নন্দনকাননে দ্রৌপদী

(একটি সংলাপ কাব্য)

[পদব্রজে হিমালয় অতিক্রম করে স্বর্গের সিংহদ্বারে এসে পৌঁছেছেন যুধিষ্ঠির। ধুলোমাখা শরীর, ললাটে অনেক দিনের ঘাম। একজন দেবদুত তাঁকে প্রত্যুদগমন করে নিয়ে আসছেন।]

যুধিষ্ঠির: এই স্বর্গ!
দেবদূত: ধর্মপুত্র, ঐ অদূরে আপনার ঈপ্সিত নগরী।
যুধিষ্ঠির: এই স্বর্গ?
দেবদূত: সহস্র বিদ্যুতে গড়া বৈদূর্য খচিত এই দ্বার
মেঘের ব্যজনে স্নিগ্ধ, কিছু দৃশ্য, খানিক অদৃশ্য
এই দ্বার পার হলে দেবসেব্য নন্দনকানন
এক পাশে শব্দহীন স্রোতস্বিনী মন্দাকিনী নদী
যুধিষ্ঠির: মায়া নয়, মতিভ্রম নয়? এই তবে স্বর্গভূমি?
দেবদূত: বিশ্বাস হচ্ছে না?
যুধিষ্ঠির: অবিশ্বাস নয়, তার চেয়ে আরও প্রগাঢ় বিস্ময়….
জানতাম কল্পনার সঙ্গে ঠিক মেলে না বাস্তব
জাগ্রত দেখার চেয়ে শ্রেষ্ঠতর স্বপ্নের নির্মাণ
কিন্তু স্বর্গ, সে যে সব বাস্তবের শেষতম রূপ
সে যে অসীমের চির স্থির এক সৌন্দর্য প্রতিমা
এই কি সে স্বর্গ, কেন মনে হচ্ছে সংক্ষিপ্ত, সীমিত
আমার স্বপ্নের স্বর্গ যেন অন্য, যেন আরও দূরে?
দেবদূত: হে পাণ্ডব কুলপতি, আপনার সন্দেহ সঠিক।
স্বপ্নে দেখা স্বর্গে কেউ কোনোদিনও পৌঁছোতে পারে না
অথচ তা দূরে নয়। প্রকৃত স্বর্গও কিন্তু নয়
সম্পূর্ণ বাস্তব। এই সিংহদ্বার, নন্দনকানন
প্রতিদিন রূপ বদলায়। রূপের ভিতরে আরও
অসংখ্য রূপক।
যুধিষ্ঠির: এই সেই ব্রিজগৎ সুবিদিত নন্দনকানন
প্রতিটি বৃক্ষ ও পুষ্প, লতাগুল্ম সম্পূর্ণ অচেনা
স্বপ্নেও দেখিনি আগে। দেবদূত, আমি জেগে আছি?
দেবদূত: অসম্ভব এই যাত্রা আপনিই সম্ভব করেছেন।
প্রথম মানুষ, এক শরীরী মানুষ, মনোবলে
সকল যুদ্ধের চেয়ে শ্রেষ্ঠ জয়ে মহান বিজয়ী
মৃত্যু অতিক্রম করে এসেছেন পার্থিব আকারে
এই স্বর্গে! ধন্য ধন্য হে কৌন্তেয়, ধন্য ধরা ধাম।
পারিজাত মাল্য নিয়ে অপেক্ষা করছেন দেবরাজ
সেই মাল্য স্পর্শে আপনার সর্ব ক্লান্তি দূর হবে

[দ্বারের কাছে দেখা গেল একজন সুপুরুষকে। তাঁর চোখে-মুখে কৌতূহল। তিনি উচ্চকণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন:]

