নির্দেশ পালন করাতে পারবে কি মন্ত্রণালয়

ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখের কথা পাঠককে জানাতে সংকোচ হয়। ১৯৪৮ সালে আমার মা ২২ বছর বয়সে মারা যান বিনা চিকিৎসায়। শুধু তিনি নন, প্রসবের সময় তাঁর কন্যাসন্তানটিও মারা যায়। আব্বার ডায়েরি থেকে জেনেছি, একলাম্পশিয়ায় আক্রান্ত হয়ে অতিরিক্ত রক্তস্রাবে তাঁর মৃত্যু হয়। শিবালয়ে ছিল নিকটস্থ সরকারি ডিসপেনসারি। তার একমাত্র চিকিৎসক ছিলেন এলএমএএফ পাস। তিনি ছুটিতে গিয়েছিলেন। আর ছুটিতে না গিয়ে থাকলেও কোনো লাভ হতো না। ওষুধপথ্য বলতে ছিল কয়েকটি বড় বোতল। তা দিয়ে প্রসবকালীন ধনুষ্টঙ্কার রোগীর জীবনরক্ষা সম্ভব হতো না। সমগ্র মানিকগঞ্জ জেলায় (তখন মহকুমা) ছিলেন একজন এসবি চিকিৎসক মানিকগঞ্জ সদর হাসপাতালে।

৭০ বছর আগে ৯৫ শতাংশ মানুষ বিনা চিকিৎসায় মারা যেত। তখন অধিকাংশ মানুষের অসুখ-বিসুখে চিকিৎসা ছিল ঝাড়ফুঁক ও তাবিজ-কবচ। এখন একজন মানুষও একেবারে বিনা চিকিৎসায় মারা যাওয়ার কথা নয়। ইউনিয়ন পর্যায়েও চিকিৎসাসেবার ব্যবস্থা থাকায় শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হার কম। উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ কেন্দ্র ৫০ শয্যাবিশিষ্ট। জেলা সদর হাসপাতাল ২০০ থেকে ৫০০ শয্যাবিশিষ্ট। কর্মস্থলে ৫০ শতাংশ চিকিৎসক-নার্স থাকলেও সেটা কম নয়। সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকদের বাইরে প্রতিটি উপজেলায় এমবিবিএস প্রাইভেট প্র্যাকটিশনার আছেন অনেকে।

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার কয়েক মাস আগে অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সময় ঢাকা মেডিকেল স্কুলকে ‘ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে’ রূপান্তর করা হয়। ঢাকা মেডিকেলের এমবিবিএসের প্রথম ব্যাচ পাস করে বের হয় পঞ্চাশের দশকের শুরুতে। তাঁদের ভেতর থেকে দ্রুত অনেককে যুক্তরাজ্য থেকে এমআরসিপি, এফআরসিএস এবং ডিও করিয়ে আনে সরকার। ষাটের দশক নাগাদ আধুনিক চিকিৎসাব্যবস্থা গড়ে ওঠে। তবে সাধারণ মানুষ আধুনিক চিকিৎসাসেবার বাইরেই থেকে যায়।

ষাটের দশকে ভাষাসংগ্রামী ও রবীন্দ্রগবেষক আহমদ রফিকের মাধ্যমে ডা. ফজলে রাব্বী, ডা. আলীম চৌধুরীসহ (উভয়েই একাত্তরে শহীদ) পূর্ব পাকিস্তান মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের বড় বড় চিকিৎসকের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা হয়। আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানে বাঙালি তখন আর পিছিয়ে নেই। প্রতিষ্ঠিত হয়েছে চট্টগ্রাম, রাজশাহী, রংপুর, ময়মনসিংহ, স্যার সলিমুল্লাহ প্রভৃতি মেডিকেল কলেজ এবং উচ্চতর হাসপাতাল আইপিজিএমআর (বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়)। দেশে বর্তমানে সরকারি মেডিকেল কলেজ ৩৮টি এবং মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ৫টি। বাংলাদেশ বেসরকারি মেডিকেল কলেজে সয়লাব, বর্তমানে ৭৩টি। খবরে দেখেছি, আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠার আয়োজন সম্পন্ন।

বাংলাদেশ দুর্নীতিসহ বহু ব্যাপারে চ্যাম্পিয়ন। সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারেও সে সমগ্র পৃথিবীতে শীর্ষে। প্রতি ৫০০ মিটারের মধ্যে পাওয়া যাবে কোনো হাসপাতাল অথবা ডায়াগনস্টিক সেন্টার কিংবা একটি ক্লিনিক। শুধু বড় শহর, জেলা শহর ও উপজেলা সদর নয়, গ্রামের হাটবাজারগুলোতেও ‘মডার্ন হাসপাতাল’, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার অসংখ্য। এখন দেশে বেসরকারি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সংখ্যা ১৫ হাজারের বেশি: জাতিসংঘের সদস্যদেশগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ।

২০১৪ সালে এমবিবিএস ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস কেলেঙ্কারির পর ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীরা তথ্যপ্রমাণসহ আমাদের নাগরিক সমাজের অনেকের শরণাপন্ন হন। প্রাথমিক তদন্তে প্রশ্নপত্র ফাঁসের প্রমাণ পাওয়া যায়। শিক্ষার্থীরা রাজপথে আন্দোলন করতে থাকেন। বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের নেতৃবৃন্দ, প্রখ্যাত চিকিৎসাবিজ্ঞানী মাহমুদ হাসান এবং আমি ক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বসে ঘটনাটির পর্যালোচনা করি, কিন্তু কোনো প্রতিকার করা গেল না। ওই ভর্তি পরীক্ষার ফল বাতিল করে নতুন পরীক্ষা নেওয়া সম্ভব হলো না। এখন যাঁরা এমবিবিএস/বিডিএস শিক্ষার্থী, ভবিষ্যতে তাঁরাই হবেন দেশের মানুষের চিকিৎসক। সুতরাং ডাক্তারি পড়তে মেধাবীদের অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত, ২০-৩০ লাখ টাকা খরচ করে জালিয়াতির মাধ্যমে ভর্তি হওয়া অপেক্ষাকৃত কম মেধাবীরা নন।

