ইশারা

দিগন্তকোণে পশ্চিম থেকে সাড়া দিয়ে আসে ঝড়,
থামবে এবার ক্ষণচাপল্য মৃত বন-মর্মর,
আরবী তাজীর পিঠে যে বাঁধছে পথ চ’লবার ঘর
তার বাহনের তীব্র হ্রেষায় ফেটে প’ড়ে অম্বর।

হে মরুভূমির বেদুইন, তুমি সৌর প্রদীপ হাতে
অথবা জ্যোতিদীপ্ত চেরাগ ব’য়ে নিয়ে এলে সাথে!
তোমার ঝড়ে কি পাতা ঝ’রে ফের জাগবে নতুন পাতা?
তোমার ঝড়ে কি অচল জনতা শুন্‌বে চলার গাথা?
জাগ্বে তাদের দিগন্তে সে কী বিদ্যুৎ শিহরণ?
বজ্র-রবের বিপুল আরাবে চমকাবে মৃত মন?
তার পরে নীল আকাশে উধাও তারা?
তার পরে নীড় বাঁধবে সে গৃহহারা?

তুমি এনেছো এ পাথরে পাহাড়ে শিরীনের সংবাদ;
ভাঙে ফরহাদ কুঠারের মুখে প্রবল বাধার বাঁধ।
কুঠার তোমার বারবার ওঠে পড়ে,
কাঁপছে পাহাড় কুঠারের সেই ঝড়ে,

কাঁপছে মনের আকাশ এখন বেদনার বন্যায়,
জাগে স্নান-শুচি গুলে বকাওলী শিশিরের ঝর্ণায়-
নীল আকাশের খাঞ্চাশপাশের প্রান্তে লাল গোলাব
সাতরঙাতনু বর্ণধনুর ময়ূর মেলে কলাপ।

হে মোর শিরীন এবার নেকাব খোলো,
তোমার মুখের কালোপর্দার আড়াল এবার তোলো,
তোমার আকাশ হ’তে স’রে যাক্ দুঃস্বপ্নের মেঘ,
তোমার আকাশে পূর্ণ নিরুদ্বেগ
জাগুক তরুণী পঞ্চদশীর জাফরানী রক্তিমা-
– সে আমারি পূর্ণিমা।

আমার মনে সে ইশারা হানে,
মাটির ইশারা আকাশ জানে,
অন্ধরাতের ঝড় তুফানে
রবিশস্যের ফসল আনে।
আঙুরলতার আড়ালে ওকি
পঞ্চদশীর নেকাব খোলা।
রক্তে আমার প্রলয়-দোলা,
তাই জোছনার ইশারা ওকি,
মরু রাত্রির সহেলি সখী
আঙুরলতার বনবিতানে
ইশারা করে সে অজানা গানে।
অথবা তরুণী করে ইশারা,
বেদনার ফুলে জাগায় সাড়া,
মরুভ্রান্তের ভ্রাম্যমাণ
দিগন্তে জাগে তার ইশারা।
আকাশের কোণে সেকি পাহারা?
আকাশে জ্ব’লছে হাজার তারা,
কি জাগে ওখানে? চাঁদ? ইশারা?

জেনেছি তোমার ইশারা তাইতো ফিরে আসি বারবার,
ফরহাদ চেনে শিরীর রুদ্ধ দ্বার।।
পাহাড়ে পাহাড়ে প্রবল কুঠার
ভেঙে করে একাকার;
সমতলে এনে বন্ধুর শিলা জাগায় সেখানে ফুল
দোলায় শিরীর অলকপুচ্ছে বসোরা কুঁড়ির দুল।

মৃত বুস্তান তোমার মনে কি মেলছে সবুজ পাতা?
তোমার শাখায় জাগ্ছে কি ফুল জরদ, রক্তরাঙা,
প্রবালের ফুল হাজার আনার ভাঙা,
শ্বেত প্রবাল কি উঠ্ছে ও বুকে ফুটি,
দিগ্কাওসের ধনুতে প’ড়ছে লুটি,
বর্ণবিহীন সেতারার বুকে জাগ্লো কি তার দ্যুতি,

সুলায়মানের বিশ্বজয়ের গগনচুম্বী স্মৃতি
জাগালো কি বুকে প্রবল আশার গীতি?
শিরীন আমার খোলো দ্বার, খোলো দ্বার,
ঘুম-মহলার তিমির-প্রকার ভেঙে করো একাকার
এদিকে তাকাও যেখানে আকাশে ফুটছে লক্ষ তারা,
দেখ সে আরবী তাজী গতিমান আকাশে বাল্গাহারা-
ঝড়ের শিখরে জাগায় প্রবল হ্রেষা,
গতি-আবর্তে সুদৃঢ় তার নেশা
ভাঙে না বাধার কুটিল ব্যঙ্গস্বরে,
চোখের পলকে সে আরবী তাজী উধাও দেশান্তরে।
কেঁপে ওঠে তার সজীব খুরের আঘাতে মৃতের ঘর,
জেগে ওঠে তার প্রবল গতির ঝড়ে মৃত প্রান্তর।

