গত মার্চে বাংলাদেশে প্রথম যখন কোভিড-১৯ রোগী শনাক্ত হয়, তখন কারও পক্ষেই অনুমান করা সম্ভব হয়নি ছয় মাস পরে দেশে কী ধরনের সমস্যা হতে পারে। বরং একটা সাধারণ ধারণা করা হয়েছিল, তিন-চার মাসের মধ্যেই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যাবে। প্রথমে কেউ কল্পনাও করতে পারেননি ছয় মাসে মারা যাবেন ৪ হাজার ৫৫২ জন এবং নিশ্চিত আক্রান্তের সংখ্যা ৩ লাখ ২৯ হাজার ২৫১। ‘নিশ্চিত আক্রান্তের’ কথা বলা হলো এ জন্য যে আরও অনেকেই আক্রান্ত হয়েছেন, কিন্তু শনাক্ত হননি। তাঁদের কেউ সুস্থ হয়ে উঠেছেন অথবা মারা গেছেন। তাঁদের কোনো হিসাব নেই।
করোনায় বাংলাদেশি নাগরিক মৃত্যুর সংখ্যা সাড়ে ৪ হাজার নয়, ৬ হাজারের বেশি। বিদেশে বাংলাদেশ দূতাবাস এবং প্রবাসী কমিউনিটির কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী এ মাসের প্রথম পর্যন্ত বিদেশের মাটিতে মারা গেছেন অন্তত ১ হাজার ৫৩৮ জন বাংলাদেশের নাগরিক। আক্রান্ত হয়েছেন প্রায় ৭০ হাজার।
বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সবচেয়ে বড় উৎস রেমিট্যান্স বা প্রবাসী শ্রমিকদের পাঠানো অর্থ। ১ এপ্রিল থেকে ১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পাঁচ মাসে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ বিশ্বের ২৭টি দেশ থেকে দেশে ফেরত এসেছেন ১ লাখ ২ হাজার ২২৬ জন প্রবাসী। তাঁদের মধ্যে পুরুষ ৯৮ হাজার ২১০ জন এবং নারী ৮ হাজার ১৬ জন। বিদেশের যেসব প্রতিষ্ঠানে তাঁরা কাজ করতেন, সেখানে মহামারির কারণে কাজ না থাকায় তাঁদের ফেরত পাঠানো হয়েছে।
প্রথম মাস তিনেক মানুষ আতঙ্কিত হয়ে দিশেহারা ছিল, এখন অনেকটাই ধাতস্থ হয়েছে। বাস্তবতা মেনে নিয়েছে। বুঝতে পেরেছে করোনার সঙ্গেই বসবাস করতে হবে। স্বাভাবিক কাজকর্ম না করলে বাঁচা যাবে না। সে জন্য বিভিন্ন উপায় বের করা হয়েছে। উদ্বেগ সত্ত্বেও জীবনযাত্রা অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে আসায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের কর্তাদের মধ্যে স্বস্তি ও ঢিলেঢালা ভাব লক্ষ করা যাচ্ছে। তাঁরা বলছেন, অন্যান্য দেশের তুলনায় আমাদের অবস্থা ভালো। সুতরাং ডরের কিছু নেই।
মানুষের জন্ম-মৃত্যুর জন্য স্থান-কাল বা দেশ-বিদেশ নেই। বিদেশে গেলে কারও মৃত্যু হবে না, তা নয়। কিন্তু বাংলাদেশি প্রবাসী শ্রমিকদের মৃত্যুর হার খুব বেশি। বিষয়টি নিয়ে কারও উদ্বেগ নেই। অপুষ্টি, অত্যধিক পরিশ্রম ও বিশ্রামের অভাবে প্রবাসী শ্রমিকদের স্বাস্থ্য দ্রুতই ভেঙে পড়ে। তাঁরা কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় মারা যান। মধ্যপ্রাচ্যে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যাও বহু। সবার লাশ দেশে এনে সৎকার করা সম্ভব হয় না। তা সত্ত্বেও ২০১৯ সালে ৩ হাজার ৬৫৮ প্রবাসী শ্রমিকের মরদেহ দেশে আনা হয়েছে। গত ১০ বছরে এ রকম লাশ এসেছে প্রায় ২৮ হাজার। জমিজমা বিক্রি করে যাঁরা বিদেশে গিয়েছিলেন, তাঁদের পরিবারের ভাগ্যে কী ঘটেছে, আমরা জানি না।
অধিকাংশ প্রবাসী শ্রমিকেরই দুর্দশার শেষ নেই। তাঁদের দুঃখের কথা শোনার কেউ নেই। তাঁরা শারীরিক নির্যাতনের শিকার। নারী শ্রমিকদের যৌন হয়রানির প্রতিকার নেই। তাতে অনেকে আত্মহত্যা পর্যন্ত করেন। আমাদের দূতাবাস ও মিশনগুলোর ভাগ্যবান কূটনীতিক ও কর্মকর্তাদের দায়িত্ব প্রবাসীদের দেখভাল করা। তাঁদের স্মরণে থাকে না যে তাঁদের বেতন-ভাতা প্রভৃতি প্রবাসীদের আয় থেকেও আসে। নিয়োগ নিয়ে বিদেশে কাজে যোগ দিতে যাওয়ার সময় এবং দেশে ফিরে আসার সময় বিমানবন্দরে তাঁরা যে আচরণ পান, তাকে মানবিক বলা যায় না।
