স্মৃতির শহর ১০

চীনে পাড়ায় আমাদের বন্ধু ছিল শেখ সুলেমান
তার বিবির নাম ওয়ালিং
একটি লাল কাগজ মোড়া লণ্ঠন ঝুলতো তাদের সংসারে
এরা নিশীথ মানুষ
সূর্যের সঙ্গে এদের বিশেষ চেনাশুনো নেই
এরা জাঁ পল সার্ত-এর নাম শোনে নি
কিন্তু সার্ত্র-এর দর্শনকে জীবন্ত করে
এরা দিব্যি বেঁচে চলেছে
সুলেমানের কোনো বাল্যকাল নেই, আগামী কাল নেই
ওয়ালিং-এর আছে একটি ছোট বৃত্ত।
এবং সুলেমান, একটি ছাগল ও একটি বাঁদর
এরা বৃষ্টি এবং অন্ধকারকে
অবিকল বৃষ্টি ও অন্ধকারের মতন দেখে
এদের দু’পাশ দিয়ে
নদী এবং নর্দমা সমান ভাবে বয়ে যায়
মনুসংহিতা, হাদিস ও মার্কসের বাণী
ঘুর ঘুর করে এদের খাটিয়ার নীচে।

বেতের মতন ছিপছিপে চেহারা সুলেমানের
তার বয়েসের গাছ পাথর নেই
পুরুষের এমন মেদহীন কোমর আমি আর
দ্বিতীয় দেখিনি
অনায়াসেই সে প্রাচীন গ্রীসের কোনো দেবতা হতে পারতো
কিংবা সে ছিলও তাই
ইদানিং সে কলকাতার ধুলোকে
বারুদ করার কাজে ব্যস্ত
দাড়ি গোঁফ নেই, তার মাথার চুল পাতলা
তার চোখ দুটি প্রকৃত খুনির মতন ঝকঝকে
খালি গা, বারবার লুঙ্গিতে গিট বাঁধা তার মুদ্রাদোষ
চিড়িক করে লম্বা থুতু ফেলে সে সমস্ত
ব্যবস্থার বিরুদ্ধে
আমরা মুখোমুখি দুই খাটিয়ায় বসি
সে আমাদের গেলাসে ঢেলে দেয় সামসু
তখন টিনের চালের ওপর থেকে চ্যাঁচামেচি করে
ওয়ালিং-এর বাঁদর
সার্কাসের খেলোয়াড়ের মতন প্রথম সে
লাফ দিয়ে ওঠে ল্যাম্প পোস্টে
তারপর সরসরিয়ে নেমে এসে সে দেখায় তার চতুর মুখ
আমাদের মাঝখানে দাঁড়িয়ে সে সমান হয়
এবং হাত বাড়ায়
তাকেও দেওয়া হয় একটি গেলাস
ওয়ালিং-এর ছাগলও ডাকাডাকি শুরু করলে
গেলাসের বদলে তাকে দেওয়া হয় টিনের বাটি
ওয়ালিং এক এক সময় আলোয়
এক এক সময় অন্ধকারে
সে আমাদের জন্য চিংড়িমাছের বড়া ভেজে আনে
সেই কর্কশ মদ্য পান করতে করতে
আমাদের অতি আপন সন্ধে
মধ্য রাতের দিকে ছোটে

সুলেমানের দু’একটি কথা শুনলেই বোঝা যায়
সে অনেক রকম আগুনে মুখ আচমন করেছে
সে হাতে মেখেছে মানুষের রক্ত
শরীর হজম করেছে ইস্পাত

এবং সে জানে
খিদে জিনিসটা অতি অপবিত্র এবং
ভালোবাসার কোনো বিকল্প নেই
মৃত্যু তার দূর বিদেশের আত্মীয়
আর জীবন তার পান্তা ভাত ও ডালের বড়া
সে কোনো ধর্মের নাম শোনে নি
যেমন সে কখনো সিল্কের জামা পরে নি
এবং সিল্কের জামারাও সুলেমানকে চেনে না
মাঝে মাঝে ওয়ালিং কী খেয়ালে থমকে গিয়ে
তার কাঁধে হাত রেখে দাঁড়ায়
যেন পারিবারিক চিত্র তোলবার জন্য
উল্টো দিকে রয়েছে বোর্ন অ্যান্ড শেফার্ডের ক্যামেরা
বাঁদরটি তখন ঈর্ষা জানায়
সে মাথা ঘষতে থাকে ওয়ালিং-এর নিম্ন উদরে
দু’জনের নিজস্ব ভাষায় চলে প্রেম বিনিময়
সুলেমান শুরু করে দেয় পুলিশের গল্প
প্রসঙ্গত এসে যায় বেশ্যা, ফড়ে, চোলাইকারী ও
ছদ্মবেশী উন্মাদেরা।

