কাফেলা

ধূলির তুফান তুলি ওরা চলে রাত্রিদিন মরুর হাওয়ায়
ক্রমাগত ছায়া ফেলে ঘন জলপাই বনে, খেজুর শাখায়,
কোথায় চলেছে তারা কোন দূর ওয়েসিস কিংবা সাহারায়;
জানি না কোথায়!

উটের ঘণ্টার শব্দে ম্লান মরুবালু ওড়ে, মুছে যায় বেলা,
ঝড়ের প্রশ্বাসে তার গড়ে ওঠে ভেঙে পড়ে ধরণীর ঢেলা,
ওরা সব দল বেঁধে উটের সারির আগে তবুও একেলা
চ’লেছে কাফেলা!

কোন দূর দেশান্তের জনপদ হ’তে ওরা নিয়াছে বেসাতি,
কোন দিগন্তের ধারে আজ ওরা একমনে খুঁজিতেছে সাথী,
কাশ্মীরী লাবণ্য আর বাগদাদের রূপকথা; ধ্বংস-স্তূপ-পারে
ঊষার দুয়ারে…

সাইমুমের স্রোতাবর্তে, গোবির বালুকা পথে, তারার বিস্ময়
ওড়ায়ে দু’রঙা ধূলি ঘূর্ণাবেগে কাফেলার নব পরিচয়
মুহূর্তে মুহূর্তে এই নার্গিস-ফোটানো দীর্ঘ পথের কিনারে;
মঞ্জিলের দ্বারে…

দু’ঘড়ির অবসর নিয়ে ফের যাত্রা তার দুস্তর আবেগে,
চকিতে জাগায়ে দিয়ে হিঙুলের প্রাণ-বন্যা তীব্র গতিবেগে
কাফেলা চলেছে ছুটে, পিছনে পড়িছে লুটে সাথীরা প্রাচীন,
শেষ হল দিন!

জেরুজালেমের মাঠে তবু ভ্রাম্যমাণ সেই সুবিপুল ঝড়ে
জলপাই-শাখা হ’তে একে একে সবুজের চিহ্ন ঝ’রে পড়ে,
হেরেম বন্দর ফের নতুন ঊষার রাগে হ’য়েছে রঙিন;
শুরু হ’লো দিন।

পাথর চাপানো ভার, শিকলের ভারী বোঝা নিয়ে এল দিন,
পরিখার পাশ দিয়ে ব্যর্থ হ’য়ে চ’লে গেল সর্পিল সঙ্গীন;
দিগন্তের চাকা ঘুরে দীর্ঘ পরিক্রমা-শেষে খুঁজে পেল তীর
জয়দৃপ্ত শির।

সূর্যের বল্লম ফের নরম স্বপ্নের খাপে আসে ম্লান হ’য়ে,
গলে বকৌলির নীল সাততলা মহলের শিখা আনে ব’য়ে,
সরদ্বীপের মোম ছেড়ে যায় সীমাবদ্ধ বেদুঈন খিমা
সংজ্ঞাহীন সীমা।

পাথরে প্রশান্ত যেথা আতশী-পেয়ালা আর শাহ্ জামশিদ
কাফনের কালো নেশা নেকাব প্রচ্ছায় যার নাহি ভাঙে নিঁদ
দুপাশে ঘুমায় তার ইরানের শাহ্জাদী; ওঠে হাহাকার
নিঃশব্দ নিসাড়।

কখন সুরার পাত্র আল্ বোরজের প্রান্তে চূর্ণ হ’ল তার
ম্লান হ’য়ে নিভে এল বিলোল কটাক্ষ কত তন্বী জোহরার
আঙুর বনের হাওয়া থেমে যায়, নেমে আসে ধরণীর বেলা;
থামে না কাফেলা।

সরাইখানার সেই ঝড়ের গতিতে ভেঙে মরু-মুসাফির
তন্দ্রামুক্ত সাথীদের বিরাট মিছিল নিয়ে খুঁজেছে শিশির
মৃগ-তৃষ্ণিকার মায়া কাটায়ে কখন তারা ছেড়ে মরুবিষ
খোঁজে ওয়েসিস।

