পথ

কৃষ্ণা দ্বাদশীর পাণ্ডু ক্ষয়মান চাঁদ
আরক্ত ঊষার প্রান্তে এল শেষ হয়ে,
দিগন্তে স্বর্ণাভা: দূরে আলোর ইঙ্গিত।
থামাও মৃত্যুর সুর শোন জীবনের
অনুধ্বনি: মেঠো পথ; পায়ে চলা পথ
কাঁকর বিছানো পথ: মজুরের আর
নিঃস্ব জনতার পথ টানিছে আমাকে।
রাজসিক আড়ম্বরে চলেছে যে-পথ
এখনো পাশব-গর্বে,-সে পথের আয়ু
এল শেষ হয়ে, ডাকে মানুষের পথ
নিরন্ন ক্ষুধিত শীর্ণ মানুষের পথ,
ধর্ষিতা মায়ের রিক্ত ক্রন্দনের পথ
সংকীর্ণ আবদ্ধ পথ পীড়িত আত্মার,
অশ্রান্ত ক্ষুধিত পথ বিপ্লবী-মনের
ইন্দোনেশিয়ার পথ, ফিলিস্তিন আর
ইন্দোচীন, ইরানের দুর্গম সড়ক
আমাকে শুনিতে দাও আন্ন ঝড়ের
গুরুগুরু পূর্বাভাষ, দেখে যেতে দাও
বিপ্লব বিকাশ বজ্র দিগন্তে, প্রত্যেক
শৃঙ্খলিত মনে আর শৃঙ্খলিত পথে
মৃত্যু সন্নিবিষ্ট দৃঢ় আজাদীর পথ
অজানা দুর্গম পথ শ্বাপদসংকুল।
মধ্যরাত্রি অতিক্রম করার প্রয়াসে
কালপুরুষের পথ দুৰ্গম বন্ধুর
অগ্নি ও অঙ্গার ঘেরা। থামাও এবার
বিশ্রান্ত মদির সুর ক্লীবত্বের ঘরে
সিংহের বিমুক্তি ছেড়ে শৃগালী-কৌশলে
আত্মার আলোকচ্যুত জড়তাশিলায়
অন্ধকূপে মাথা ঠুকে নিত্য সংক্রমণ।

সবুজ সোনালী ধানে উদ্ভাসিত নীল
দিগন্ত মরুর বক্ষে মুক্তির আশ্লেষে
উদার আকাশ-প্রান্তে সাম্যের হাওয়ায়
উম্মত্ত সিনাই-চুড়ে অপার্থিব প্রেমে
মৃত্যুর বন্ধনী ছিঁড়ে জীবনের বুকে
ডাক এল পথ সঙ্গী, ডাকে সেই পথ
যে-পথে সংক্ষুব্ধ রাত্রি নতুন দিনের
প্রথম আশ্বাস শোনে, যে-পথের তীরে
বেদুইন পায় খুঁজে পরিচিত ডেরা
সে-পথের রেখা গেছে দিগন্ত ছড়ায়ে
নতুন দিগন্ত পানে আদিম উল্লাসে,
যে-পথের ধূলিমাঝে পতাকা সাম্যের
উঠায়েছে উর্ধ্বশির, সে-পথে আমার
আরব্ধ জীবন আর যে-পথে আমার
সমাপ্তি মৃত্যুর সেই পথে ধূলির
আমন্ত্রণ শুনি আমি প্রত্যেক অণূতে,
প্রতি পরমাণু মাঝে করি অনুভব
সে-পথের সজীবতা, সে জীবন্ত ধূলি
আমাকে টানিয়া নেয় দূর
হতে দূরে
চেঙ্গিসের উদ্দামতা সীমানা হারায়ে
মরে সে পথের টানে:
মাঝি সিন্দবাদ
সে-পথের রেখা ধরি করে অভিযান
সে-পথের আলোদীপ্ত প্রাণদ ঈগল
নতুন ঊষার পানে পাখা মেলে তার,
উচ্ছিত কম্পিত পাখা জীবন সারস-
অপমৃত্যু দেখে নাই সে বিহঙ্গ মোর,
দীনতার সাথে তার নাই পরিচিতি,
রাত্রির নিকষ দুর্গ ভাঙি সে তরুণ
সবারে দেখায় পথ, সম্মুখে সবার
এনে দেয় ঊষালোক সুতীব্র উজ্জ্বল।
আমার মরণ ঘুম সহস্র কর্মের
ভেঙে গেল সে পাখীর বন্ধহীন সুরে
আর এক ঊষালোক, আর এক পথ
খুলে গেল পৃথিবীর মৃত রাত্রি শেষে।।