উঠ্ছে কি জেগে মনের আকাশ রংগিন ধনু আঁকা,
ফুটছে কি সেথা আধো সাদা চাঁদ বাঁকা,
ফুটছে কি ঈশ্ক্ আগুনের দাহে রঙিন গুলমোহর?
যদিও বাহিরে ব’য়ে যায় ভয়াল প্রলয়কর
তবু অন্দরমহলে তোমার বিহঙ্গ বেগবান,
আজো বয়ে আনে সুলায়মানের বিশ্বজয়ের গান।
সেই বিহঙ্গ ঝড়ের মুখেও পাল্লা দিয়ে যে ওড়ে;
প্রলয় হাওয়ার পাখা মেলে দিয়ে সেই নির্ভীক ঘোরে,

বজ্র-আহত বনানীর মাঝে তোলে সে প্রবল কেকা,
ব’য়ে আনে তারা- প্রশান্ত নীলে শুক্লা চন্দ্রলেখা,
সেই বিহঙ্গ মেল্ছে কি পাখা উড়ন্ত-বৈশাখ
তার নিরুদ্ধ কণ্ঠ হ’তে কি শুন্ছো ঝড়ের ডাক!

রাতের পাতার ঘুমভাঙা ফুল জাগাবে সে এই ঝড়ে,
প্রাণ-বন্যার আন্‌বে তুফান সকল দিগন্তরে!
সে এনেছে দেখ হেরার পথের কাঁকর ওষ্ঠপুটে
জমাট পাথরে উঠ্ছে গোলাব ফুটে,
পাখায় ব’য়ে সে এনেছে দেখ, কী অপূর্ব মহাদান,
দূরের ইশারা দিয়ে ভাসমান তখ্তে সুলায়মান।

মুগ্ধ সাপের মতন বাতাস বন্ধুর পথ পারে
তোমার আসন ব’য়ে নিয়ে যায় তারকালোকের দ্বারে,
তোমার মুঠির মাঝে আবদ্ধ মাটির পুষ্পশ্বাস,
চোখে আর বুকে কী বিপুল আশা সুদৃঢ় আশ্বাস।
ইংগিত দিয়ে জাগ্ছে সুলায়মান,
বাতাসে ভাস্ছে তখ্তে সুলায়মান,
দেখ ইশারায় ডাক্ছে আকাশে হেলাল-শ্বেত-নিশান।
বিরাণ-মাটির-অতলে স্বপ্ন পুষ্পিত, অফুরান,-
আজ সে শ্রান্ত ঘুমঘোরে তবু চলে তার সন্ধান,
নিরুদ্ধ পথ পাষাণ প্রাচীরে তবু জোয়ারের টান,
ইংগিত দিয়ে জাগ্ছে সুলায়মান,
বাতাসে ভাসছে তখ্তে সুলায়মান।

এখনো খেজুর-বীথিতে, অশেষ হেরেমের জিন্দিগী,
এখনো যে তার খোর্মাশাখার মধু সঞ্চয় ঝ’রে;
একলা কি তুমি ভয় পাবে এই ঝড়ে,
দেখ ওয়েসিসে কলাপ মেলেছে শিখী।

তুমি কি চলেছ সংবাদ নিয়ে হে দূত বিরাণ মাঠে
শ্রান্ত তোমার পদ?
পথে ভিড় করে, বাধা দেয় যত পিশাচের সংসদ?

শত বিনিদ্র তিমিরে তোমার ক্লিন্ন রজনী কাটে?
তোমার মনের সাত আরশি কি আজ কুয়াশায় ঢাকা,
তুহিন তোরণে ভেঙে ভেঙে পড়ে রসবঞ্চিত শাখা?
তোমার জংগী সঁজোয়ায় আজ মর্চে পড়েছে বীর,
অনেক দিনের অনাবাদী জমি আজ ফেটে চৌচির?
তবুও আকাশে চাঁদের ইশারা, তারা:
রুদ্ধ ঝরোকা প্রান্তে ঝ’রছে ঝর্ণা শিশিরধারা!
তোমার মৃত্যু-সমুদ্র মোহনায়
জীবনের আস্বাদ,
তোমার জীবন-রমজান সাধনায়
স্বপ্ন ঈদের চাঁদ।
তোমার চৈত্র-ফাটল-দীর্ণ রেখায়িত প্রান্তর
ইশারা ক’রছে যেখানে আকাশে জমেছে মেঘের স্তর।
বিস্মরণের অতল গভীর কূপে কি গেছে সে সাড়া
পেয়েছে কি সেথা চাঁদের ইশারা কক্ষচ্যুত তারা?
মৃত্তিকা তনু চেরাগে কি জাগে শিখা?
ছিঁড়ছে কি ম্লান আড়াল-কুজ্ঝটিকা?
সাড়া পেলে তার? সে আসে প্রবল গতিমান যাযাবর
আরবী তাজীর পিঠে যে বেঁধেছে পথ চ’লবার ঘর।।