প্রতিটি বোতল শেষ হলে
ওয়ালিং দাম নিয়ে যায় আমাদের কাছ থেকে
সেই সঙ্গে সে দেয় আশ্চর্য সুন্দর বিনে পয়সার হাসি
খাটিয়ায় পা দোলাতে দোলাতে
আমরা তিন বন্ধু ক্রমশ উষ্ণ হয়ে উঠি
একটু নেশা হলেই বাঁদরটি কান্না শুরু করে
ছাগলটি গান গায়
যতই রাত বাড়ে ততই ওয়ালিং-এর
হাসিতে ফোটে খই
চীনা মেয়েদের তুলনায় বেশ বড় তার স্তনদ্বয়
হাসির সঙ্গে তাল রেখে দোলে
মধ্য কলকাতায় বসে আমরা পৌঁছে যাই
সাঁওতাল পরগনায়
প্রাণ যেখানে তরুণ শাল গাছের মতন আকাশমুখী
খুশি যেখানে পলাশ গাছে ঝড়
এরই মধ্যে কখন সেই ঘরের সামনে এসে থামে
ব্লাক মারিয়া
তার থেকে নামে সুলেমানের গল্পেরই কোনো চরিত্র
সে সুলেমান ও ওয়ালিং-এর বদলে
আমাদের দিকেই নজর দেয় বেশি
আর আমরা তিন বন্ধু এমনই গ্রেফতার-পরায়ণ যে
সাব ইনস্‌পেকটার দেখলে একটুও অস্থির হই না
তার দিকেও আমরা গেলাস বাড়িয়ে দিই
অথবা পাঁচ টাকার নোট
এক একদিন অবশ্য গোঁয়ারের মতন আমাদের
নিয়ে যায় ফাঁড়িতে
পরের সন্ধ্যেবেলা সুলেমান জিজ্ঞেস করে,
দেশলাই ফেলে গেলে,
আগুন ঠিক মতন পেয়েছিলে তো?

এখান থেকে আধ মাইলের মধ্যে রয়েছে
ফাট্‌কা বাজার ও বারোয়ারি মহাকরণ
সুসজ্জিত দাস-ব্যবসায়ীদের হল্লা চলে ওখানে সারাদিন
লাইফইনসিওরেন্স ও প্রভিডেন্ট ফান্ড
গুলিচালনা ও দুর্ঘটনা
জন্মান্ধদের হাস্য পরিহাস
পরগাছা ও পরভৃতিকদের সাঙ্কেতিক সংলাপ
অলীকের উত্থান-পতন
সকলেই অন্যের তাওয়ায় রুটি সেঁকে নিতে চায়
অথচ প্রতিদিন ভোরে বিলি হয়
কপাল কোঁচকানো খবরের কাগজ
বিমান উড়ে যায়, মাতৃগর্ভের শিশুও
সেই গর্জন শোনে
চাঁদের দিকে ছুটে চলে
লক্ষ লক্ষ বাদলা পোকা
নদীর দীর্ঘশ্বাস ছুঁয়ে যায় দুঃখী ধীবরদের
পৃথিবী চলেছে তার নিজের নিয়মে।

আসলে তিনজন সুলেমানের মধ্যে
একজনই শুধু বেঁচে আছে
অন্য দু’জনকে খুন করে।

তিনজন ওয়ালিং-এর মধ্যে একজনই শুধু
পেয়েছে তার নির্ভরযোগ্য পুরুষকে
বাঁদর ও ছাগলদের সে সমস্যা নেই
কে মরে কে বাঁচে ওরা তা জানে না
সুলেমান ঊরু খুলে তার ছুরিটি শান দেয়
ওয়ালিং-এর বুক চাটে লাল লণ্ঠনের আলো
ওরা দু’জনে মিলে এক বিশাল বেঁচে থাকার
বিজ্ঞাপন
পাকা বাড়ির তিনটি কাঁচা ছেলে ওদের দেখে
তারপর তাদের নাম বদলাবদলি হয়
ওদের বিভ্রান্ত মাথায় লাগে রাত্রির শুশ্রুষা
অট্টহাসির সঙ্গে মিশে যায় কান্না
সুলেমান পৃথিবীর উচ্চতম চূড়ায় উঠে
ওড়ায় তার পতাকা
ওয়ালিং দ্বিতীয় বসুন্ধরা হয়ে নাচ শুরু করে
যেন আর সময় নেই
এখনই অদৃশ্য হয়ে যাবে ওরা
ওদের মায়াবী অস্তিত্ব দুলছে হাওয়ার স্তম্ভে
আমরা উঠে তিন দিকে মুখ ফিরিয়ে দাঁড়াই
আমাদের ওষ্ঠে ঝলসে ওঠে বর্ণমালার অস্ত্র
অসীম মহাশূন্যের দিকে ছুঁড়ে দিই
আমাদের বুক ফাটা অনুক্ত গান।