দুর্যোধন: কে আসে, কে নতুন অতিথি? দেবদূত, কে এসেছে?
দেবদূত: যাঁকে খুঁজছেন তিনি নন, কিন্তু ইনিই সর্বোত্তম
স্বর্গের অতিথি।
যুধিষ্ঠির: কে ঐ দিব্যকান্তি, সৌম্য, ধীরোদাত্ত সুকণ্ঠ পুরুষ
কোন্ দেব উনি?
দেবদূত: এখনো দেবতা নন, কিন্তু ব্যবহারে দেবোপম
আপনার ভ্রাতা, পূর্বজন্মে নরপতি দুর্যোধন
যুধিষ্ঠির: দুর্যোধন?
দেবদূত: ক্লান্ত, ধূলিধূসরিত দেহ, দুই চক্ষুও আবিল।
এখনই বিশ্রাম প্রয়োজন, ধর্মরাজ, তাই এমন বিভ্রান্তি
পুনরায় দেখে নিন, উনি কুরুরাজ দুর্যোধন!
যুধিষ্ঠির: দুর্যোধন, যাকে আমি ভগ্ন-ঊরু, ক্লেদাক্ত, নির্জীব
অবস্থায় শেষ দেখি, দুই চক্ষে ছিল বিষজ্বালা
পরাজয়ে হতমান, অন্তর্হিত বংশের মহিমা
তার এত প্রশান্ত শ্রী, এ যে অসম্ভব দেবদূত!
দেবদূত: হে রাজন, এ যে স্বর্গ, এখানে তো মুছে যায় সব
পার্থিব কলঙ্ক। মন্দাকিনী স্নাত পবিত্র সবাই
ন্যায় নিষ্ঠ ক্ষাত্র ধর্ম মেনেছেন যিনি আজীবন
সমস্ত সমরে শঙ্কাহীন, তিনি দেহান্তর মাত্র
স্বর্গ অধিকারী।
যুধিষ্ঠির: ন্যায় নিষ্ঠ ক্ষাত্র ধর্ম? অভিমন্যু, নিষ্পাপ কিশোর
তার হত্যা, চরম কাপুরুষতা আরও কত শত
দেবদূত: এখন সে সব তর্ক বৃথা!
ভ্রাতৃহত্যা, বংশধর-সর্বনাশ মানুষেরই খেলা
হত্যার কুযুক্তি আর পঙ্কিল কাহিনী সমুচয়
ভুলে যান, মহারাজ!

[দুযোধন যুধিষ্ঠিরকে চিনতে পারলেন। সাগ্রহে এগিয়ে এসে সপ্রেমে আলিঙ্গন করলেন ধর্মরাজকে। কিন্তু যুধিষ্ঠির সম-ব্যবহার করতে পারলেন না।]

দুর্যোধন: প্রিয় ভ্রাতা, যুধিষ্ঠির, আজ ধন্য আমি
তোমার স্পর্শের পুণ্যে ধন্য
তোমার সান্নিধ্যে শুধু সত্যের সৌরভ সেই ঘ্রাণে ধন্য!

[যুধিষ্ঠির দুর্যোধনের এই ভাষা বুঝতে পারলেন না। অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন।]

