আকাশ-নাবিক

আখরোট বনে,
বাদাম খুবানি বনে
কেটেছে তোমার দিন।
হে পাখী শুভ্রতনু,
সফেদ পালকে চমকে বিজুরী, চমকে বর্ণধনু,
সোনালি, রূপালি রক্তিম রংগিন।

হালকা রেখায় আকাশ ফেলেছো চিরে,
পার হ’য়ে গেছে কত আলোকের স্তর,
রৌদ্রে, শিশিরে নোনা দরিয়ার নীরে
ফিরেছো কখনো আকাশের তীরে তীরে;
হে বিহঙ্গ! জানতে না ভয়, কখনো পাওনি ডর।
ইরান বাগের বেদানা ওড়ায়ে এনেছো পক্ষপুটে,
স্বপ্ন দেখেছে দূর আকাশের সেতারা তোমার সুরে,

সহসা-প্রকাশ আনারকলির পাপড়ি উঠেছে ফুটে,
লাজ-রক্তিম আনন্দ তার সকল বন্ধ টুটে,
দূর দিগন্ত পাড়ি দিয়ে তারে জাগাও তোমার সুরে;
আখরোট বনে
বাদাম খুবানি বনে।
পাকা খরমুজা ফেটে পড়ে কত
মিঠে শরবত বুকে,
তার চেয়ে মিঠে মিছরিও মানে হার,
তোমার তূতীর কণ্ঠ শিরীণ! নার্গিস আঁখি তার
আনারকলির পাপড়ি নিয়ে সে খুঁজে ফেরে বন্ধুকে।
দিল রাত্রির মৌসুম তার ফুলের জোয়ারে ভরা
তোমার পাখায় শিরীণ তোমার হয়েছে স্বয়ম্বরা।
স্বপ্ন-মেদুর কেটেছে অহর্নিশ
আকুল আবেগে আঁখি মেলে নার্গিস;
আখরোট বনে
বাদাম খুবানি বনে।

মেহেদির শাখে থোকা থোকা ফোটে ফুল,
পাতার আড়ালে জাগে দ্বাদশীর চাঁদ,
কোন্ নির্জন গোলাব শাখায় অশান্ত বুলবুল,
সুরের বন্যা জোছনা ভাসায় জোয়ারে রাতের বাঁধ
মধুঘন রাত, স্বপ্ন চোয়ানে শান্ত মুগ্ধ রাত,
গভীর আবেগে তোমার দু’চোখে শিশির-অশ্রুপাত,
ঘুমায় শ্রান্ত তুতী
ঘুমায় শ্রান্ত নার্গিস আঁখি জাগছে কেবল যুথী;
আখরোট বনে
বাদাম খুবানি বনে।

তোমার সকাল ব’য়েছে পূবালি আকাশে রক্ত থালি
মেহেদীর রঙে, জাফরান রঙে অপূর্ব শুভ্রতা,
ঘুম-ভাঙা চোখে কলকণ্ঠির কত কথা ব্যাকুলতা,
রসে ফেটে প’ড়ে আনারকলির সুসম্পূর্ণ ডালি!
শুরু হয় ফের দিগন্ত অভিযান
শুরু হয় ফের নতুন প্রভাতী গান,
নিথর বিমানে, দূর সমুদ্র পানে
আকাশ-নাবিক জাগাও জোয়ার টান।

কবে তুমি হায় প’ড়েছ ধূলির ‘পরে
জানি নাই, আজ দেখছি বাতাস ব’য়ে যায় হাহা-স্বরে।
বৃথা খোসা-ভাঙা বাদাম পাথরে প’ড়ে,
রসাল খুবানি মাটিতে পড়ছে ঝ’রে
তুমি শুধু নাই পাখি,
প’ড়ে আছে কোন্ নোনা ঘেরা অশ্রুর বন্দরে,
বাদামের খোসা ছড়ায় ধূলির ‘পরে
তুমি শুধু নাই পাখি।

অকালমৃত্যু ঝরোকার কাছে এসে
হে পাখি! তোমার উঠছে আর্তস্বর,
তুমি দেখ কোন ক্ষুধিত ভয়ঙ্কর
হিংস্র চোখের দৃষ্টি-তীক্ষ্ণ শর
নিরাশা ধূসর কালো পটে ভাসে মৃত্যুর বন্দর।
কোথায় একলা ফির্ছে তোমার তুতী,
সাপের ফণার কাছে এসে তার নিভে যায় অনুভূতি।

