বিশেষ পরিস্থিতিতে জাতীয় জীবনের কোন কোন বিষয় অগ্রাধিকার পাবে, সে ব্যাপারে আমাদের বিবেচনা অত্যন্ত সীমিত। তার ফলে জাতির ক্ষতি এত বেশি ও সুদূরপ্রসারী হয়, যা আর কখনোই পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়। কোভিড-১৯-এর মহামারির সম্ভাব্য ব্যাপকতা ঠেকাতে সরকার গত ১৭ মার্চ থেকে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করে।
সাড়ে পাঁচ মাস টানা বন্ধ থাকায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে তেলাপোকা ও অন্যান্য পোকামাকড় নির্বিঘ্নে বংশবিস্তার করেছে। শ্রেণিকক্ষের বেঞ্চ ও চেয়ার-টেবিল ভরে গেছে চামচিকার বিষ্ঠায়। তবে একসময় যখন বিদ্যালয় খুলবে, তখন ওসব নোংরা সাফ করা যাবে; কিন্তু দীর্ঘ সময় ছাত্রছাত্রীরা শ্রেণিকক্ষের বাইরে সহপাঠীদের থেকে বিচ্ছিন্ন থাকায় তাদের যে ক্ষতি হলো, তা কোনো দিনই পূরণ করা সম্ভব হবে না।
গত হপ্তায় যুক্তরাজ্যের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা অধ্যাপক ক্রিস হুইটি বিবিসিতে বলেন, শিশু স্কুলে গেলে যতটা ক্ষতির মুখে পড়বে, তার চেয়ে বেশি ক্ষতি হবে স্কুলে না গিয়ে বাড়িতে থেকে। তিনি বলেন, যুক্তরাজ্য ও বিশ্বের অন্যান্য দেশের তথ্যপ্রমাণ বলছে, শিশুরা সাধারণত গুরুতর অসুস্থ হয় না এবং কোভিডের উপসর্গ দেখা গেলে বড়জোর হাসপাতাল পর্যন্ত যেতে হয়েছে।
১ সেপ্টেম্বর থেকে ইংল্যান্ডে সব বর্ষের শিক্ষার্থীরা পূর্ণকালীন ক্লাসে ফিরেছে। হুইটি বলেছেন, স্কুলে না গেলে শিশুরা দীর্ঘমেয়াদি মানসিক ও শারীরিক অসুস্থতায় পড়তে পারে। এই চিকিৎসাবিজ্ঞানী বলেছেন, যেসব শিশু করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে, তারা আগে থেকেই ‘অতি গুরুতর’ কোনো স্বাস্থ্যজনিত সমস্যায় ভুগছিল। সরকারি তথ্যমতে, ইংল্যান্ড ও ওয়েলসে মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত কোভিডে সংক্রমিত হয়ে ১৯ বছরের কম বয়সী ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে, আর তার চেয়ে বেশি বয়সী মারা গেছে ৪৬ হাজার ৭২৫ জন।
কোভিড-১৯ মহামারির বিস্তার ঘটা সত্ত্বেও আমাদের কলকারখানায় প্রথম দিকে কয়েক দিন ছাড়া উৎপাদন বন্ধ ছিল না। প্রথম কিছুদিন অফিস-আদালতও সীমিত আকারে চলেছে, হাটবাজার, দোকানপাট সব খোলা। কিছুদিন বন্ধ থাকার পর গণপরিবহনও স্বাভাবিক চলা শুরু করে। লঞ্চ, ট্রেনও এখন স্বাভাবিক। সম্পূর্ণ বন্ধ রইল শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ১৭ মার্চ থেকে শুরু করে ৩ অক্টোবর পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছুটি ভোগ করবে।
মিল-কারখানায় কাজ না হলে তা দেখা যায় এবং তার ক্ষতি পরিমাপ করা যায়। ফসলের মাঠ পানিতে তলিয়ে গেলে কৃষকের ক্ষতিটা চোখে পড়ে। দীর্ঘ সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলে শিশু-কিশোরদের যে অপূরণীয় ক্ষতি, তা চোখে দেখা যায় না। আজ যারা প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে, তাদের ভেতর থেকেই মেধাবীরা ১৫-১৬ বছর পর শিক্ষক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, রাজনীতিবিদ, প্রশাসনিক কর্মকর্তা হবে। তাদের ভিত্তি যদি দুর্বল থাকে, জাতির ভিত্তি শক্ত হতে পারবে না।
শিক্ষাক্ষেত্রে গত এক দশকে যেসব খামখেয়ালিমূলক পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছে, তাতে খুব বড় রকমের ক্ষতি হয়েছে শিক্ষার্থীদের। বিদ্যাশিক্ষার চেয়ে পরীক্ষাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। অথচ পরীক্ষা কাকে বলে, সে সম্পর্কে কর্তাদের বিশেষ ধারণা আছে, সে পরিচয় পাওয়া যায়নি। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সঙ্গে পরীক্ষা গ্রহণ অপরিহার্য। শিক্ষা ও পরীক্ষার সম্পর্ক নিয়ে এবং কীভাবে পরীক্ষা গ্রহণ করা উচিত, সে সম্পর্কে সমগ্র উপমহাদেশে প্রথম গবেষণা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য স্যার ফিলিপ জে হার্টগ। তিরিশের দশকে তিনি বাংলাদেশসহ সারা ভারতবর্ষ ঘুরে ছাত্র-শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে যে গবেষণাপত্র তৈরি করেন, তা সব কমনওয়েলথ দেশে উচ্চ প্রশংসিত হয়েছিল। সেই গবেষণাপত্র সম্পর্কে কিছু জানেন, তেমন কাউকে আমি পাইনি।
