ডাহুক

রাত্রিভ’র ডাহুকের ডাক…
এখানে ঘুমের পাড়া, স্তব্ধদীঘি অতল সুপ্তির!
দীর্ঘ রাত্রি একা জেগে আছি।
ছলনার পাশা খেলা আজ প’ড়ে থাক,
ঘুমাক বিশ্রান্ত শাখে দিনের মৌমাছি,
কান পেতে শোনো আজ ডাহুকের ডাক।

তারার বন্দর ছেড়ে চাঁদ চ’লে রাত্রির সাগরে
ক্রমাগত ভেসে ভেসে পালক মেঘের অন্তরালে,
অশ্রান্ত ডুবুরি যেন ক্রমাগত ডুব দিয়ে তোলে
স্বপ্নের প্রবাল।
অবিশ্রাম ঝ’রে ঝ’রে প’ড়ে
শিশির পাখার ঘুম,
গুলে বকৌলির নীল আকাশ মহল
হ’য়ে আসে নিসাড় নিঝুম,
নিভে যায় কামনা চেরাগ;
অবিশ্রান্ত ওঠে শুধু ডাহুকের ডাক।

কোন্ ডুবুরির
অশরীরী যেন কোন প্রচ্ছন্ন পাখির
সামুদ্রিক অতলতা হ’তে মৃত্যু-সুগভীর ডাক উঠে আসে,
ঝিমায় তারার দীপ স্বপ্নাচ্ছন্ন আকাশে আকাশে।
তুমি কি এখনো জেগে আছো?
তুমি কি শুনছো পেতে কান?
তুমি কি শুনছো সেই নভঃগামী শব্দের উজান?

ঘুমের নিবিড় বনে সেই শুধু সজাগ প্রহরী!
চেতনার পথ ধরি চলিয়াছে তার স্বপ্ন-পরী,
মন্থর হাওয়ায়।
সাথী তন্দ্রাতুর।
রাত্রির পেয়ালা পুরে উপচিয়া প’ড়ে যায় ডাহুকের সুর।
শুধু সুর ভাসে
বেতস বনের ফাঁকে চাঁদ ক্ষ’য়ে আসে
রাত্রির বিষাদ ভরা স্বরাচ্ছন্ন সাঁতোয়া আকাশে।

মনে হয় তুমি শুধু অশরীরী সুর!
তবু জানি তুমি সুর নও,
তুমি শুধু সুরযন্ত্র! তুমি শুধু বও
আকাশ-জমানো ঘন অরণ্যের অন্তর্লীন ব্যথাতুর গভীর সিন্ধুর
অপরূপ সুর…
অফুরান সুরা…
ম্লান হ’য়ে আসে নীল জোছনা বিধুরা
ডাহুকের ডাকে!
হে পাখি! হে সুরাপাত্র! আজো আমি
চিনিনি তোমাকে।

হয়তো তোমাকে চিনি, চিনি ঐ চিত্রিত তনুকা,
বিচিত্র তুলিতে আঁকা
বর্ণ সুকুমার।
কিন্তু যে অপূর্ব সুরা কাঁদাইছে রাত্রির কিনার
যার ব্যথা-তিক্ত রসে জ’মে ওঠে বনপ্রান্তে বেদনা দুঃসহ,
ঘনায় তমালে, তালে রাত্রির বিরহ
সেই সুর পারি না চিনিতে।
মনে হয় তুমি শুধু সেই সুরাবাহী
পাত্র ভরা সাকী।
উজাড় করিছ একা সুরে ভরা শারাব-সুরাহি
বনপ্রান্তে নিভৃত একাকী।

হে অচেনা শারাবের ‘জাম’।
যে সুরার পিপাসায় উন্মুখ, অধীর অবিশ্রাম
সূর্যের অজানা দেশে
তারার ইশারা নিয়ে চলিয়াছ এক মনে ভেসে
সুগভীর সুরের পাখাতে,
স্তব্ধ রাতে
বেতস প্রান্তের ঘিরে
তিমির সমুদ্র ছিঁড়ে
চাঁদের দুয়ারে,
যে সুরার তীব্র দাহে ভেসে চলো উত্তাল পাথারে,
প্রান্তরে তারার ঝড়ে
সেই সুরে ঝ’রে প’ড়ে
বিবর্ণ পালক,
নিমেষে রাঙায়ে যায় তোমার নিষ্প্রভ তনু বিদ্যুৎ ঝলক,
তীর-তীব্র গতি নিয়ে ছুটে যায় পাশ দিয়ে উল্কার ইশারা,
মৃত অরণ্যের শিরে সমুদ্রের নীল ঝড় তুলে যায় সাড়া
উদ্দাম চঞ্চল;
তবু অচপল
গভীর সিন্ধুর
সুদুর্গম মূল হ’তে তোলো তুমি রাত্রি ভরা সুর।

ডাহুকের ডাক…
সকল বেদনা যেন সব অভিযোগ যেন
হ’য়ে আসে নীরব নির্বাক।
রাত্রির অরণ্যতটে হে অশ্রান্ত পাখি!
যাও ডাকি ডাকি
অবাধ মুক্তির মত।

ভারানত
আমরা শিকলে,
শুনিনা তোমার সুর, নিজেদেরি বিষাক্ত ছোবলে
তনুমন করি যে আহত।

এই ম্লান কদর্যের দলে তুমি নও,
তুমি বও
তোমার শৃঙ্খল-মুক্ত পূর্ণ চিত্তে জীবন মৃত্যুর
পরিপূর্ণ সুর।
তাই তুমি মুক্তপক্ষ নিভৃত ডাহুক,
পূর্ণ করি বুক
রিক্ত করি বুক
অমন ডাকিতে পারো। আমরা পারি না।

বেতস লতার তারে থেকে থেকে বাজে আজ বাতাসের বীণা;
ক্রমে তা’ও থেমে যায়,
প্রাচীন অরণ্যতীরে চাঁদ নেমে যায়;
গাঢ়তর হ’ল অন্ধকার।
মুখোমুখি বসে আছি সব বেদনার
ছায়াচ্ছন্ন গভীর প্রহরে।
রাত্রি ঝ’রে পড়ে।

পাতায় শিশিরে…
জীবনের তীরে তীরে…
মরণের তীরে তীরে…
বেদনা নির্বাক।
সে নিবিড় আচ্ছন্ন তিমিরে
বুক চিরে, কোন্ ক্লান্ত কণ্ঠ ঘিরে দূর বনে ওঠে শুধু
তৃষাদীর্ণ ডাহুকের ডাক।