করোনায় যেসব মানুষ মারা গেছেন, তাঁদের অধিকাংশই নিজ নিজ পরিবারের একমাত্র উপার্জনশীল সদস্য। সরকারি বা আধা সরকারি চাকরিজীবীদের মধ্যে যাঁরা মারা গেছেন, তাঁরা চাকরিবিধি অনুযায়ী পেনশন বা অন্যান্য সুবিধা পাবেন। তাঁদের বাইরে যাঁরা বিভিন্ন ছোটখাটো প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন বা অন্য কিছু করে জীবিকা নির্বাহ করতেন, তাঁদের মৃত্যুতে পরিবার পড়েছে গভীর সংকটে। আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে অনেকে বেঁচে গেলেও স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে তাঁদের বেশ সময় লাগবে। ফলে তাঁরাও উপার্জনহীন হয়ে পড়েছেন।
পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ (জিইডি) থেকে সম্প্রতি প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) বাস্তবায়নে ৮৮ ধরনের ঝুঁকির আশঙ্কা রয়েছে। সেগুলো মোকাবিলা করা না গেলে ১৭টি প্রধান লক্ষ্য অর্জন বাধাগ্রস্ত হবে। এসডিজির প্রথম লক্ষ্য ‘দারিদ্র্য বিমোচন’। এ ক্ষেত্রে চিহ্নিত করা হয়েছে সাতটি ঝুঁকি। এরপর রয়েছে ‘ক্ষুধা থেকে মুক্তি’। এই লক্ষ্য অর্জনে ঝুঁকি চিহ্নিত করা হয়েছে নয়টি।
গত কয়েক বছরে বাংলাদেশে অনেক ক্ষেত্রেই অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে, কিন্তু কর্মসংস্থান সন্তোষজনক নয়। ফলে সার্টিফিকেটসর্বস্ব শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে। বেকারত্ব দূর হলে দারিদ্র্য দূর হবে। দারিদ্র্য দূর হলে ক্ষুধা থেকে মুক্তি ঘটবে।
করোনার কারণে দেশে অন্তত এক-চতুর্থাংশ মানুষ নতুন করে কর্মহীন বা দরিদ্র হয়েছে। তা ছাড়া প্রতিদিন গড়ে দুই হাজার প্রবাসী শ্রমিক চাকরিচ্যুত হয়ে দেশে ফিরে আসছেন। এই ধারা যদি অব্যাহত থাকে, তাহলে আগামী ছয় মাসে সাড়ে তিন লাখ থেকে চার লাখ প্রবাসী শ্রমিক কাজ হারিয়ে দেশে ফিরে আসবেন। তাঁদের মধ্যে কয়েক হাজার নারী।
এবার করোনা মহামারির মধ্যেই অতিবৃষ্টি, দীর্ঘস্থায়ী বন্যা, ব্যাপক নদীভাঙন, ঘূর্ণিঝড় প্রভৃতি প্রাকৃতিক দুর্যোগে কয়েক কোটি মানুষের জীবনযাত্রা বিপর্যস্ত হয়েছে। নদীভাঙনে সরকারি হিসাবে গৃহহীন হয়েছে আট লাখ মানুষ। তাদের পুনর্বাসন সহজ নয়।
অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ থেকে উঠতি তরুণ-তরুণীর মধ্যে দেখা দিচ্ছে হতাশা। ফলে মাদকাসক্তের সংখ্যা বাড়ছে। করোনার মহামারির মধ্যেই সংবাদমাধ্যমে দেখা যাচ্ছে নানা ধরনের অপরাধের খবর। হতাশাগ্রস্ত এবং দরিদ্র ও ক্ষুধার্ত মানুষকে সমাজবিরোধী শক্তি অপরাধে ব্যবহার করতে পারে। এমন কিছু সামাজিক অপরাধ আছে যা প্রশাসন, পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষে রোধ করা কঠিন।
গত ছয় মাসের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি কর্মপরিকল্পনা না নিলে শুধু অর্থনৈতিক সংকট দেখা দেবে না, সামাজিক শান্তিও বিঘ্নিত হতে পারে। এসডিজি বাস্তবায়নের ওপর পড়বে তার বিরূপ প্রভাব। দেশে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড শূন্যের কোঠায় থাকায় মানুষের অসন্তোষের নিয়মতান্ত্রিক প্রকাশ ঘটছে না; কিন্তু জনগণের অসন্তোষের অনিয়মতান্ত্রিক প্রকাশের পরিণাম শুভ হয় না। রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও নীতিনির্ধারকদের বিষয়টি ভেবে দেখা দরকার।
প্রথম আলো, সেপ্টেম্বর ১৪, ২০২০।