জল যেন লেলিহান আগুন

রাত্তিরে আড়িয়াল খাঁ-র গর্জনে হঠাৎ ছিঁড়ে যায় ঘুম
মেঘ ভাঙা শব্দের মতন কূল ভাঙছে
বিদ্যুৎ রেখাঙ্কনের মতন মাটির ফাটলে শোঁ শোঁ করে ঢুকছে বাতাস
বিছানা ছেড়ে জানলার ধারে ছুটে যেতেই মনে পড়ে
আমি তো রয়েছি একটা লম্বা অট্টালিকার টঙে

অনেক নীচে কালো রাস্তা, বন্ধ দোকানগুলোর সামনে
ঘেউ ঘেউ করছে কুকুর
এখানে কোথায় আড়িয়াল খাঁ, কোথায় পার ভাঙা
তবু ভাঙছে, মাটি ভাঙছে, এগিয়ে আসছে স্রোত
ছেলেবেলার শ্লোকটা আপন মনে বিড়বিড় করি,
নদী, তুমি নদীতেই থাকো, বাড়িতে এসো না!

মাদারিপুর থেকে নৌকায় যেতে যেতে দেখতুম আধ-ডোবা
কদমগাছের গুঁড়িতে জড়িয়ে আছে।
হলুদকালো জলঢোঁড়া সাপ
আমাদের উঠোন থৈ থৈ করছে, ভাসছে কচুরিপানা
ঠাকুমা চিৎকার করছেন, ওরে রান্নাঘর ড়ুবলো, ড়ুবলো
হাঁড়ি-পাতিলগুলো ধর
ঈষৎ খয়েরি রঙের সেই ছবিটি একটু একটু করে কাঁপছে
ঠাকুমার মুখখানা মনে পড়ছে না, কিন্তু শুনতে পাচ্ছি
জলের ঝাপটানি
এখনো আমার বয়েসী কোনো কিশোর দৌড়োচ্ছে
আড়িয়াল খাঁ-র বান থেকে বাঁচবার জন্য?
ড়ুবে যাচ্ছে অসংখ্য রান্নাঘর, তৈজসপত্রের সঙ্গে ওলটপালট খাচ্ছে
অন্য কার ঠাকুমার শরীর…
নদী, তুমি নদীতেই থাকো, বাড়িতে এসো না!

বিক্রমপুরের সেই পরিচ্ছন্ন সুন্দর গ্রাম, কলাকোপা বান্দরা
তার পাশে ইছামতী নদীটি বড় তীব্র
ভেসে আসছে বড় বড় গাছের ডালপালা আসামের জঙ্গল থেকে
ঘাটলায় বসে জলের সৌন্দর্য দেখি একদিন
পরেরদিনই সেই জল ভয়ংকর হয়ে লাফিয়ে ওঠে
মিলে যায় বুড়িগঙ্গার সঙ্গে শীতলাক্ষা, তার সঙ্গে মেঘনা
পিঁপড়ের বাসা ভেসে যায়, মানুষের শহরও কাঁপে টলমল করে
আকাশ ঢেলে দিচ্ছে দিগদিগন্তের সমস্ত ঝর্না
আঃ বৃষ্টি এত সুন্দর, এমন হিংস্র, এমন সর্বনাশা
মানুষকে তাড়া করছে জল, ঠিক যেন লেলিহান আগুন…
নদী, তুমি নদীতেই থাকো, বাড়িতে এসো না!

জোরহাট থেকে গোলাঘাট হয়ে নওগাঁর দিকে মানুষ ছুটছে
জলপাইগুড়ি, মালদা, দিনাজপুরে মানুষ ছুটছে
আত্রাই-পুনর্ভবা-তিস্তার এপারে ওপারে মানুষ ছুটছে
ধলেশ্বরী, ডাকাতিয়া, ভৈরব, ভদ্রার ভয়ে মানুষ ছুটছে
ওদিকে কম্পানিগঞ্জ, সোনাগাজি, এদিকে বংশীধারী, দেবীকোট থেকে
মানুষ ছুটছে
ভুরুঙ্গামারি আর লালমনির হাট একাকার হয়ে গেছে, মানুষ ছুটছে
ধেয়ে আসছে নদী অজগরের মতন নিঃশ্বাস ফেলে
আমি কলকাতার শানবাঁধানো রাস্তায় ঘুরছি, সব কিছু ঠিকঠাক,
শুধু রবিবারের চাঁদা আর
খবরের কাগজের ছবি
বার বার মনে আসছে ছেলেবেলার সেই ভয়-কাঁপা ঠোঁটে উচ্চারিত
শ্লোক:
নদী, তুমি নদীতেই থাকো, বাড়িতে এসো না!