দুর্যোধন: সমস্ত মানবকূলে তুমি অদ্বিতীয়
সশরীরে স্বর্গে এলে
আমরা সেই গৌরবের অংশভাক্‌
আমাদের বহুদূর পিতামহ পুরুরবা
তোমার কীর্তির কাছে ম্লান
দেবদূত: এবার চলুন ধর্মরাজ!
দুর্যোধন: ক্ষণেক দাঁড়াও, দেবদূত!
যুধিষ্ঠির, চেয়ে দেখ, শিলাখণ্ডে আবিষ্ট আসীন
আমাদের সবার নমস্য, উনি প্রথম কৌন্তেয়
আমাদের, কুরু ও পাণ্ডব ভ্রাতাদের সর্ব জ্যেষ্ঠ
যুধিষ্ঠির: প্রথম কৌন্তেয়?
দুর্যোধন: এখনো জানো না
যশস্বিনী জননী কুন্তীর তুমি
প্রথম সন্তান নও?
যুধিষ্ঠির: জানি, হ্যাঁ, জেনেছি, তবে এমন সময়ে
যখন না জানা ছিল ভালো।
ভূপাতিত, স্থির নেত্র, প্রাণহীন সেই মহাবীর
যাঁকে আকৈশোর আমি চরম ঘৃণায়
ভয়ে ও বিদ্বেষে চিরশত্রু বলে মনে মনে জানি
তিনি পঞ্চ পাণ্ডবের সহোদর? আমার অগ্রজ!
এই জানা কি কঠিনতম শাস্তি নয়?
এ যেন মায়ের হাতে বিনা দোষে নির্দয় প্রহার!
দেবদূত: শান্ত হোন! শান্ত হোন!
যুধিষ্ঠির: আমি দ্বিতীয় পাণ্ডব!
আমি সিংহাসন-অধিকারী নই, ভুল, সব ভুল
সকলই তো প্রাপ্য তাঁর, যিনি জ্যেষ্ঠ, তিনি বীর কর্ণ
তবে কেন এত হানাহানি, এত ব্যর্থ রক্তপাত
মহাকুরুক্ষেত্ৰব্যাপী আত্মীয়-বন্ধুর ছিন্ন শব
জায়া-জননীর হাহাকার!
ভাই দুর্যোধন, কী ভুল করেছি আমি, মিথ্যেই তোমাকে
স্বার্থান্বেষী, কৃট ও কপট ভেবে, হৃদয়ে দিইনি স্থান
ক্ষমা করো, ক্ষমা করো!
দুর্যোধন: ক্ষমার তো প্রশ্নই ওঠে না, ভাই, কারণ এখানে
কোনো ক্রোধ নেই
অনুতাপ, পরিতাপ অর্থহীন, কারণ এখানে
কেউ কারো শত্রু নয়
অসূয়া ও স্পধাহীন অপার মিত্রতা
তারই নাম অবিমিশ্র সুখ, তারই নাম স্বর্গরাজ্য
দেবদূত: স্বর্গের সমস্ত সুখ বাসনা-সম্ভব
যার যার ইচ্ছেমত মুহূর্তে নির্মিত হবে গৃহ
কালস্রোত নেই তাই কোনো কিছু পুরোনো হয় না
রমণীরা সবাই স্বাধীনা, তারা স্বেচ্ছাপ্রণয়িনী
সম্পর্ক শৃঙ্খল নেই, অথচ প্রত্যেকে প্রত্যেকের।
খাদ্য ও পানীয় সবই চোখের নিমেষ দিয়ে গড়া
এই সব কিছু আজ আপনার ভোগ্য, শুধু আগে
পবিত্র সলিলা মন্দাকিনী নদী স্পর্শ করে নিন।
শরীর-চৈতন্য শুদ্ধ হবে।
দুর্যোধন: যুধিষ্ঠির, মানবজীবনে যাঁকে প্রণাম করোনি
সেই জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা কর্ণ, তাঁকে একবার
সম্ভাষণ না করেই চলে যাবে?

[যুধিষ্ঠির সঙ্কোচ ও লজ্জায় উত্তর দিলেন না। এই সময় কর্ণ উঠে দাঁড়িয়ে এদিকে ফিরলেন। জ্যোতির্ময় পুরুষ, তাঁর অঙ্গে কবচকুণ্ডল ফিরে এসেছে। কৌতুক-হাস্য মাখা মুখ।]

কর্ণ: এসো যুধিষ্ঠির।

[যুধিষ্ঠির তবুও নীরব]

দুর্যোধন: মনুষ্য শরীর, তাই এখনো যায়নি ওর
মানবিক দ্বিধা।
কর্ণ: এসো যুধিষ্ঠির, স্বর্গে স্বাগতম্ তুমি
তোমার পায়ের স্পর্শে এই স্বর্গভূমি ধন্য হলো
আমার অনুজ, তবু চিরকাল তুমি আমার শ্রদ্ধেয়
হে ধীমান, তুমি সকলের চেয়ে বড় বীর
ভূলোক-দ্যুলোক জয়ী তুমি
যুধিষ্ঠির: হে অগ্রজ, ক্ষমাপ্রার্থী আমি
দুর্যোধন: আগেই বলেছি ভাই, এখানে ক্ষমার প্রশ্ন নেই
ভূপৃষ্ঠের কর্মফল ভেবে আর উতলা হয়ো না
কর্ণ: পাথরে-কণ্টকে রুধিরাক্ত, ক্ষত-বিক্ষত শরীর
আহা কত কষ্টে পার হয়েছে কঠিন হিমালয়
মানবকুলের শ্রেষ্ঠ অভিযাত্রী তুমি, সবার প্রণম্য
যাও, বিশ্রাম ভবনে।
দুর্যোধন: এখনো সম্পূর্ণ গ্লানি মুক্ত নয় যুধিষ্ঠির
তাই রুদ্ধবাক
দেবদূত, তুমি ওঁকে পুণ্য স্নানে নিয়ে যাও!

