মদীনার মুসাফির

তোমাকে পৌঁছিতে হবে সুবেহ সাদেকের আগে মরু-মদীনার
মুক্ত দ্বারে
যেখানে স্বপ্নের মত খোর্মা-বীথিকা শুধু দুলিয়াছে
রাত্রির জোয়ারে
যেখানে বহিয়া বোঝা একমনে চলিয়াছে খলীফা ওমর
যেখানে সত্যের সঙ্গী সিদ্দীক বেঁধেছে তার ঘর
যেখানে সিংহের মত ফিরেছে নির্ভীক আলী হায়দর।

আকাশে উঠেছে ঝড় হে যাত্রিক! অশ্রান্ত কাফেলা!
তোমার দুর্লঙ্ঘ্য পথে আছে জানি মরণের খেলা
লু’ হাওয়ার বিষ মৃত্যু-নীল
দুস্তর তরঙ্গ, স্রোত উদ্দাম ফেনিল।
বিদ্যুৎ বিদীর্ণ কোটি তীব্র পরিহাস
কঠিন জ্বেহাদ বাধা বীভৎস সন্ত্রাস
হে আমার অশ্রান্ত কাফেলা!
নিবিড় নিশিথারণ্যে যাত্রা তবু করো এই বেলা।
তোমাকে খুঁজিয়া ফেরে হেরার সুতীব্র সূর্য নিত্য দীপ্তিমান
তোমার সন্ধানে ফেরে বেলালের বিহ্বল আজান,
কোরআনের ছেঁড়া পাতা জোড়া দেয় জ্ঞানী ওসমান
করণির প্রেম জাগে শর্বরী প্রহর;
যেখানে নিশীথ স্তব্ধ নবীজীর ঘুমন্ত শহর।

যে মরুর বালুকণা গড়ে গেল অগণন শক্তির মিনার
যার কণা স্পর্শ পেয়ে রাঙিল অসংখ্য মন, সভ্যতার অশেষ কান্তার
যার তীব্র খরতাপে নিমেষে উড়িয়া গেল বৈষম্যের কৃত্রিম পাহাড়
আলীর দরাজ হাতে যে মরুতে চমকালো শাণিত দুর্বার
দীপ্ত তলোয়ার সে মাটির বুক থেকে ডাক এল, হে কাফেলা! আজিকে তোমার!

তোমাকে পৌঁছিতে হবে সোনালি ঊষার আগে যেথা স্তব্ধ
ঘুমন্ত শহর।

নবীজীর বাণী-স্পর্শে যেখানে জাগিয়া উঠে নিশীথ প্রহর
যেখানে জীবিত হয় জড়তার বিকৃত কবর
সুবেহ-সাদেকের আগে সে মাটিতে তুলে নিও জীবনের ঘর
সে মাটির পথে আজ দ্রুততর করো গতি টেনে ধরো উটের লাগাম
নিমেষে মুছিয়া যাক পদতল হ’তে হিন্দ, ইরাক ও শাম,
সে মাটির টানে চলো সব কূল দিক হ’তে হিন্দ, ইরাক ও শাম,
সে মাটির টানে চলো সব কল দিক হ’তে মত্ত পরওয়ানা
সে মাটির রশ্মিজালে দগ্ধ করো ভাবাকুল ডানা
সে মাটির স্তব্ধ নীরবতা
তোমার ঘুমন্ত মনে তুলুক দুঃসহ ঝড়, গতি চঞ্চলতা।
তোমার মসৃণ সুপ্তি মুছে নিক সে মাটির তীব্র খরোত্তাপ
শৃগাল দুর্বল চিত্তে জাগা’ক সে কুণ্ঠাহীন সিংহের প্রতাপ।
তোমার সংকীর্ণ ঘর করুক সে মানুষের উন্মুক্ত বন্দর
তোমার দুর্বল চিত্তে পাঠাক সে বিজয়ের সহস্র খবর।

তোমাকে পৌঁছিতে হবে সুবেহ-সাদেকের আগে সে মাটিতে
শান্ত মুসাফির
তোমাকে ঘোচাতে হবে সে সফেদ রোশনিতে শতাব্দীর
সঞ্চিত তিমির
পশ্চিমের দারুখানা ভেঙে দিতে হবে সেই ঝড়ে
জিন্দিগীর স্পর্শ এনে দিতে হবে নির্জিত পাথরে।

জিন্দানখানার কক্ষে কাফেলার পদধ্বনি শুনিতে কি পাও
জিঞ্জির আবদ্ধ হাত স্বপ্নঘোরে হলো কি উধাও;
উতলা হলো কি দিল্ ইশকের আতশী শরাবে,
উন্মত্ত মাতাল মন জাগল কি লু’ হাওয়ার খা’বে?
তবে চলো তবে চলো দেখ আজ মেঘে মেঘে উদ্যত অধীর
বিদ্যুতের দীপ্ত শমশির
দেখ আজ জালিমের গুপ্ত ছুরি তীব্র খরধার
পিছু ধাওয়া করিছে তোমার;
দেখ আজ পথে পথে কোকা’ফ কঠিন দুর্লঙ্ঘ্যতা
দেখ আজ বৈশাখের বহ্নি ঝড় উচ্চারিছে ভয়াল ব্যর্থতা।

তবু আজ অকুণ্ঠিত উটের লাগাম ধরো মদীনার পথে মুসাফির
ভেঙে চলো জ্বেহাদের তীব্রাল্লাসে বাধা ও প্রাচীর,
ভেঙে চলো সাবধানী কারুণের মুঠি।
ভেঙে চলো উত্তাল ভ্রূকুটি
তোমার মঞ্জিল যেথা বহুদূরে মানুষের ঘর।
নবীজীর ঘুমন্ত শহর।।