বইয়ের দোকানে

ঢাকা শহরে- নিউমার্কেট, স্টেডিয়াম, বা অন্য কোথাও-কোনো ভালো বইয়ের লোকানে যখন ঢুকি, বড়ো বিব্রত বড়ো অস্বস্তি বোধ করি। মনে হয় ছাড়পত্র ছাড়া ঢুকে পড়েছি কোনো ভিন্ন দেশে, এসে পড়েছি তাদের বইপাড়ার ঝকঝকে বইয়ের দোকানে। চারদিকে ভাক, মেঝে ও অন্যান্য বন্দোবস্ত জুড়ে- ভিডিও ক্যাসেটের মতো সাজানো রঙবেরঙের বই; যেদিকে তাকাই দেখি থরেথরে সাজানো কলকাতা। এই রঙিন, আবেদনজাগানো, আমদানি করা পণ্যের মধ্যে আমার বিপন্ন চোখ খুঁজতে থাকে দেশি বই, যা সাধারণত চোখে পড়ে না। ভয়ে ভয়ে খুঁজি বাঙলাদেশের বই, আতংকে থাকি এই বুঝি চোখে পড়ে যাবে বাঙলাদেশের বই, এবং লজ্জায় কালো হয়ে যাবো। দেশি বই চোখে না পড়লেই সুস্থ বোধ করি। যখন হঠাৎ দেখতে পাই দোকানের এক কোণে ছোটো তাকে অবহেলায় পড়ে আছে কয়েকটি দেশি বই- গরিব, রঙচটা, উপেক্ষিত, তখন রক্তে চাপ বোধ করি; অসহায় লাগে, অপমানিত বোধ করি অনেকটা। ওই সব বইয়ের দোকানে আমার কোনো বই দেখি না, একে আমি স্বাভাবিক ব’লেই মনে করি; কিন্তু যাদের বই বেশ বিক্রি হয়, তাদের বইও দেখা যায় না ওইসব আমদানিমত্ত দোকানগুলোতে। কলকাতার বইয়ে আমাদের ডলারসম্পন্ন বইয়ের দোকানগুলো প্লবিত হয়ে আছে; ওই বন্যায় ভেসে গেছে বাঙলাদেশ ও বাঙলাদেশের বই। কলকাতা কি এখনো আমাদের সাংস্কৃতিক কেন্দ্র? কলকাতায় অনেক বই বেরিয়েছে, বিজ্ঞাপনের উচ্চকণ্ঠ আবেদনে সেগুলোর নাম আমি জানি, কি এইসব বই আমি হয়তো কখনো পড়বো না। কলকাতা এখনো আমাদের চোখে উঁচু পর্বতের মতো; আমরা যেনো মনে করি ওই পর্বতে জমবে মূল্যবান তুষার, আর আমরা ভাসবো এই তুষারগলা ঢলে। পশ্চিম বাঙলার গৌণ লেখদের নামও আমি জানি, তাদের আমরা গণ্য করি প্রধান ব’লে; তাদের বই হাতে পেলে ধন্য হই। এটা আমরা বুঝি না যে কলকাতায় সৃষ্টিশীলতা ও মেধা এখন পুরোপুরি পণ্যে পরিণত হয়ে গেছে, তারা সারাক্ষণ ফেরি করে ফিরছেন নিজেদের মস্তিষ্ক ও হৃৎপিণ্ড। কলকাতার অধিকাংশ বইই আসলে বই নয়; ওইগুলো ব্লেড, পাউডার, শাড়ির মতোই পণ্য। কলকাতায় বই লেখা এক বড়ো পেশা, এ পেশায় জড়িত ব্যবসায়ীর সংখ্যাও কম নয়। কেউ ফেঁদে চলেছেন গল্প, কেউ উৎপাদন ক’রে চলেছেন কাব্যিক পাগলামো, কেউ করছেন বুদ্ধিব্যবসা। মুদ্রণ শিল্পের উন্নতির ফলে