[যুধিষ্ঠির সত্যিই কর্ণের সামনে আর কোনো কথা বলতে পারলেন না।
দেবদূত তাঁকে নিয়ে চললেন নন্দনকাননের অন্য প্রান্তে।]

যুধিষ্ঠির: স্বর্গের এ সিংহদ্বারে রয়েছে আমারই দুই ভ্রাতা
আর কেউ নেই কেন?
দেবদূত: সুক্ষ্মদর্শী যুধিষ্ঠির, এ প্রশ্ন সঠিক
এ এক অতুল কীর্তি, সশরীরে স্বর্গে পদার্পণ,
এর জন্য সুবিশাল সমারোহ, আনন্দ উৎসব
আয়োজিত হয়েছে এ স্বর্গভূমে আজ
কিন্তু ইন্দ্র আর সব জ্যোতিরিন্দ্রগণ
অপেক্ষা করছেন কিছু দূরে!
যুধিষ্ঠির: কৌতূহল মার্জনা করুন, দেবদূত
কেন দূরে? পুত্ৰ অভিমন্যু, পিতামহ ভীষ্ম, জনক-জননী
এঁদের দেখার জন্য উতলা হয়েছি আমি কিন্তু তাঁরা কেউ
অধমের জন্য ব্যস্ত নন বুঝি? এই বুঝি স্বর্গের নিয়ম?
দেবদূত: স্বর্গের নিয়ম নেই কিছু
এখানে রাজা ও প্রজা ভেদ নেই, প্রহরীও নেই
বাস্তব ও পরাবাস্তবতা কিছু নেই
শোষণ-শাসন নেই, তবু হানাহানি
নেই এ রাজত্বে, শুধু কল্পনার বাধাহীন লীলা।
পাণ্ডুপুত্র, আপনার পিতা ও পিতৃব্য, সন্তানাদি যত
সকলেই অধীর অপেক্ষারত রয়েছেন
স্বয়ং সস্ত্রীক ইন্দ্র, অন্যান্য দেবতাবৃন্দ ব্যাকুল প্রতীক্ষা নিয়ে
আছেন নন্দনকাননের অন্য প্রান্তদেশে
সবাই জানেন আজ মহাত্মা কর্ণের অভিপ্রায়
তিনি এই সিংহদ্বারে সায়াহ্নবেলায়
প্রথম সাদর সম্ভাষণ জানাবেন দ্রৌপদীকে
কর্ণের সম্মানে তাই সকলেই কিছু দূরে সরে রয়েছেন।
যুধিষ্ঠির: দ্রৌপদী, আমার পত্নী, পুত্রের জননী….
দেবদূত: দ্রুপদনন্দিনী, যাজ্ঞসেনী
পৃথিবীর শেষতম ধ্বংসের নায়িকা
কথঞ্চিৎ নরক দর্শন সেরে তিনি আসবেন অচিরেই
যুধিষ্ঠির: বন্ধুর পার্বত্যপথে করেছি নিষ্ঠুর ভাবে যাকে পরিত্যাগ
যে আমার অত্যাগসহন
পঞ্চ পাণ্ডবের বক্ষমণি, সে আমার প্রাণাধিক
ত্রিলোকের সর্ব সুখ যার প্রাপ্য, সেই দ্রৌপদীকে
ভূমিশয্যা নিতে দেখে থামিনি একটুও, আমি
এমনই কঠিন।
এই নীতি নিষ্ঠা আজ তুচ্ছ মনে হয়
দেবদূত, আমি অনুতপ্ত, যেন সর্ব অঙ্গে সূচ
একটু দাঁড়াও, আমি পাণ্ডব বংশের
কুললক্ষ্মী, প্রতি মুহূর্তের স্মরণীয়া
দ্রৌপদীকে সঙ্গে নিয়ে যাবো!
দেবদূত: এ কী কথা বলছেন, যুধিষ্ঠির!
যুধিষ্ঠির: অন্যায্য বলেছি কিছু দেবদূত?
দ্রৌপদী আমার পত্নী নয়? সে আমার
সঙ্গে যাবে, এটাই কি স্বতঃসিদ্ধ নয়?
দেবদূত: ধর্মরাজ, আপনার অবিদিত কিছু নেই
এমনই ধারণা ছিল। তবে কেন এ হেন বিভ্রম?
স্বর্গে পৃথিবীর কেউ কারো স্বামী কিংবা জায়া নয়
কেউ ভ্রাতা ভগ্নী নয়, সন্তান বা জন্মদাতা-দাত্রী নয়
নর-জীবনের সব সংস্কার মুছে দিতে হয়
এ যে চির যৌবনের রাজ্য, এই বিমূর্ত ভুবনে
প্রাক্তন সম্পর্ক যেন ছায়ামূর্তি, ধরা-ছোঁওয়া যাবে না কিছুতে
কর্ণ আজ দ্রৌপদীকে চেয়েছেন, এখানে অন্যের উপস্থিতি
মান্যযোগ্য নয় কোনোক্রমে। শুধু দুর্যোধন রয়েছেন
কর্ণের বয়স্য তিনি, দ্রৌপদীর দ্বিতীয় প্রণয়ী
যুধিষ্ঠির: আমার দক্ষিণ হাত অর্জুন কোথায়?
অর্জুন, অর্জুন!
দেবদূত: অর্জুন আসেননি, কিছু দেরি আছে
ঐ তো আসছেন, এসে পড়েছেন শ্রীময়ী দ্রৌপদী
নরক পেরিয়ে আসা, অঙ্গে কোনো গ্লানি-চিহ্ন নেই
যুধিষ্ঠির: দ্রৌপদী! দ্রৌপদী

