আরামকেদারায় দু’ হাত ছড়িয়ে বসে আছেন খ্যাতিমান প্রৌঢ় কবি, তাঁর সুরেলা সংলাপ মুগ্ধ হয়ে শুনছে বন্ধুরা। দরজার কাছে এসে দাঁড়াল বাইশ বছরের একটি যুবক, পাতলা ছোটখাটো চেহারা, তবু ভারী রূপবান, মুখখানি কন্দর্পতুল্য।
ওয়ার্ডসওয়ার্থ ভুরু তুলে প্রশ্ন করলেন, এ কে?
গৃহস্বামী শিল্পী বেঞ্জামিন হেডন বললেন, উইলিয়াম, এই ছেলেটির নাম জন, জন কিটস, ডাক্তারি পড়া ছেড়ে কবিতা লিখছে, হাতটা বেশ ভালো, তোমার সঙ্গে পরিচিত হতে চায়, তাই এই পার্টিতে আসতে বলেছি।
ওয়ার্ডসওয়ার্থ এই নবাগতের এক লাইন রচনাও পড়েননি, নামটা শোনা-শোনা, সংযত সৌজন্যে বললেন, শুভ সন্ধ্যা, তোমাকে দেখে খুশি হলাম।
তিনি করমর্দনের জন্য বাড়িয়ে দিলেন ডান হাত, কিটস এগিয়ে এসেও দ্বিধান্বিত, শরীর কাঁপছে তার। ওই হাত, প্রিয় কবির হাত, ওই আঙুলে ধরা কলমে লেখা হয়েছে লুসি সিরিজের অনবদ্য গীতিকবিতাগুলি, ‘প্রস্তাবনা’র মতন কাব্য। ওই হাত স্পর্শ করার যোগ্য কি সে?
ওয়ার্ডসওয়ার্থ আর মনোযোগ না দিয়ে ফিরে গেলেন তাঁর অসমাপ্ত বাক্যে, হোমার, ভার্জিল, শেক্সপিয়ার, মিলটন থেকে উদ্ধৃতি দিতে লাগলেন অনবরত, তিনিই একমাত্র বক্তা, অন্য সকলে শ্রোতা। এক কোণে দাঁড়িয়ে রইল কিট্স, তার ঠোঁট অল্প অল্প নড়ছে, ওই কবিতাংশ সবই তার মুখস্থ। একদৃষ্টিতে দেখছে সে তার প্রিয় কবিকে, ওয়ার্ডসওয়ার্থের মাথার পেছনে দেয়ালে ঝুলছে হেডনের আঁকা যিশুখ্রিস্টের জেরুজালেমে প্রবেশ দৃশ্যমান বিশাল ছবিটি, পাশে ফায়ার প্লেসে রক্তিম আভা, জানলার বাইরে বেলাশেষের সূর্য ঢলে পড়েছে পশ্চিম আকাশে।
কিটসের মনে পড়ল, এই কবি সম্পর্কেই তাঁর বন্ধু কোলরিজ বলেছিলেন, ও মহান, অতিমানব। ওয়ার্ডসওয়ার্থই একমাত্র ব্যক্তি, যার কাছে সর্ব সময়ে, সর্ব বিষয়ে আমি নিজেকে ছোট মনে করি। …ইদানীং অবশ্য কিছু কিছু তরুণ আড়ালে বলাবলি করে, উনি কী সব লিখছেন আজকাল! আগেকার সেই অন্তর্দৃষ্টি হারিয়ে গেছে। কিট্স নিজে তা ভাবে না, কবির শ্রেষ্ঠ রচনাগুলিতেই সে আবিষ্ট হয়ে আছে। সেই কবি আজ সশরীরে এখানে উপস্থিত, তাঁর চক্ষুদুটি, ওই চক্ষে যেন দিব্যদর্শন হয়েছে।
ওয়ার্ডসওয়ার্থের বাণীপ্রবাহের মাঝখানে মূর্তিমান বিঘ্নের মতন প্রবেশ করলেন চার্লস ল্যাম। গেলাসে গেলাসে মদ ঢেলে সবার হাতে তুলে দিয়ে তিনি বললেন, কার স্বাস্থ্য পান করব? তারপর ওয়ার্ডসওয়ার্থের দিকে ফিরে ধিক্কারময় কণ্ঠে বললেন, ওহে হ্রদকবি, ওহে রাসকেল, তুমি কেন ভলতেয়ারকে স্থূল বলেছ?
