হায়াত দারাজ শূন্যচারী সংলাপ

হায়াত দারাজ
এ এক আজব দেশ! মাঠে মাঠে অত্যন্ত সহজে
সোনার ফসল ফলে; অতঃপর আরো সহজেই
উঠে যায় অদৃশ্য পকেটে! সে পকেট কত বড়,
কতটা অতলস্পর্শী কেউ তার জানে না ঠিকানা।
শুধু জানে এ নিয়ম, বঞ্চনার এ কাল ফ্যাসাদ
রয়ে যাবে চির কাল, সরানো যাবে না কিছুতেই।
আশ্চর্য এ দেশে তবু আবেগের উদ্দাম জোয়ারে
বৎসরান্তে আসে বান, ডুবে যায় নদী, নালা, মাঠ;
দুরন্ত তুফান ওঠে ক্ষুদ্র পেয়ালিতে। বন্যাবেগে
পরিকল্পনার ঢেউ আসে ফিরে সুপরিকল্পিত
বহু মুণ্ড ঘুরে, কিন্তু ফল লাভ হয় না কখনো।
যে ক্ষুব্ধ তুফান ওঠে এক দিন ছোট পেয়ালিতে
সে তুফান মিশে যায় পূর্ববৎ সেই পেয়ালায়,
মিশে যায় কোলাহল অর্থনীতি, শিক্ষা ও কৃষ্টির
প্রচুর হল্লার শেষে কোনখানে; কেউ তা জানে না।
বহু ঘাটে পানি খেয়ে, বহু তিক্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে
দেখেছি জিন্দেগীভর দায়িত্ব এড়িয়ে যথারীতি
কিভাবে সহজে এরা ঘূর্ণাবর্তে পেতে চায় পার!
বাস্তব-বিমুখ স্বপ্নে, বিভ্রান্ত হাজার মতবাদে
এ এক আশ্চর্য জাতি বুঝেও বোঝে না কোন দিন।

শূন্যচারী
কে তোমার পাকা ধানে মই দিল? কে তোমার মনে
ছেড়ে দিল অশান্তির এ পোকা চঞ্চল? মধ্যরাত্রে
প্রচুর আফিম খেয়ে কেন দগ্ধ করো এ জাতিকে
অবান্তর বাক্যালাপে?

হায়াত দারাজ
মই দিল যে আমার মাঠে
তোমার ধানেও তার লুব্ধ দৃষ্টি!

শূন্যচারী
অনিদ্রা রোগের ফল,
কিংবা আফিমের পরবর্তী কার্যক্রম শুধু।
কে আমার দুশ্মন? অথবা কে কল্পিত তোমার
শত্রু সেই,- অন্তঃসারশূন্য ক’রে দেবে যে সহসা
এ জাতিকে?

হায়াত দারাজ
মনে রেখো অসতর্ক গৃহস্থ যেখানে
ঘুমায় দরজা খুলে, চুরি যায় বে-সামাল তার
সর্বস্ব। চোরের নাম কিংবা তস্করের পরিচয়
দেয় না সুফল, যদি বুদ্ধি তার না ফেরে মগজে।

শূন্যচারী
বুঝেছি সহজে তুমি দেবে না চোরের পরিচয়
কিন্তু এ-ও মনে রেখো, অহেতুক দুশ্চিন্তা তোমার
অলীক দুঃস্বপ্ন শুধু। যে আজাদী এল বহু দামে
এমন ভঙ্গুর নয়, উড়ে যাবে কম্পিত ঘূর্ণিতে;
তোমার আমার প্রাপ্য যথারীতি দেবে সে বুঝিয়ে।

হায়াত দারাজ
আজাদীর অর্থ নয় বিনাশ্রমে সব কিছু পাওয়া,
স্বাধীনতা খুলে দেয় শুধু সব শ্রমের দুয়ার,
যে পারে কাজের মাঠে নেমে যেতে শুধু সেই পারে
মুঠো ভরে তুলে নিতে সাফল্যের সোনা, পারে না যে
পথপ্রান্তে মরে। জীবন এখানে কেন স্বাদহীন
দিশাহারা কানামাছি কেন আজ ওড়ে ঘুরে ঘুরে,
ক্লান্ত দিন ক্লান্তিকীর্ণ রাত্রির কঠিন আবর্তনে,
কেন? কতটুকু তার খোঁজ রাখো বলো শূন্যচারী।

শূন্যচারী
সে কথা আমার নয়, নেবে যারা এই জনতাকে
মুক্তির মন্জিলে, তুমি জেনে রাখো দায়িত্ব তাদেরি;
আমার কর্তব্য যেটা খোঁজ রাখি আমি সে কাজের।

হায়াত দারাজ
তোমার কর্তব্য তুমি কতটুকু ক’রেছে পালন
এ যাবৎ? ভর দিয়ে অবাস্তব পরীর পাখায়
কি মেওয়া এনেছে লুট কোকা’ফের শিলারণ্য থেকে
শূন্যচারী?

শূন্যচারী
ব্যঙ্গোক্তির মাঠে দাও অন্যকে বুঝিয়ে
কটা ধানে কটা চাল, কিন্তু তুমি নিজের হিসাব
খতিয়ান করেছো কি এ জীবনে? দায়িত্ব তোমার
করেছো পালন তুমি কোন দিন পুরাপুরিভাবে?
তোমার কথায়, কাজে কেন জাগে আফিমের নেশা?

হায়াত দারাজ
সমালোচনার পথ মুক্ত হোক, চেয়েছি এটাই।

শূন্যচারী
আত্মসমালোচনার পথ রুদ্ধ কে ক’রেছে কবে?
কিন্তু মনে রেখো খান, ও দৃষ্টি প্রাচীন; যুগধর্মী
আধুনিক নয়।

হায়াত দারাজ
মানবিক দৃষ্টি দিয়ে দেখো তুমি,
দেখো তুমি ছিঁড়ে ফেলে যুগ-ভ্রান্ত খোলসের নিচে
যে মন রয়েছে চাপা ভোলেনি সে স্বধর্ম কখনো;
প্রয়োজন আছে তার তীক্ষ্ণ আত্মসমালোচনার।

শূন্যচারী
তোমার অভিজ্ঞ মনে এ তিক্ততা নিরর্থক নয়,
কিন্তু মনে রেখো খান! অকারণে তিক্ততা বাড়িয়ে
লাভ নাই কখনো জীবনে। বরং যেভাবে আছি
দায়িত্ব-বন্ধন-মুক্ত ক’রে রয়ে যেতে চাই সেভাবেই,
সমস্যার কণ্টকিত মরু মাঠে আনন্দের খোঁজে
ভারমুক্ত প্রাণ আমি ……

হায়াত দারাজ
আর আমি ব্যঙ্গবিদ এক
ভারবাহী;- তদুপরি অহিফেনসেবী। মিল নাই
দু’জনার কোনখানে, তবু, তবু আমি বলি আজ
একটা কর্তব্য আছে তোমার আমার সকলেরি
সে কর্তব্য। যদি আমি ছেড়ে যাই, কিংবা যদি তুমি
ছেড়ে যাও সে দায়িত্ব, শোধ নেবে অশেষ সময়।
খুলে দেবে একদা সে সুনিপুণ অতি ক্ষিপ্র হাতে
সমস্ত ফাঁকির চক্র, সব খেলা আত্ম-বঞ্চনার
জীবনের মাঠে নয়, পথে শুধু পঞ্চত্ব প্রাপ্তির।।