[লঘু পায়ে স্বর্গদ্বার পার হলেন দ্রৌপদী। বহুবর্ণ প্রজাপতির মতন চঞ্চলা, স্বর্গে প্রবেশের জন্য ব্যস্ত। ছুটে নন্দনকাননের মধ্যে গিয়েও কর্ণ ও দুর্যোধনকে দেখে ফিরে দাঁড়ালেন।]

কর্ণ: পাঞ্চালী, কেমন আছো? চিনতে পারো কি?
স্বয়ম্বর সভাস্থলে যেমনটি ছিলে, ঠিক
তেমনই রয়েছো তুমি।
দ্রৌপদী: দানবীর কর্ণ? চিনবো না কেন? এই দিব্যকান্তি
কখনো কি ভুলে থাকা যায়?
তুমিও পূর্বেরই মতো অভিমানে অনন্য রয়েছো।
দুর্যোধন: স্বাগত পাবক শিখা, দ্রুপদনন্দিনী
সামান্য নরকবাসে পাওনি তো তেমন যন্ত্রণা?
দ্রৌপদী: ও কে, দুর্যোধন নয়?
পারত্রিক কুশল তো? না, না, আমি অত্যুত্তম আছি
নরক তেমন কিছু ভয়াবহ নয়, যে-রকম
রয়েছে রটনা।
নরকে সবাই বেশ লঘু ও আমোদপ্রিয়, খুবই সাবলীল
অনেকেই পরিচিত, কোনো অত্যাচার দেখিনি তো
এ যেন সবাই মিলে বনবাস, অচেনা ভুবনে
চেনা মুখ সম্মিলন
দুর্যোধন: এই স্বর্গে রয়েছেন কত দিব্যাঙ্গনা ও অপ্সরা
তবু তুমি, হে পাঞ্চালী, বিধাতার অপূর্ব নির্মাণ
তুমি এলে, স্বর্গ আরও আলোকিত হলো।
দ্রৌপদী: জানো নাকি এই স্বর্গ, এ আমার প্রাক্তন স্বদেশ
পৃথিবীতে অযযানিসম্ভূতা হয়ে কিছুদিন ভ্রমণে গিয়েছি
মানবলীলায় কিছু সুখ-শোক স্বাদ নেওয়া গেল
ফিরে এসে সব কিছু চেনা মনে হয়
পারিজাত পরিমলে সুস্নিগ্ধ বাতাস
এ ভূমির ধূলিকণা, প্রতিটি বৃক্ষের পাতা আমাকে চিনেছে।