ওই পণ্যরাশি এখন ঝকঝকে প্রচ্ছদে বাধাই হয়ে বাজারে ঢুকছে; কিন্তু তাদের বাজার খুবই ছোটো। উচ্চবিত্তরা বই পড়ে না, নিম্নবিত্তরাও পড়ে না- পড়তে পারে না; তাই তাদের পুস্তকপণ্যের জন্যে দরকার বিদেশি বাজার। বাংলাদেশ তাদের বইয়ের লোভনীয় বাজারের ভূমিকা পালন করেছে। পশ্চিম বাংলায় এখন বাঙলা ভাষার যে-অবস্থা, তাতে একদিন সেখানে বাঙলা ভাষা টিকে থাকবে সম্ভবত শুধু সাহিত্যে, বইতে; পুরোপুরি তাঁরা নির্ভর হয়ে পড়বেন বাঙলাদেশী পাঠকদের ওপর। তাঁদের বই মাত্রই ভালো বই নয়, যদিও মুদ্রণ ও প্রচ্ছদ উন্নত। আমরা কি ওই মুদ্রণ দিয়েই মোহিত হয়ে থাকবো? আমি কোনো দেশের বইয়েরই বিরোধী নই, পড়তে চাই সব দেশের বইই; কিন্তু পশ্চিম বাঙলার পুস্তকপণ্যকে আমাদের জন্যে ক্ষতিকর ব’লে মনে করি। এখন যেভাবে অবাধে বই আমদানি করতে দেয়া হচ্ছে কলকাতা থেকে, তা আমাদের মেধা ও সৃষ্টিশীলতার বিরুদ্ধে ভয়াবহভাবে কাজ ক’রে চলছে। কলকাতার সস্তা উপন্যাস, বাজে কবিতা, ব্যবসায়িক প্রবন্ধ উপকারের চেয়ে অপকার করছে বেশি। আমাদের বই সেখানে যায় না, কিন্তু আমরা বাস করছি তাঁদের বইয়ের স্তুপের নিচে। এখন সম্ভবত কয়েক কোটি টাকার বই আসছে, এটা নিয়ন্ত্রণ করা দরকার। কলকাতার বইয়ের দুর্ঘটনার সাথে যুক্ত হয়েছে আরেকটি দুর্ঘটনা, যা আমাদের সাহিত্যের জন্যে ক্ষতিকর। ষাটের দশকে আসতো প্রচুর ইংরেজি বই, যা আমাদের পরিচিত ক’রে দিতো বিশ্বসাহিত্যের সাথে; এখন পশ্চিমের বইপত্র আসে না। জানতে পাই না কী ঘটছে আধুনিক সাহিত্যের প্রধান এলাকাগুলোতে। ষাটের দশকে বিশ্বসাহিত্যের সঙ্গে পরিচয়ের ফলে আমাদের সাহিত্যে একটি ঢেউ এসেছিলো, এখন সে ঢেউ নেই। কেননা বিশ্বসাহিত্য থেকে বিচ্ছিন্ন আমরা।

বাংলাদেশে প্রকাশনা একটি গুরুত্বপূর্ণ শিল্পরূপে আজো দেখা দিলো না, যদিও ভালো লেখক আছেন, এবং ভালো লেখক জন্মানোর সম্ভাবনা প্রচুর। আমাদের প্রকাশকদের অনেকে বই ব্যাপারটিই বোঝেন না, তাঁরা পুস্তক প্রকাশনাকে মনে করেন এক ধরনের কুটিরশিল্প; বোঝেন না কী বই ছাপবেন, কার বই ছাপবেন, কীভাবে ছাপবেন। তারা লেখদের সাথে কোনো চুক্তিও করেন না, সম্মানীও না দিতে পারলে দেন না। মুদ্রণ ও প্রচ্ছদের শোভনতার দিকে তাদের কোনো লক্ষ্য নেই। আমাদের বইগুলোকে বই ব’লেই মনে