দেশের অভিজ্ঞ শিক্ষকদের সঙ্গে পরামর্শ না করে দুই শিক্ষা মন্ত্রণালয় দৈববাণীর মতো একেকটা সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে। পরীক্ষা জিনিসটা কী, তা দুই শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানলে হবে না, যে শিশু পরীক্ষা দেবে, তাকেই জানতে হবে। যে নাবালক শিশু জানে না পরীক্ষা কাকে বলে, তার ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে ভীতিকর পাবলিক পরীক্ষার বোঝা। তার ফলে আনন্দময় পাঠশালার চেয়ে প্রাণহীন কোচিংশালায় ছোটাকেই বলা হচ্ছে বিদ্যার্জন।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় অর্ধবার্ষিক পরীক্ষা নেওয়া সম্ভব হয়নি। শিক্ষা মন্ত্রণালয় এক হুকুম জারি করে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী (পিইসি), ইবতেদায়ি শিক্ষা সমাপনী (ইইসি), জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) ও জুনিয়র দাখিল সার্টিফিকেট (জেডিসি) পরীক্ষা বাতিল করেছে। পরীক্ষা বাতিল সমাধান নয়। তাতে শিক্ষা বিভাগের কর্মকর্তারা ঝামেলা থেকে বেঁচে গেলেন। শিক্ষার্থীদের বিদ্যা অর্জন কতটা হলো, তা নিয়ে মাথাব্যথা নেই কারও।
শিক্ষাজগৎ শুধু ছাত্রছাত্রী ও তাদের শিক্ষকদের নিয়ে নয়, তাদের অভিভাবকদের নিয়েও। অভিভাবকদের ক্ষতির দিকটা দেখা হচ্ছে না। কারণ, তাঁদের কোনো শক্ত ‘সমিতি’ নেই। করোনার কারণে কাজ হারিয়েছেন অন্তত ৩৫ শতাংশ শ্রমিক-কর্মচারী। আয় কমেছে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের। তাঁদের ছেলেমেয়েরা স্কুল-মাদ্রাসায় পড়ে। বিদ্যালয়ে যাওয়া বন্ধ, কিন্তু ছেলেমেয়ের স্কুলের টিউশন ফি পরিশোধের চাপ আসছে। বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বলছে, তাদের শিক্ষক-কর্মচারীদের চলবে কীভাবে? সেটাও ফেলে দেওয়ার মতো কথা নয়। অনেক বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক চাকরি হারিয়েছেন।
করোনার কারণে বাংলাদেশে প্রায় চার কোটি শিক্ষার্থী ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে আশঙ্কা করছে ইউনেসকো। সম্প্রতি এক পলিসি ব্রিফের মাধ্যমে সংস্থাটি জানিয়েছে, করোনার কারণে বাংলাদেশে ৩ কোটি ৯৯ লাখ ৩৬ হাজার ৮৪৩ শিক্ষার্থী ক্ষতিগ্রস্ত। এ ছাড়া ২ কোটি ৪০ লাখ শিক্ষার্থী ঝরে পড়তে পারে বলে ইঙ্গিত করা হয়েছে। (বণিক বার্তা, ২৪ আগস্ট)
যে শিক্ষাব্যবস্থায় পাঠদান শ্রেণিকক্ষনির্ভর, সেখানে অনভ্যস্ত দূরশিক্ষাপদ্ধতি বা অনলাইন শিক্ষাদান মেধাবিকাশে ও চরিত্র গঠনে সহায়ক হবে না। অনলাইনে, রেডিও, টেলিভিশনের মাধ্যমে শিক্ষাদানের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। দরিদ্র অনেকের বাড়িতেই টিভি নেই, ইন্টারনেট সংযোগের তো প্রশ্নই আসে না। অটোপ্রমোশন খুব খারাপ দৃষ্টান্ত। সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে বার্ষিক পরীক্ষা নেওয়া ভালো ব্যবস্থা নয়। বরং শিক্ষাবর্ষের সময় বাড়িয়ে সিলেবাস শেষ করাই সংগত। এসব প্রশ্নে দেশের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও প্রবীণ শিক্ষকদের পরামর্শ নিয়ে আর দেরি না করে সিদ্ধান্ত না নিলে খুব ক্ষতি হয়ে যাবে। বিদ্যাশিক্ষায় শর্টকাট পথ বলে কিছু নেই।
প্রথম আলো, সেপ্টেম্বর ১, ২০২০।