[দ্রৌপদী ছুটে ছুটে গাছপালাদের আদর করতে লাগলেন। যুধিষ্ঠির কাতর ভাবে দূর থেকে দ্রৌপদীর নাম ধরে ডাকলেন, দ্রৌপদী শুনতে পেলেন না। বরং হাতছানি দিয়ে কর্ণকে ডাকলেন কাছে।]

কর্ণ: মানব জন্মের সব স্মৃতি তুমি অটুট এনেছো?
দ্রৌপদী: সব নয়। তিক্ত-কটু কষায় কুৎসিত
স্মৃতিগুলি মুছে গেছে
স্মরণে রেখেছি শুধু মাধুর্য ও আনন্দের কথা
কর্ণ: স্বয়ম্বর সভাগৃহে আমাকে কঠোর প্রত্যাখ্যান
করেছিলে, তাও মনে নেই?
তোমাকে প্রথম দেখা, সমস্ত দেখার শ্রেষ্ঠ দেখা
চকিতে মাথার মধ্যে শুরু হলো ঝড় ও অশনি
বিশ্ব চরাচর সব তুচ্ছ হয়ে গেল
চতুর্দিক অন্ধকার, যেন এক দ্বীপে শুধু তুমি
তুমি এক আলো দিয়ে গড়া মূর্তি, সত্য কিংবা মায়া
আমার চৈতন্যে শুরু হয়ে গেল তীব্র হাহাকার
মনে হলো, এক জন্মে আমার সমস্ত না-পাওয়ার
বিনিময়ে এই নারী, এ আমার, আর কারো নয়
লক্ষ্যভেদ অতি তুচ্ছ, প্রলয় সংহত করে আমি
এই বরবর্ণিনীকে পেতে চাই
আর তুমি? আমার যোগ্যতা আছে কি না তার
প্রমাণও নিলে না?
কটুবাক্যে ফেরালে আমাকে
দ্রৌপদী: প্রত্যাখ্যান করিনি তো, যৎসামান্য কৌতুক করেছি
দুর্যোধন: কৃষ্ণা, ভুলে গেলে, তুমি বলেছিলে, সূতজাতীয়কে
বরণ করবে না তুমি?
কর্ণ: সামান্য মানবী নও তুমি, তবু তুচ্ছ জাত-পাত আর
বংশ পরিচয় মোহে ঢেকে নিলে মুখ।
ব্যর্থ হলো আমার পৌরুষ!
দ্রৌপদী: ভেবেছি আঘাতে তুমি জ্বলে উঠবে দাবাগ্নির মতো
বীরশ্রেষ্ঠ, বাহুর দাপটে তুমি সকলকে প্রতিহত
করে দেবে, ক্ষত্রিয়-ব্রাহ্মণকুল ভয়ে মূর্ছা যাবে
সদর্পে হরণ করবে দয়িতাকে, আমি বীরভোগ্যা হবো।
কর্ণ: সবলে নারীকে যারা পেতে চায়, তারা।
প্রকৃত পৌরুষহীন, তারা ধিক!
ক্ষুধার্ত পশুরা চায় মাংসের শরীর
নারী যেন কাব্য রস, সুখদা স্বয়মাগতা হলে
অন্তরের রূপ খোলে, সেই রূপ পূর্ণ হয় প্রেমে
লক্ষ্যভেদ সেরে আমি তোমার সম্মুখে
প্রণয় প্রত্যাশী হয়ে দুরু দুরু বক্ষে দাঁড়াতাম
দ্রৌপদী: সুর্যপুত্র, সেদিন তোমাকে আমি নিমেষে চিনেছি