হয় না; – তার কাগজ অরুচিকর, ছাপা অস্বস্তিকর, বাঁধাই আদিম। হাতে নিয়ে একটুও সুখ পাওয়া যায় না। উপহারের জন্যেও যখন কেউ কেউ কিনতে যান, অনেক খুঁজেও একটি শোভন বই পান না; যেগুলো পাওয়া যায়, সেগুলো উপহার দিলে পরিবেশই নষ্ট হয়ে যাবে ব’লে ভয় হয়। তখন পাশেই পাওয়া যায় কলকাতার রঙিন বই, যা হাতে নিলে ভালো লাগে। বাঙলাদেশের লেখদের নাম জানাও কঠিন ব্যাপার, তাঁদের বইয়ের নাম জানা তো গভীর গবেষণার বিষয়। কোনো বইয়ের বিজ্ঞাপন হয় না, ভালো বইয়ের বিজ্ঞাপন একবারেই হয় না। বিনোদনমূলক কিশোরকিশোরী পাঠ্য বইয়ের কিছু বিজ্ঞাপন হয়, নানা ধরনের প্রচারও দেয়া হয় সেগুলোর; কিন্তু ভালো বইগুলো থেকে যায় চোখের আড়ালে। সাধারণত এখানে কিছু নিম্নমানের লেখক নিজেদের উৎসাহে নিজেদের বইয়ের বিজ্ঞাপন দিয়ে থাকেন, তাতে তাদের নাম জানি আমরা; হয়তো এতে কিছু বই বিক্রিও হয়। ভালো বই আমাদের বড়ো সমস্যা নয়, সমস্যা ওই বই ভালোভাবে প্রকাশ ও বিপণন। আমাদের দেশে বই পড়েন কারা? উচ্চবিত্তরা বই পড়ে না। তাদের ভিসিআর আছে, ব্লুফিল্ম আছে, ব্যাংকক সিঙ্গাপুর আছে; পান ও উৎসব আছে। নিম্নবিত্তরা বই পড়ে না, অনেকে পড়তে পারে না, অনেকের কাছে বই হচ্ছে পাঠ্যবই। মধ্যবিত্তরা বই পড়ে? তারাও বিশেষ পড়ে না। এখানে বই পাড়ে ছাত্রছাত্রীরা, তারাই আমাদের প্রধান পাঠকশ্রেণী। বিনোদনমূলক কিছু বই বেশ বিক্রি হয়, কেনে নবমদশম শ্রেণীর বালকবালিকারা; তারা ভারতীয় বইয়ের শিকার হয়ে ওঠার উপযুক্ত নয়। কিছু অধ্যাপক বই পড়েন, তারা ভারতীয় বইয়ের শিকার। তাই বাঙলাদেশে প্রকাশিত ভালো বুই অবিক্রিত থেকে যায়। একটি ভালো প্রবন্ধের বই এখানে বছরে পঞ্চাশ কপি বিক্রি হয় না, ওই বইটি যারা পড়তে পারতেন তারা কলকাতার কোনো নিকৃষ্ট বই পড়েন। তাই আমাদের প্রকাশনা ও বিপণনের উপেক্ষিত দিকটির দিকে গভীর মনোযোগ দেয়ার সময় এসে গেছে। আমরা কি দেখতে চাই না জাতির সৃষ্টিশীলতা ও মননশীলতার বিকাশ? আমরা কি বাইরে নিম্ন সৃষ্টি ও মননশীলতা দ্বারা পর্যুদস্ত হয়ে থাকতে চাই? আমার ইচ্ছে হয় বইয়ের দোকানে স্বস্তির সাথে ঢুকি, সেখানে পাই বাঙলাদেশকে, তার হৃদয় ও মস্তিস্ককে। ভিন্ন দেশের পাঁচ-হাত-ঘোরা হৃদয় আর মগজ নিয়ে কতোকাল আনন্দে থাকবো?