এমবিবিএস ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অত্যন্ত বিরক্ত ও ক্ষুব্ধ হন। এসব জাল-জালিয়াতি ও দুর্নীতি বন্ধের জন্য কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেন তিনি। তখনকার স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণমন্ত্রী আ ফ ম রুহুল হকের সঙ্গে জালিয়াতি ঠেকানোর উপায় নিয়ে আলোচনা হয়। তারপর স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বিশিষ্ট সাংবাদিক ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি ওভারসাইট কমিটি গঠন করেন।

ডেঙ্গু-চিকুনগুনিয়া প্রভৃতি প্রতিরোধ নিয়ে আলোচনা করতে মোহাম্মদ নাসিম দুই সিটির মেয়র ও কর্মকর্তা এবং আমাদের নিয়ে বহুবার সভা করেছেন। তাতে কিছু কাজ হয়েছে। করোনায় আক্রান্ত হওয়ার দু-তিন দিন আগেও তাঁর সঙ্গে আমার কথা হয়। মন্ত্রী না থাকলেও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তা, এনজিও, নাগরিক সমাজের লোকদের নিয়ে সমন্বিতভাবে করোনা প্রতিরোধের ওপর তিনি গুরুত্ব দেন। এর মধ্যে করোনাতে তিনি নিজেই চলে গেলেন।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কেনাকাটায় দুর্নীতির কথা দেশের মানুষের অজানা নয়। এর মধ্যে করোনার সময় স্বাস্থ্য বিভাগের অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতি প্রকটভাবে প্রকাশিত হয়। পৃথিবীর কোনো দেশে যা হয়নি, বাংলাদেশে তা না হয়েই পারে না। এমন কথিত হাসপাতালকে অধিদপ্তর করোনা চিকিৎসার দায়িত্ব দিয়েছে, যারা অসুস্থকে সুস্থ এবং চমৎকার স্বাস্থ্যের অধিকারীকে করোনার রোগী বানাতে পারে।

জনবহুল দেশে সরকারি হাসপাতালের পাশাপাশি বেসরকারি ও প্রাইভেট হাসপাতালের প্রয়োজন রয়েছে। প্রায় সব দেশেই তা রয়েছে। সচ্ছল মানুষ দ্রুত স্বাস্থ্যসেবা পেতে প্রাইভেট হাসপাতাল ও ক্লিনিকে গিয়ে থাকেন। কিন্তু প্রাইভেট হাসপাতালে ঠিকমতো চিকিৎসা হচ্ছে কি না, তা দেখার দায়িত্ব স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের। মন্ত্রণালয় কি সে দায়িত্ব পালনে সক্ষম অথবা ইচ্ছুক?

১৫ হাজার বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকের মধ্যে ৫ হাজারের কম তাদের নিবন্ধন নবায়ন করেছে, বাকিগুলো তাদের নিবন্ধন নবায়নের প্রয়োজন বোধ করেনি। তাদের নিবন্ধন নবায়নের সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়েছিল ২৩ আগস্ট। ওই সময়ের মধ্যে নিবন্ধন নবায়ন না করলে হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার বন্ধ করে দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। দুই দিন পার হয়েছে, লাইসেন্স নবায়ন করেনি, এমন কয়টি প্রতিষ্ঠান বন্ধ করা হয়েছে, আমাদের জানা নেই।

ভাবিয়া করিও কাজ, করিয়া ভাবিও না- এমন একটি কথা বহুকাল থেকে আমাদের সমাজে প্রচলিত। হুট করে তারিখটি ঘোষণাই ছিল ভুল। আরেকটু বেশি সময় দেওয়া যেত। যে হুকুম পালন করানো যাবে না, তা জারি করা বোকামি। ২০১৮ সালের ৪ সেপ্টেম্বর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এক পরিপত্রে বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকের নিবন্ধন ফি এবং নিবন্ধন নবায়ন ফি ৫ হাজার থেকে বাড়িয়ে সর্বনিম্ন ৫০ হাজার ও সর্বোচ্চ আড়াই লাখ টাকা নির্ধারণ করে। বাংলার মাটিতে কে কার কথা শোনে।

ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার একটা চমৎকার ব্যবসা। মানুষের বাঁচা-মরার সঙ্গে সে ব্যবসার সম্পর্ক নেই। লাইসেন্স নবায়নের জন্য দাখিল করতে হবে পরিবেশের ছাড়পত্র, চিকিৎসক-নার্স প্রভৃতির পূর্ণ বিবরণ, সিটি করপোরেশনের ছাড়পত্র, কর সার্টিফিকেট প্রভৃতি। এসব ঝামেলা কেন তারা পোহাবে? গত ২৬ জুলাই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় একটি টাস্কফোর্স গঠন করেছে, দেখা যাক তার ক্ষমতা প্রয়োগের মুরোদ কতটা।

মানুষকে মোটাতাজা ও স্বাস্থ্যবান করে শতায়ু করা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কাজ নয়। অপচিকিৎসাবশত অপমৃত্যু বা অকালমৃত্যু যাতে না হয়, তা দেখাশোনা করা তার দায়িত্ব। নিম্নমানের হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলো যদি বন্ধ করে দেওয়ার ক্ষমতা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় না রাখে, তাহলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থাকা না-থাকা সমান।

প্রথম আলো, আগস্ট ২৬, ২০২০।