হাস্যমাখা ওষ্ঠ, চক্ষে ক্রোধ, তুমি চকিতে সূর্যের
দিকে চেয়েছিলে, মনে আছে, সব কথা মনে আছে!
সুর্যের সন্তান তুমি, প্রথম পাণ্ডব
আমার জন্মের গুঢ় মর্ম ছিল তোমার অজানা?
ধৃষ্টদ্যুম্ন আর আমি, যজ্ঞের আগুন থেকে জাত
বড় বেশি অগ্নি আর তেজে গড়া, হৃদয়েও জ্বলন্ত আগুন
দ্রোণ আর দ্রৌণপন্থীদের ভস্মসাৎ করে দেওয়াই তো
আমার নিয়তি
দ্রোণ তোমাকেও দিয়েছেন শুধু অবহেলা, তিক্ত অপমান
তোমাকে পেতাম যদি, কর্ণ, তবে যুদ্ধের অনল
সহজেই নিবে যেত, সপার্ষদ ধ্বংস হতো কপট ব্রাহ্মণ
আমার পিতার ক্ষুব্ধ আত্মা শান্তি পেত
কর্ণ: এসব তো রাষ্ট্রনীতি, বংশের স্পর্ধার ইতিকথা
প্রণয়ের ব্যাকুলতা মহাকাল-ইতিহাস কিছুই মানে না
যাজ্ঞসেনী, তোমাকে চেয়েছি আমি
নিঃসঙ্গ এ হৃদয় জুড়োতে!
দ্রৌপদী: তুমি ফিরে গেলে তাতে আমিও কি প্রত্যাখ্যাতা নই?
একটি বাক্যও তুমি বলোনি আমার দিকে চেয়ে
দু’চক্ষু অন্যত্রগামী। তুমি দাতা, সেই অহঙ্কারে
অর্জুনের হাতে তুলে দিয়ে গেলে কাম্য রমণীকে।
কর্ণ, তবু সমস্ত জীবন আমি তোমাকে খুঁজেছি
ভেবেছি যে-কোনো দিন তুমি এসে দাঁড়াবে সহসা
কুন্তীর প্রথম পুত্র এবং আমার অগ্রগণ্য স্বামী হবে
শোনোনি কৃষ্ণের দৌত্যে আমার আহ্বান?
কর্ণ: সে অনেক দেরি হয়ে গেছে
শুধুই জন্মের সূত্রে প্রণয়ের অংশভাগী হবো?
কৃষ্ণ বহুদর্শী, তবু তার সে প্রস্তাব হাস্যকর!
তোমাকে দ্বিতীয় দেখি, একবস্ত্রা, দূত ক্রীড়াপণ্যা, যেন দাসী
তৎক্ষণাৎ জ্বলে উঠি, নীচতা আক্রান্ত হয়ে আমি
তোমার উদ্দেশে বহু বিষময় কুকথা বলেছি
কিন্তু তা যে এক ব্যর্থ প্রণয়ীর গুঢ় আর্তনাদ
কেউ কি বোঝেনি? কৃষ্ণা, তুমিও বোঝোনি?
দুর্যোধন: ফুরিত অধরা, কৃষ্ণা, এখনো রয়েছে ক্রোধ বুঝি?
দ্রৌপদী: না, না, কোনো ক্রোধ নেই শুধু খেদ এই
যখন নীরব ছিল নতমুখে মহা শক্তিধর পঞ্চপতি
আশা ছিল, তখন কর্ণকে পাবো পাশে
যে আমার প্রথম প্রণয়ী!
কর্ণ: এখন তোমার পাশে, এত কাছে কখনো আসিনি
নীলোৎপল সৌরভমাখা বরতনু, এই সুচারুহাসিনী
নারী, তুমি, তুমি কি অলীক?