যেথা শবনম-স্বপ্ন শুকায়ে প্রখর তাপে জেগেছে আবার,
পাদপিষ্ট ধূলিকণা হাওয়ার সোঁতায় উড়ে জেনেছে আবার
বিষাক্ত জিন্দানখানা পার হ’য়ে তার শুভ্র দিকচক্রবাল
দোলায় হেলাল।

লু’ হাওয়ার বেড়া ছিঁড়ে পায়ে পায়ে পিষে ফেলে বাধার শিকল
অনেক মরুভূ পারে তাদের দুর্গম যাত্রা হ’য়েছে সফল,
আজ পঙ্গপাল-মুক্ত সবুজ গমের শীষ, ফুটন্ত নার্গিস
মেলে ওয়েসিস।

উটের সারির আগে মরু-চাঁদ ভেসে চলে আরব আজমে
ধূসর পাতার দেশে আবার মেঘের রঙ হ’য়ে জমে,
সুতুর-বানের দিন ব্যথাতুর, আঁসু ঝ’রে সিরিয়ার সাঁঝে,
যেন বাঁশী বাজে,

কাফেলার পাশ দিয়ে দিন রাত্রি, রাত্রিদিন স্বপ্ন তন্দ্রাতুর
স্মৃতির অতল হ’তে অবিরাম বেজে চলে সে-বাঁশীর সুর,
গ’ড়ে ওঠে ভেঙে পড়ে অনেক মিনার…আজ জানি না কোথায়
মেশে সাহারায়…

এবার ঘনালে সন্ধ্যা কোথায় ডেরার খুঁটি পাতিবে তাহারা
জানে না, সম্মুখে জাগে আদম-সূরাত, সন্ধ্যাতারার পাহারা
বন্য-বুতীমার দলে, মরু-বিয়াবানে কিংবা সাঁতোয়া আকাশে
তারা যেন ভাসে…

ভেসে চলে সাথে সাথে সেতারার সাদা মালা, মরুভূর ঢেলা,
ভেসে চলে খেলাঘর, ভেসে চলে শ্রান্ত কায়খসরুর খেলা,
নর্তকীর ভাঙা হাট শেষ হ’ল ভেঙে গেল খোশরোজ মেলা…
চলেছে কাফেলা…

উটের পায়ের শব্দে যাযাবর মরুতট হয়েছে বিভোল,
রাত্রিভরা সেতারার আলো আর মালা তার বুকে দেয় দোল,
শারাবন-তহুরার সন্ধানে যাদের দিন হ’য়েছে নিখোজ-
খোঁজে নওরোজ।

তাদের চলার তালে ঘুম ভাঙে, দুই চোখে নেমে আসে ঘুম,
সুবে-সাদেকের শুভ্র পথে এসে তারকারা নীরব নিঝুম…
দীর্ঘ মোরাকাবা শেষে অকস্মাৎ প্রভাতের রঙিন মিনার
চূড়া তোলে তার…

প্রবল গতির ঝড় বুকে নিয়ে রুদ্ধশ্বাস উড়িছে ঈগল,
দিগন্তে সোনালি বানে খুলে গেছে শর্বরীর তিমির শিকল,
উটের সারির পাশে জমা হ’ল একে একে দৃঢ় অচপল
দূর-যাত্রীদল।

সুতুর-বানের সুরে ঘুম-ভাঙা চোখ মেলে মরুর জাহাজ,
অনেক মৌসুম পানে তারা সবে দীর্ঘ-যাত্রা করিয়াছে আজ,
চিকন সোনালি বন্যা ধুয়ে যায় তাহাদের তারুণ্য সুঠাম
তাহাদের নাম।

মরু-বালুকার পথে অন্তহীন পদচিহ্ন এঁকে তারা চলে
দুই রঙ শাদা-কালো দিন-রাত্রি তাহাদের সম্মুখে উছলে,
অন্ধকার নীড় হ’তে সূর্য-আলোকিত তনু টেনে আনে পাখী
অন্তরালে থাকি’…

এখনো চলেছে তারা ধূলির তুফান তুলে আকাশের গায়
ক্রমাগত ছায়া ফেলে ঘন জলপাই বনে, খেজুর শাখায়,
কোথায় চ’লেছে তারা কোন দূর ওয়েসিসে কিংবা সাহারায়
জানি না কোথায়…