনার আশ্রয় হোক,
আমি যাবো রামী ধোপানীর কাছে, চাইবো তার দয়া
আপনি ভোগ করুন পলান্ন ও সোম
আমি উপভোগ করবো নুন-ভাত, ঝর্ণার পানীয়
শুরু হোক আমাদের বিপরীত নতুন জীবন…

তারপর দুই কবি আবেগ-ধাবিত হয়ে
এরকম ভাবে আলিঙ্গন করলেন পরস্পরকে যেন
দুজনের শরীর মিশে একটি শরীর হয়ে গেল।