[দ্রৌপদী হাত বাড়িয়ে কর্ণের অঙ্গ স্পর্শ করলেন। দূরে যুধিষ্ঠিরের মুখ বেদনায় কুঞ্চিত হয়ে গেল।]

দ্রৌপদী: কামনা বাসনাময়ী আমি এক নারী
আগুনে জন্মেছি তাই সর্ব অঙ্গে বড় বেশি জ্বালা
কর্ণ: দ্রৌপদী!
যুধিষ্ঠির: দ্রৌপদী!

[দ্রৌপদী এবার তাকালেন যুধিষ্ঠিরের দিকে। ঈষৎ ভূভঙ্গে হাসলেন। তারপর আবার ফিরলেন কর্ণের দিকে। দুর্যোধন একটু দূরে একটা শিলাখণ্ডে বসে পড়েছে।]

দ্রৌপদী: চলো, সখা, মন্দাকিনী সলিলে শরীর ধুয়ে নিই
আমার শ্রবণ উষ্ণ, চক্ষু উষ্ণ, শিরায় শিরায় দাবদাহ
আমার শৈশব নেই, তাই স্নেহ-মমতা জানি না
দেখিনি জননী ক্রোড়, তাই ঠিক মাতা হতে পারিনি কখনো
পায়ের আঙুল থেকে কেশাগ্র পর্যন্ত যৌবনের আঁচ
আমি এরকম ভাবে গড়া
সেই আঁচ কিছুটা ভাসিয়ে দেবো স্বৰ্গনদী স্রোতে
কর্ণ: নদীকে যা দেবে তুমি, তা আমায় দাও।
আমি প্রার্থী, আমি ধন্য হবো।
দ্রৌপদী: তুমি সুর্যপুত্র, তুমি আর কত আঁচ নিতে পারো?
কর্ণ: এই নদী যত পারে, তার চেয়ে বেশি!

[দ্রৌপদী ততক্ষণে দৌড়ে চলে এসেছেন মন্দাকিনী তীরে। কর্ণ তার পাশে এসে দাঁড়াতেই দ্রৌপদী তাঁর দিকে জল ছুঁড়ে দিলেন। তারপর দুজনেই খেলার কৌতুকে, নির্মল হাসিতে ভরিয়ে দিলেন দশ দিক।]

দেবদূত: এ কী ধর্মরাজ, আপনি অনড় প্রস্তরবৎ কেন
সম্মুখে চলুন, অতি বিশিষ্টরা প্রতীক্ষা-ব্যাকুল
ঢের দেরি হয়ে গেছে
পূর্বেই বলেছি, এই দৃশ্যখানি
আপনার না দেখাই ভালো ছিল, সুশোভন ছিল।
যুধিষ্ঠির: দেবদূত, আমি আর স্বর্গ অভিলাষী নই
ফিতে যেতে চাই
দেবদূত: এ কী অসম্ভব কথা। স্বর্গরাজ্য জয় করেছেন
সেই দার্ঢ্য, সেই কীর্তি, তার পুরস্কার চির স্বর্গসুখ
যুধিষ্ঠির: স্বর্গে কোনো স্বর্গসুখ নেই। সেই স্বপ্ন
আছে শুধু পৃথিবীতে। হায়, সব মিথ্যে হয়ে গেল।
হে সুভদ্র, আমাকে ফেরার পথ বলে দাও, কোন্ দিকে যাবে?
দেবদূত: সশরীরে স্বর্গে তবু আসা যায়, ফেরে না তো কেউ
যুধিষ্ঠির: দ্রৌপদী, দ্রৌপদী!
দেবদূত: এ কী যুধিষ্ঠির, আপনার চোখে জল
ছি ছি, এই পুণ্যক্ষেত্রে ক্রন্দন করে না কেউ, দেখিনি কখনো
অশ্রুবিন্দু এখানে অচেনা, সে তত মর্ত্য, পৃথিবীর
লঘু দুর্বলতা
যুধিষ্ঠির: আমিও তো পৃথিবীর, আমিও মানুষ
হিংসা-ঈর্ষা-মোহ-মায়া সব কিছু মিলিয়ে মানুষ
ক্রোধ আছে, কান্না আছে, শরীরী নিয়ম সবই আছে
দেবদূত: ইন্দ্রের প্রসাদে
অচিরেই ইহলোক-চিহ্ন মুছে গিয়ে
দেবত্বে উন্নীত হয়ে অতি জ্যোর্তিময় কান্তি হবে আপনার
যুধিষ্ঠির: দেবত্ব চাই না আমি, আমাকে মানুষ থাকতে দাও
আমাকে মানুষ হয়ে বাঁচতে দাও
মানুষ, মানুষ!

[অদূরে কর্ণ ও দ্রৌপদীর জল খেলা ও প্রমোদের হাসি চলতেই থাকে। তার মাঝে মাঝে শুনতে পাওয়া যায় যুধিষ্ঠিরের কান্নার শব্দ।]