পারে না উড়তে। সেতারা কি ক্ষীয়মাণ?
চাঁদের ভাটার ঝড়-তরঙ্গে যুঝে সে হ’য়েছে মান?
আজ কি তোমার পথে ও পাথারে আজদাহা মাথা নাড়ে?
আজ কি তোমার বুকের পাঁজরে দারুণ যক্ষ্মা বাড়ে
অনেক আগেই থেমেছে তোমার পথ চ’লবার গান,
সূর্য হয়েছে ম্লান,
শিরীন কণ্ঠ ভেঙেছে তোমার তূন্ত্রী
চাঁদের কাহিনী ভুলেছে তোমার জোছনা রাতের দূতী।

এখানে শোনো না গোধূলি শান্ত শীষ
পেয়েছে শ্রান্ত দিনশেষে শুধু কালো রাত্রির বিষ,
হালকা পালক ওড়ে না তুফানে ঝড়ে,
ক্রমাগত শুধু নুয়ে প’ড়ে ভেঙে প’ড়ে,
হায় নীড়হারা ক্ষুধা মন্বন্তরে
সকল দুয়ার রুদ্ধ কোথায় ঠাঁই তার, ঠাঁই তার
এ অচেনা বন্দরে?
ফেরে না তো পাখি তার পরিচিত ঘরে
আখরোট বনে
বাদাম, খুবানি বনে।

সে কি ভুলে গেছে ঝড়ের আঘাতে তার পরিচিত ঘর!
তুফানে সে পাখি মেনেছে কি পরাজয়?
বুক-চেরা স্বর ভাসছে বাতাসে তূতীর আর্তস্বর,
আজ কি জীবনে ঘনায়েছে পরাজয়?
হে বিহঙ্গ! তুমি তো জীবনে কখনো পাওনি ডর,
কখনো তো তুমি মানো নাই পরাজয়!
সাত আকাশের সফেদ মুক্তি! কালো রাত্রির ফণা
গ্রাস ক’রল কি তুমি ছিলে যবে সুপ্ত অন্যমনা?
তবু জানি তুমি এ অপমৃত্যু ছাড়ায়ে উঠতে পারো।
তবে কেন আছো প’ড়ে?
হে বিহঙ্গ এই জিঞ্জিরে প্রবল আঘাত হানো,
সাত আকাশের বিয়াবানে ফের উদার মুক্তি আনো;
এখানে থেক না প’ড়ে।

কথা ছিল তুমি, হে পাখি! কখনো মানবে না পরাজয়,
তোমার গানের মুক্ত নিশান উড়েছে আকাশময়,
দূর আকাশের তারারা দেখছে তোমার এ পরাজয়;
তোমার পতন দেখে আজ পাখি সবে মানে বিস্ময়!

হে বিহঙ্গ! এ শুধু শ্রান্তি বুঝতে পারো না তুমি,
ক্ষণ-বিস্মৃতি জাগায় সামনে বালিয়াড়ি মরুভূমি
দেখছো কেবল তৃষ্ণায় ভরা কালো রাত্রির বিষ-
সূর্যোদয়ের পথে দেখ নাই মিঠে পানি; ওয়েসিস।
ডুবে গেছে চাঁদ? আঁধারে যায় না দেখা?
হে পাখি! এখনো নেভেনি তোমার তারার শুভ্র রেখা,
তোমার জোছনা হয়নি তো আজো ম্লান
আখরোট বনে
বাদাম, খুবানি বনে।

আজকে আবার সেখানে ফিরতে হবে।
পার হয়ে এই যক্ষ্মাবসাদ শ্রান্ত ব্যাধিতে ঘেরা,
পার হ’য়ে এই বজ্র নিপাত আকাশের বুক-চেরা
দিতে হবে ফের আঁধারের বুকে চাষ,
ভরাতে আনারকলিতে বন্ধ্যা মরুভূর অবকাশ,
আনতে নতুন বীজ যেতে হবে ফারানের অভিযানে,
ভরাতে মাটির রুক্ষতা সেই প্রবল জোয়ার টানে।
যদিও সূর্য বন্দী এখন আঁধারের ঝরোকা’তে
পূব দিগন্তে জেগেছে আলোর গান:
সাত আকাশের যৌবন অম্লান।
তবে সুর তোলো নীল জোয়ারের আলোকিত ঝর্ণাতে।

হে পাখি তোমার এ জড়তা ঘুচে যাক,
তোমার শীর্ণ ক্লিন্নতা মুছে যাক
কালো রাত্রির সাথে ক্ষীয়মাণ ঝরোকাতে।

আবার আতশী গান, আবার জাগুক দিগন্ত সন্ধান,
আরক্ত আভা তোমার তৃতীর কণ্ঠ রবে না ঢাকা,
আবার মেলবে রক্তিম আঙ্রাখা
নীল আকাশের তারার বনের স্বপ্নমুখর মনে
আখরোট বনে বাদাম
খুবানি বনে।