কিট্স শিউরে উঠলেন। ওয়ার্ডসওয়ার্থ বন্ধুর কাঁধে চাপড় দিয়ে বললেন, মাঝে মাঝে স্থূল তো বটেই।
শুরু হয়ে গেল তর্ক, কেউ কেউ সমর্থন করলেন ওয়ার্ডসওয়ার্থকে। কিট্সের পছন্দ হল না। কবিতার ভাষা ব্যবহার নিয়ে কী অপূর্ব বলছিলেন ওয়ার্ডসওয়ার্থ, তার মধ্যে আবার গদ্যের অবতারণা কেন? ভলতেয়ার থেকে ফ্রান্স, ওয়ার্ডসওয়ার্থের একদা-ফ্রান্সভক্তি এখন বিরূপতা, ফ্রান্সে তাঁর অবৈধ সন্তান, পরিত্যক্ত প্রেমিকা অ্যানেত, ল্যাম আরও খোঁচা দিয়ে বললেন, প্রকৃতিমুগ্ধ ঋষিপ্রতিম কবিরও তা হলে অবৈধ সন্তান থাকে…
কিট্সের মন চলে গেল ফ্রান্স ছেড়ে গ্রিসে, প্রাচীন গ্রিস, বুদ্ধিদীপ্ত শিল্পের জন্মভূমি… তারপর সে শুনতে পেল একটা পাখির ডাক। এটা কোন পাখি?
বিষয় থেকে বিষয়ান্তর, ল্যাম এবার শিল্পীর দিকে মুখ ফিরিয়ে বললন, ওহে, তুমি তোমার ছবিতে নিউটনের মুখচ্ছবি বসিয়েছ কেন? ও লোকটা তো ত্রিভুজের তিনটি দিকের মতন সরল প্রমাণ না পেলে কিছুই বোঝে না। অঙ্ক, শুধু অঙ্ক, ও ধ্বংস করেছে আকাশের একটি পরমাশ্চর্য কবিতা।
কিট্স আপন মনে বলে উঠল, ঠিক!
সবাই তাকালেন এই তরুণ কবির দিকে।
কিট্সের চোখ জানলার বাইরে ঈগল পাখির ডানার মতন অন্ধকারে নিমগ্ন। আকাশ দেখা যায় না, তবু সে আকাশ দেখছে। খানিকটা ভাঙা ভাঙা, দুঃখমাখা গলায় বলল, বাল্যকাল থেকে আমরা রামধনু দেখে কত না বিস্ময়বোধ করেছি। কী দরকার ছিল সেই বিস্ময়বোধ ভেঙে দেবার…
ল্যাম তীব্র স্বরে বললেন, ওই বিশাল রামধনু নিছক ত্রিশিরা কাচের বর্ণচ্ছটা? জলকণার বিচ্ছুরণ? হাঃ!
কিট্স ওয়ার্ডসওয়ার্থের উদ্দেশে বলল, আবৃত্তি করেছি আপনারই কবিতা, ‘আমার হৃদয় উদ্বেলিত হয়ে ওঠে, যখন আমি দেখি, আকাশে এক রামধনু…’
ওয়ার্ডসওয়ার্থ হেসে উঠলেন খোলা গলায়। খুবই উপভোগ করছেন এমন স্বরে বললেন, বাঃ, চমৎকার। তা হলে নিউটনকে কী শাস্তি দেওয়া যায়?
হাতের সুরার গেলাসে এখনও চুমুক দেয়নি কিট্স। হাত উঁচু করে সেও সহাস্যে বলল, আসুন, আমরা নিউটনের স্বাস্থ্যপান করি, এবং গণিতের প্রতি বিভ্রান্তির।
বাইরে আবার একটা পাখি ডেকে উঠল। ওটা কোন পাখি?
শুধু পাখি নয়, আকাশও ডাকছে। আকাশে এখনই এক কবিতা-সন্ধ্যা শুরু হবে।